বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালের মধ্যে ৮ শতাংশে নিতে হলে বিনিয়োগ ও সঞ্চয় বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে অবকাঠামো উন্নয়নে—এ মত বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগের আগে সে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। যোগাযোগব্যবস্থা, বিশেষ করে সড়ক ও রেল যোগাযোগ উন্নত হলে বিনিয়োগ বেড়ে যায়। আর বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে শুরু হয়েছে নীরব বিপ্লব।
বদলে যাচ্ছে যোগাযোগ অবকাঠামো
পার্থ সারথি দাস

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্যানুসারে, দেশে সড়ক ও রেল খাতের উন্নয়নে ২০১০ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ বছরে তিন শতাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এশীয় মহাসড়কে যুক্ত হতে বাংলাদেশ সরকার চুক্তিতে সই করেছিল ২০০৯ সালের ১০ আগস্ট। আন্তদেশীয় ও আঞ্চলিক যোগাযোগের জন্য দেশে এশীয় মহাসড়কের তিনটি রুটে এক হাজার ৭৬০ কিলোমিটার মহাসড়ক আছে। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩২টি দেশের সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগের জন্য এখনো মহাসড়ক পুরোপুরি বিশ্বমানে উন্নীত হয়নি। বেনাপোল, তামাবিল, বাংলাবান্ধা ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে পাশের দেশগুলোর মধ্য দিয়ে আন্তদেশীয় যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত হতে দেশে এই সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে লাগবে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা।
এশীয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন—ইউএন-এসকাপের গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এশীয় মহাসড়কের এক হাজার ৭৬০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রথম শ্রেণির মহাসড়ক আছে ৩১১ কিলোমিটার। দ্বিতীয় শ্রেণির মহাসড়ক এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার এবং তৃতীয় শ্রেণির মহাসড়ক আছে ৪৪ কিলোমিটার। তৃতীয় শ্রেণির নিচে মহাসড়ক আছে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার।
এশীয় মহাসড়কের এএইচ-১ রুটটি জাপান থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক হয়ে বুলগেরিয়া সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে। বাংলাদেশে রুটটি বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ঢুকে যশোর-নড়াইল-কালনা ফেরিঘাট-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা-চরজানাজাত-মাওয়া-ঢাকা হয়ে কাঁচপুর-নরসিংদী-শেরপুর-সিলেট হয়ে তামাবিল পর্যন্ত যাবে। ৪৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ রুটের মধ্যে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো হতে যাচ্ছে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দোতলা পদ্মা সেতু। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ায় মূল সেতুর পাইলিং উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ সেতু বিভাগের অধীন এ প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের মূল সেতুসহ বিভিন্ন অংশের কাজ চলছে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেতুটি চালু হলে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলা সরাসরি যুক্ত হবে। পাশাপাশি রেলপথে যুক্ত হতে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চীন সরকার দেবে ২৪ হাজার ৭৪৯ দশমিক ০৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। রেলপথটি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে এ প্রকল্পে চার হাজার ১০২ দশমিক ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ রেলপথে দ্বিতীয় রেলপথ নির্মাণ এবং বরিশাল ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে।
এশীয় মহাসড়কের প্রথম রুটে কালনা নদীর ওপর কালনা সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে জাপান সরকারের আর্থিক সহযোগিতায়। একই রুটের ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গার ৫৫ কিলোমিটার হবে চার লেনের এক্সপ্রেসওয়ে। এটি হবে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে গত ১৭ নভেম্বর। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ছয় হাজার ২৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ এক্সপ্রেসওয়ে ধরে যাত্রাবাড়ী থেকে ভাঙ্গা যাওয়া যাবে ৪২ মিনিটে।
এশীয় মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে সিলেটের তামাবিল পর্যন্ত ২৮৩ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেন করা হবে। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা, অর্থের জোগান দেবে চীন।
এশীয় মহাসড়কে অযান্ত্রিক ও ধীরগতির যানবাহন মূল মহাসড়কে চলাচল করে না। সেগুলোর জন্য মূল মহাসড়কের পাশে থাকে সার্ভিস লেন। দেশে এ ধরনের একটিই মহাসড়ক আছে, সেটি বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক। তবে সরকার এখন চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণে প্রকল্প নিচ্ছে সার্ভিস লেন নির্মাণের সুযোগসহ। সওজ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সদ্য শেষ হওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেনের সঙ্গে আলাদা সার্ভিস লেন যোগ করতে আলাদা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
এশীয় মহাসড়কের এএইচ-২ রুটটি ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান হয়ে ইরানের তেহরান পর্যন্ত যাবে। রুটটি বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পঞ্চগড়-বেলডাংগা-রংপুর-গোবিন্দগঞ্জ-বগুড়া-হাটিকুমরুল-এলেঙ্গা-কালিয়াকৈর-জয়দেবপুর-ঢাকা-কাঁচপুর হয়ে সিলেট থেকে তামাবিল যাবে। এ রুটের দৈর্ঘ্য ৮০৫ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার। রুটের ২৯১ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার এএইচ-১-এর অন্তর্ভুক্ত। সওজ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এএইচ-২ রুটের জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গার ৭০ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেন করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তাতে ব্যয় হবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এ চার লেন প্রকল্পের আওতায়ও মহাসড়কে নির্মাণ করা হবে আলাদা সার্ভিস লেন। এলেঙ্গা থেকে হাটিকুমরুল-বগুড়া-রংপুর পর্যন্ত ২৫১ কিলোমিটার সড়ক মহাসড়কে উন্নীত করা হবে। পঞ্চগড় থেকে রংপুরের ১০৬ কিলোমিটার সড়কও মহাসড়কে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাবান্ধা থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে।
উপ-আঞ্চলিক রুট এএইচ-৪১ মোংলা বন্দর থেকে শুরু হয়ে খুলনা-যশোর-ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া-পাকশী-দাশুরিয়া-বনপাড়া-হাটিকুমরুল-কালিয়াকৈর-জয়দেবপুর-ঢাকা-কাঁচপুর-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার দিয়ে টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত যাবে। ৭৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রুটের বেশির ভাগ সড়ক দ্বিতীয় শ্রেণির। এ রুটের দৌলতদিয়া-মাগুরা-ঝিনাইদহ-যশোর-খুলনা মোংলার ২২২ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেন করতে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। অযান্ত্রিক যানবাহনের জন্য এ মহাসড়কেও আলাদা সার্ভিস লেন থাকবে। টেকনাফ সীমান্ত থেকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম অংশে ২৮৮ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের জন্য নকশা চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘এক নগরী দুই শহরের’ মতো গড়ে তুলতে কর্ণফুলী নদীর তলেদেশে টানেল নির্মাণ করা হবে। টানেলটি হবে বাংলাদেশে এশীয় মহাসড়কের অংশ। বাংলাদেশ সেতু বিভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পে ব্যয় হবে আট হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে চার হাজার ৭৯৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা জোগান দেবে চীন সরকার। ৩.৪ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে এ নদীর দুই তীরকে যোগ করবে নির্মিতব্য টানেলটি। টানেলটি নির্মাণ করবে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কম্পানি-সিসিসিসি। প্রকল্প পরিচালক ইফতেখার কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের জমি হস্তান্তর করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ নদীর মোহনায় কাফকো-পতেঙ্গা পয়েন্টে টানেলটি নির্মাণ হবে।
ঢাকায় জনসংখ্যা ও যানজটে জন ও যানের সুষ্ঠু চলাচল ব্যবস্থা নষ্ট হয়েছে বহু আগেই। রাজধানীর ৭৩টি ইন্টারসেকশনে যানবাহনের জটে দিনে গড়ে নষ্ট হচ্ছে ৮৩ লাখ কর্মঘণ্টা। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) গবেষণায় বলা হচ্ছে, বিমানবন্দর সড়ক থেকে পোস্তগোলা রুটেই যানজটে দিনে গড়ে ক্ষতি হচ্ছে ২২৭ কোটি টাকা। যানজট নিরসনে উন্নত নগরীগুলোর মতো ঢাকায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উড়াল সড়ক ও সেতু নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এক দশক আগে রাজধানীতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে প্রথম উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয় মহাখালী লেভেলক্রসিংয়ের ওপর। সেটি চালু করা হয় ২০০৫ সালে। এরপর চালু হয় খিলগাঁও উড়াল সেতু। দীর্ঘদিন উড়াল সড়ক অবকাঠামো প্রকল্প নেওয়া বন্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময় এ বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। তারপর যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র হানিফ উড়াল সেতুসহ অন্য উড়াল সেতুগুলোর কাজ শেষ করে চালু করা হয়। মহাখালী, খিলগাঁওয়ের পর কুড়িল, বনানী উড়াল সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এখন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীন নির্মাণ চলছে মগবাজার-মৌচাক উড়াল সেতু। আগামী জুনে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদী প্রকল্প কর্মকর্তারা। সেতু বিভাগের অধীন কাজ চলছে ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা উড়াল সড়কের। সেটি বিমানবন্দর সড়ক থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে, ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সেতু বিভাগের অধীন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আশুলিয়ার নবীনগর হয়ে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সেতু নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা।
বিশ্বের ৫৫টি দেশের ১৪৮টি নগরীতে মেট্রো রেল চালু রয়েছে। রাস্তার ওপর চাপ কমিয়ে নিরাপদ ও দ্রুত চলাচলের এ ব্যবস্থায় যোগ দিয়েছে ভারতের দিল্লি, মুম্বাই ও কলকাতাও। চীনের পেইচিং, তানজিং ছাড়াও সাংহাইয়ে আছে এ পরিবহনব্যবস্থা। ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকায় তিনটি পথে মেট্রো রেল চালুর সুপারিশ করা হয়েছিল। তার মধ্যে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে পল্লবী হয়ে রোকেয়া সরণি-খামারবাড়ী-ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে পর্যন্ত (এমআরটি-৬) নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। গত নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে সেবা লাইন স্থানান্তরের কাজ। প্রকল্প পরিচালক মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘২০১৯ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে ফার্মগেট অংশ চালু করতে চাইছি আমরা।’ মেট্রো রেল চালু হলে ঘণ্টার ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। ঢাকায় আরো চারটি রুটে মেট্রো রেল চালুর জন্য যাচাই-বাছাই চলছে।
রাজধানীর গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বাস চলাচলের জন্য আলাদা লেন বিআরটি চালু হতে যাচ্ছে ২০১৮ সালে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ডিপো নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। সওজ অধিদপ্তর, এলজিইডি ও বাংলাদেশ সেতু বিভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পে ব্যয় হবে দুই হাজার ৩৯ কোটি টাকা। ২০.৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বিশেষ লেনে ২৫টি স্টেশন ও দুটি টার্মিনাল থাকবে। একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাতায়াতে লাগবে ৫০ মিনিট।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ছাড়াও এক্সপ্রেসওয়ে হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ছয় লেন এক্সপ্রেসওয়ের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। মদনপুর থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেটের আগে সলিমপুর পর্যন্ত ২১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এক্সপ্রেসওয়েটি। প্রকল্পে ব্যয় হবে ২৮ হাজার কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুল-উল-আলম বলেন, ২০১৮ সালে শুরু করে ২০২২ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে দ্রুত গণপরিবহন পদ্ধতি, এক্সপ্রেসওয়ের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। ইলেকট্রিক ট্রেন, বুলেট ট্রেন বহু আগেই বিভিন্ন দেশে চালু হয়েছে। এগুলোও চালু করতে হবে। শুধু করলেই হবে না, সে জন্য লাগবে পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতা। ভারতে ১৬টির বেশি এক্সপ্রেসওয়ে আছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায়ও আছে। আমাদের দেশে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মাত্র। বলা যায়, আধুনিক পরিবহন ও মহাসড়ক ব্যবস্থার সূচনা হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে।
সম্পর্কিত খবর

মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৪৮%, বেড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি
নিজস্ব প্রতিবেদক

বহুদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা। প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে। তবে অবশেষে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে ৮.৪৮ শতাংশে, যা গত ৩৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে এই চিত্র উঠে এসেছে। ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.০৫ শতাংশ, জুনে তা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
মূল্যস্ফীতির এই পতন দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তির বার্তা বয়ে আনলেও বাজারের বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
খাদ্যমূল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে
বিবিএসের ভোক্তা মূল্যসূচক অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুনে নেমে এসেছে ৭.৩৯ শতাংশে, যা মে মাসে ছিল ৮.৫৯ শতাংশ।
তবে বাজারের চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। ঢাকার খুচরা বাজারে মিনিকেট চালের দাম বেড়ে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা/কেজিতে পৌঁছেছে, যেখানে ঈদের আগে তা ছিল ৭২ থেকে ৮২ টাকা। মাঝারি মানের চাল ব্রি‑২৮ এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৪ টাকা কেজি দরে, যা আগের তুলনায় তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন সবজির দাম ৭০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।
আয় বেড়েছে কম, ব্যয় বেড়েছে বেশি
মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনে এক ধরনের ‘অদৃশ্য কর’-এর মতো। বিশেষ করে মজুরিনির্ভর মানুষের ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে। বিবিএসের তথ্য মতে, জুনে জাতীয় মজুরি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.১৮ শতাংশে, কিন্তু একই সময়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮.৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ আয় বৃদ্ধির চেয়ে ব্যয় বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় প্রকৃত আয় কমেছে।
প্রবৃদ্ধিতে ফিরছে গতি
মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) স্থির মূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪.৮৬ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৪.৪৮ শতাংশ।
তবে পুরো অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) প্রথম তিন প্রান্তিক মিলিয়ে গড় প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৮১ শতাংশ। এই ধীরগতির প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সতর্কবার্তা আগেই দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বিশ্বব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৩ শতাংশ, আর এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী এটি ৩.৯ শতাংশ।
প্রবৃদ্ধির খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাত কিছুটা উন্নতি করলেও গতি কমেছে শিল্প খাতে। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.৪২ শতাংশ, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৪ শতাংশ। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.৯১ শতাংশে, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৭.১০ শতাংশ। সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক ভালো—৫.৮৮ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৪.৩১ শতাংশ। চলতি মূল্যে এই প্রান্তিকে জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১২ লাখ ৬৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি পরিসংখ্যান বলছে মূল্যস্ফীতি কমেছে, প্রবৃদ্ধিও কিছুটা বাড়ছে। তবে বাজারে এর প্রতিফলন নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী, মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে, ফলে মানুষের বাস্তব আয়ে ঘাটতি রয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
শেখ হাসিনা-কামালকে অব্যাহতির আরজি মামুনের বক্তব্য নেই
নিজস্ব প্রতিবেদক

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক উপাদান (প্রাইমা ফেসিয়া) পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্র নিযু্ক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। মামলার অভিযোগ থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার আরজি জানান তিনি।
এ সময় আদালতে উপস্থিত আরেক আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেননি এবং অভিযোগ থেকে তাঁর অব্যাহতিও চাওয়া হয়নি।
গতকাল সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ অভিযোগ গঠনের শুনানি চলাকালে আমির হোসেন ওই আরজি তুলে ধরেন।
শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল আগামী ১০ জুলাই আদেশের তারিখ ধার্য করেন। এর আগে গত ১ জুলাই মামলার ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের’ ওপর শুনানি শেষ করে প্রসিকিউশন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন : দাবি আইনজীবীর
অব্যাহতির আবেদনের শুনানিতে আমির হোসেন প্রসিকিউশনের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, গত বছর ১৪ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা রাজাকারের নাতি-পুতি বলে উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য দেননি। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। সেই জবাবেও তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা রাজাকারের নাতি-পুতি বলেননি।
আন্দোলনে নিহতদের মৃত্যু সনদে মৃত্যুর সঠিক কারণ লিখতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, মৃতদেহ হস্তান্তর না করে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গণদাফন, লাশ গুম করে ফেলার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মনগড়া বলে উল্লেখ করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী। তিনি বলেন, এসব অভিযোগের দালিলিক কোনো প্রমাণ নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানিতে প্রসিকিউশন বলেছিল, জুলাই গণ-আন্দোলন চলার সময় বিটিভি ভবন, মেট্রো রেলসহ কেপিআইভুক্ত (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয়েছে। এই অভিযোগও অস্বীকার করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় গত বছর ১৬ জুলাই রংপুরে গুলিতে শহীদ হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এই হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধ প্ররোচনা, সহায়তা ও ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা অস্বীকার করে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ আবু সাঈদের মা-বাবা, ভাই-বোনদের গণভবনে এনে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন। ফলে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।
গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এই আইনজীবী বলেন, আন্দোলনের সময় পুলিশ মানুষের জানমাল রক্ষার স্বার্থে দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আন্দোলনে বহু মানুষ হতাহত হওয়ার নজির আছে। কিন্তু এর জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে কোনো দেশ বিচার করেছে—এমন নজিরও নেই।
জুলাই গণ-আন্দোলনে আসামিদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটিকে মিথ্যা দাবি করে আমির হোসেন বলেন, গণ-আন্দোলনের সময় এবং সরকার পতনের পরে দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালানো হয়েছে, থানা লুট করা হয়েছে। এমনকি পুলিশ হত্যা করা হয়েছে। ফলে পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মনগড়া। পরে তিনি অভিযোগ থেকে তাঁদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) অব্যাহতি দেওয়ার আরজি জানান।
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ১৪ আগস্ট সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিল করা হয়। তদন্ত শুরু হয় গত বছর ১৪ অক্টোবর। ছয় মাস ২৮ দিনে তদন্ত শেষে গত ১২ মে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আসামিদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়সহ হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ব্যপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। গত ১ জুন প্রসিকিউশন ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ দাখিল করলে তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।

মানবতাবিরোধী অপরাধ
চলতি বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলার বিচার
মেহেদী হাসান পিয়াস

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, এর মধ্যে অন্তত চারটি মামলার বিচারকাজ চলতি বছর শেষ হতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। চারটি মামলার অভিযোগই আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। তবে মামলার তদন্ত ও বিচারে সময় নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে ভুক্তভোগী এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের।
চার মামলায়ই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। তিনিসহ এই চার মামলায় মোট আসামি ৫৭ জন। তাঁদের মধ্যে পলাতক ৪১ জন। গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে ১৬ জনকে।
এ ব্যাপারে প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চারটি মামলা আনুষ্ঠনিক অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। তার মধ্যে দুটি মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করলে বিচার হবে। অভিযোগ থেকে আসামিদের অব্যাহতি দিলে মামলা ওইখানেই শেষ।
বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে আইনি বিধান তুলে ধরে এই প্রসিকিউটর বলেন, ‘আইনে আছে, অভিযোগ গঠনের পর বিচার শুরু হলে তা চলবে বিরতিহীনভাবে। কোনো পক্ষ মুলতবির আবেদন করতে পারবে না।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় বা তদন্ত সংস্থায় লিখিত অভিযোগ দিতে হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে মামলা হিসেবে তা নথিভুক্ত করে তদন্ত সংস্থা। এরপর অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। চিফ প্রসিকিউটর সেই তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই, পর্যালোচনা করে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। পরে এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণ করে তা আমলে নিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর। অভিযোগ আমলে নেওয়া হলে আসামিদের বিরুদ্ধে ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যে চার মামলার অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থান চলার সময় পরিকল্পিতভাবে ড্রোন, হেলিকপ্টার, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের পদ্ধতিগতভাবে নির্মূলের অভিযোগ রয়েছে একটি মামলায়। মামলাটি ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে দায় বা ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এই মামলার আসামি। তাঁদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে রাখা হয়েছে। অন্য দুজন পলাতক। এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর উভয় পক্ষের শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ১০ জুলাই আদেশের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ঘটনা ও অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় বাকি তিনটি মামলাও বেশ আলোচিত।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলাটিকে ‘আবু সাঈদ হত্যা মামলা’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। গত ৩০ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১০ জুলাই এ মামলায় পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। এ মামলার ৩০ জন আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার চারজন। বাকি ২৬ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলাটিকে বলা হচ্ছে ‘চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ড’ মামলা। সরকার পতনের আন্দোলন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন ছয় তরুণ। গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশ তাঁদের গুলি করে হত্যা করে। সেদিন শহীদ হন শাহরিয়ার খান আনাস, শহীদ শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, শহীদ মো. ইয়াকুব, শহীদ মো. রাকিব হাওলাদার, শহীদ মো. ইসমামুল হক ও শহীদ মানিক মিয়া। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ছয় মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে গত ২০ এপ্রিল প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এটিই ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। গত ২৫ মে এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। গত ৩ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি শেষ হয়। আগামী ১৪ জুলাই এ বিষয়ে শুনানির তারিখ ধার্য করা রয়েছে। মামলার আট আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে চারজনকে।
আশুলিয়ায় মৃতপ্রায় একজন ও পাঁচজনের লাশ পোড়ানোর মামলাটি ‘লাশ পোড়ানোর’ মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গত ১৯ জুন চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় তদন্ত সংস্থা। গত ২ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেদিনই তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার ১৬ জন আসামির মধ্যে ট্রাইব্যুনালে ১১ জনের নাম প্রকাশ করে প্রসিকিউশন। এই ১১ জনের মধ্যে আটজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে।
প্রত্যাশার সঙ্গে আছে হতাশা
মামলার তদন্তকাজ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করলেও বিচার নিয়ে আশাবাদী শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা এই বিচারটা দেখতে পাব এবং ন্যায়বিচার পাব। কিন্তু তদন্তেই দীর্ঘ সময় লাগল। তার পরও বলতে চাই, যারা আবু সাঈদ হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের সবার বিচার চাই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কাউকে যেন এ মামলায় যুক্ত না করা হয়।’
শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় দেশ পলিটেকনিক কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হাসান আলভীর। পরে ১৯ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন শহীদ আলভীর বাবা মো. আবুল হাসান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘অভিযোগটি কী পর্যায়ে আছে, জানি না। গত সপ্তাহেও আমি প্রসিকিউশনে গিয়েছিলাম। গেলে শুধু একটা কথাই বলে, কাজ করছি, বিচার হবে। কিন্তু আদৌ বিচার হবে কি না—জানি না। আসামিরা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে আমরা হতাশায় ভুগছি।’
মামলার বাদী এবং শহীদ পরিবারগুলোর জন্যও বিশেষ নিরাপত্তার দাবি জানান আবুল হাসান।
প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, এই অভ্যুত্থানের সময় দেশজুড়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে ২৭টি পর্যন্ত মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার এসএসসির ফল প্রকাশের প্রস্তাব
নিজস্ব প্রতিবেদক

আগামী ১০ জুলাই বৃহস্পতিবার এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রস্তাব করেছে আন্ত শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি। এরই মধ্যে এই প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে সম্মতি পেলে ফল প্রকাশ করা হবে।
আন্ত শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহবায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী ১০ জুলাই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাধারণত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা হয়ে থাকে। গত ১০ এপ্রিল সারা দেশে একযোগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়।
জানা গেছে, এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট শিক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন। এর মধ্যে সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১৪ লাখ ৯০ হাজার ১৪২ জন। অন্যদিকে মাদরাসা বোর্ডের অধীন দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে দুই লাখ ৯৪ হাজার ৭২৬ জন। আর কারিগরি বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৩১৩ জন।