গদ্য
অভাগীর স্বর্গ
শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অনুধাবনমূলক প্রশ্ন
১। কাঙালীর মায়ের নাম অভাগী রাখা হয়েছিল কেন?
উত্তর : জন্মের সময় মা মরে যাওয়ায় কাঙালীর মায়ের নাম অভাগী রাখা হয়েছিল।
‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে দেখা যায় যে অভাগীর বাবা অভাগীর এই নাম রেখেছিলেন। অভাগীর যখন জন্ম হয়, তখন তার মা মারা যায়।
ফলে বাবা রাগ করে মা-মরা মেয়ের নাম রাখেন অভাগী। মূলত মা মরা মেয়ে হওয়ার কারণেই তার নাম অভাগী রাখা হয়েছিল।
২। মরণকালে স্ত্রীকে পায়ের ধুলো দিতে গিয়ে রসিক কেঁদে ফেলল কেন?
উত্তর : অভাগীকে পায়ের ধুলা দিতে গিয়ে তার প্রতি নিজের অবহেলার অনুশোচনায় রসিক দুলে কেঁদে ফেলল।
রসিক দুলে অভাগীকে ফেলে আরেকটা বিয়ে করে অন্য গ্রামে চলে গিয়েছিল। কিন্তু অভাগী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে একাই গ্রামে থেকে যায়। মৃত্যুকালে সে সেই স্বামীর পায়ের ধুলা নিতেই ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু যে স্ত্রীকে রসিক দুলে ভাত-কাপড় দেয়নি; কখনো যার খোঁজখবর নেয়নি; তার এই পতিভক্তি রসিক দুলেকে অনুশোচনায় পোড়ায়।
এ জন্য পায়ের ধুলা দিতে গিয়ে সে গভীর কষ্টে কেঁদে ফেলে।
৩। দারোয়ান রসিক দুলেকে চড় মারল কেন?
উত্তর : রসিক দুলে অনুমতি ছাড়া বেলগাছ কাটতে যাওয়ায় দারোয়ান তাকে চড় মারল।
অভাগী মৃত্যুর সময় কাঙালীর হাতের আগুন পাওয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করে গেছে। তার সৎকারের জন্য কাঠ প্রয়োজন ছিল।
রসিক দুলে স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য বাড়ির উঠানের বেলগাছটা তাই কাটতে গিয়েছিল। কিন্তু সামন্তবাদী নিয়মে জমিদারের অনুমতি ছাড়া সে গাছ কাটতে পারবে না। এমনকি নিজ বাড়ির আঙিনায় নিজ হাতে পোঁতা হলেও নয়। এ জন্য বেলগাছটি কাটতে গেলে দারোয়ান তাকে চড় মেরে বসে।
৪। অভাগী একটু দূরে থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখল কেন?
উত্তর : অভাগী ছোট জাতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় একটু দূরে থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখল।
অভাগী ছিল দুলে সম্প্রদায়ের নারী। তাদেরকে সমাজে ছোট জাত মনে করা হয়। সমাজের সৃষ্ট এই কুসংস্কারের কারণে ছোট জাতের লোকেরা কখনো উঁচু জাতের মানুষের কাছে আসতে সাহস করে না। গল্পের অভাগী ছিল নীচু জাতের আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হচ্ছিল উঁচু জাতের মানুষের। তাই অভাগী একটু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখল।
৫। কাঙালী তার মাকে আগুন দিতে পারল না কেন?
উত্তর : সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুরতার কারণে কাঙালী তার মাকে আগুন দিতে পারল না। কাঙালীর মায়ের শখ ছিল মৃত্যুর পর মুখুয্যে বাড়ির গিন্নির মতো ছেলের হাতের আগুন পাওয়ার। কিন্তু তার মৃত্যুর পর ছেলে কাঙালী মায়ের সেই আশা পূরণ করতে পারে না। কাঙালীরা নীচু জাতের মানুষ হওয়ায় সামন্তবাদী সমাজে মৃতদেহ সৎকারে আগুন দেওয়ার নিয়ম নেই। তবু কাঙালী তার মৃত্যু মাকে আগুন দেওয়ার জন্য কাঠ সংগ্রহের চেষ্টা করলে সকলেই তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। জমিদারের গোমস্তা ঘুষ চায়, যা কাঙালীর সামর্থ্য নেই। অবশেষে বাধ্য হয়ে কাঙালী অভাগীকে নদীর চড়ায় পুঁতে ফেলে।
৬। ‘সে যেন একটা উৎসব বাধিয়া গেল।’—লেখক এ কথা বলেছেন কেন?
উত্তর : ঠাকুরদাস মুখুয্যের স্ত্রীর মৃত্যুতে বাড়িতে স্বজনদের উপস্থিতিতে সৃষ্ট অবস্থা বর্ণনায় লেখক প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছেন।
‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে ঠাকুরদাস মুখুয্যে একজন পয়সাওয়ালা লোক। তার স্ত্রীর মৃত্যুতে বাড়িতে অনেক লোকজন উপস্থিত হয়েছে। ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতি, এলাকার মানুষ সবাই বর্ষীবয়সী গিন্নির লাশ দেখতে এসেছে। আর এত মানুষের উপস্থিতিতে বাড়ি গমগম করছিল। তাই লেখক বলেছেন, ‘সে যেন একটা উৎসব বাধিয়া গেল।’
৭। ‘দুলের মড়ার কাঠ কী হবে শুনি?’—অধর রায় এ কথা কেন বললেন?
উত্তর : সামন্তবাদী চেতনার ধারক হওয়ায় অধর রায় প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছেন।
‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে সামন্তবাদী সমাজবাস্তবতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে কাঙালী মায়ের মৃতদেহ সৎকারের জন্য কাঠ পাওয়ার আশায় বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দেয়। কিন্তু সবাই তাকে নিরাশ করে। কারণ কাঙালীরা দুলে। আর দুলেরা নীচু জাত হওয়ায় সমাজপতিদের মতে তাদের মড়া পোড়ানোর প্রয়োজন নেই। এমন বর্ণবাদী চেতনা পোষণ করার কারণেই অধর রায় কাঙালীকে উদ্দেশ করে প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেন।
৮। বামুন ঠাকরুণের শ্মশান সৎকারের শেষটুকু দেখা অভাগীর ভাগ্যে আর ঘটল না কেন?
উত্তর : কাঙালীর সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসায় বামুন ঠাকরুণের শ্মশান সৎকারের শেষটুকু দেখা অভাগীর ভাগ্যে আর ঘটল না।
অভাগী ঠাকুরদাস মুখুয্যের স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দূর থেকে দেখছিল। সে ছোট জাতের হওয়ায় নিজেরও অমন করে স্বর্গে যাওয়ার বাসনা নিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখছিল। কিন্তু শেষবেলা কাঙালী এসে তাকে ডাকায় এবং ক্ষুধার কথা বলায় তাকে তখনই বাড়িতে ফিরতে হয়। তাই শ্মশান সৎকারের শেষটুকু তার আর দেখা হয় না।
৯। ‘তোর হাতের আগুন যদি পাই, আমিও সগ্যে যাব’—উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : ‘তোর হাতের আগুন যদি পাই, আমিও সগ্যে যাব’— মা গভীর ধর্মবিশ্বাস থেকে কাঙালীকে এ উক্তিটি করেছিল।
মুখুয্যে বাড়ির গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুর পর সৎকারের দৃশ্য দেখে অভাগীর ভেতরে একধরনের ভাবানুভূতির সৃষ্টি হয়। মৃতের শবযাত্রার আড়ম্বরতা ও সৎকারের ব্যাপকতা দেখে অভাগী বিস্মিত হয়। সে ভাবে, তার মৃত্যুর সময় স্বামীর পায়ের ধূলি নিয়ে মৃত্যুর পর পুত্র কাঙালী মুখাগ্নি করলে সেও স্বর্গে যাবে। তাই অভাগী তার সেই শেষ ইচ্ছার কথাই সন্তানের কাছে বলে।