আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ভূমিকা : ‘চেতনার পথে দ্বিধাহীন অভিযাত্রী
নানামুখী হাজার লোকের একত্র অস্তিত্ব একুশে ফেব্রুয়ারি।’
—কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ
একুশ মানে মাথা নত না করা, একুশ মানে স্বাধীনতার দাবিদার, বাঙালির চাওয়া বাংলা ভাষার অধিকার। তাই বাংলা ভাষার ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতিসত্তা ও জাতীয় ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল দিন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম মাইলফলক। এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি যুগপত্ভাবে বেদনার অশ্রু আর প্রেরণার আনন্দে ভাস্বর।
একুশ আমাদের জাতীয় অহংকার। এই দিবসটি এখন শুধু আমাদের ভাষাশহীদ দিবসই নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও বটে। নিজের মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পৃথিবীতে কোনো দেশের মানুষকে বাঙালির মতো বুকের রক্ত দিতে হয়নি। তাইতো বাঙালির শোকের, ব্যথার এই একুশে ফেব্রুয়ারিকে সম্মানের সঙ্গে ইউনেসকো স্বীকৃতি দিয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। ফলে এ দিবসের অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে।
মাতৃভাষার গুরুত্ব : আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে এ ভাষার ব্যবহার চলে আসছে। এ ভাষায় আমরা সহজেই মনের ভাব প্রকাশ করি।
কবি নিধিগুপ্তের ভাষায়—
‘নানান দেশের নানান ভাষা
বিনে স্বদেশী ভাষা
মিটে কি আশা?’
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এ ব্যাপারে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ভাষায় কাব্যসাহিত্য রচনা করে ১৯১৩ সালে পেয়েছেন সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ। কাজেই বাংলা আমাদের গর্বের ভাষা।
ভাষা আন্দোলনের মূল ঘটনা/পটভূমি : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যা ছিল গোটা দেশের জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। স্বাভাবিক কারণে বাঙালিরা আশা করেছিল, পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা।
বাংলা ও উর্দু এই দুই ভাষায়ই কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্ম চলবে, শিক্ষার মাধ্যম হবে পূর্ববঙ্গে বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু অথবা ওই অঞ্চলের প্রাদেশিক ভাষা। কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হয়ে যায় কেন্দ্রীয় সরকারের কতিপয় সিদ্ধান্তে। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের মতো একই ঘোষণা দিয়েছিলেন—‘Urdu and only urdu, shall be the state language of Pakistan.’ অর্থাৎ ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ, বিশেষ করে দামাল ছেলেরা তা মেনে নেয়নি। কারণ তাদের চেতনা কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতার খোকার মতো ছিল—
‘মাগো ওরা বলে,
সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না।
বলো মা, তাই কি হয়?’
আর তাইতো তাদের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদ করেছে, মিছিল করেছে, সভা-সমাবেশ করেছে। আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে ১৯৫২ সালে গঠন করেছে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। পাকিস্তানিরা ভয় পেয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে জারি করেছে ১৪৪ ধারা। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমেছে। ওই দিন বিকেল ৩টার দিকে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করেছে। তারপর গুলি চালাতে শুরু করেছে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে। আহত হয়েছেন অনেকে। সারা দেশের মানুষের তীব্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছে।
শহীদ মিনার : ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে সমবেত হয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। তাঁরা আবাসিক হলের গেট দিয়ে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হলে আকস্মিকভাবে তাঁদের ওপর অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয় এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। এতে বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেক ছাত্র-যুবক মর্মন্তুদভাবে শহীদ হন। শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা রাতারাতি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ শফিউর রহমানের বাবা এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। ২৬ তারিখ বিকেলে পুলিশ শহীদ মিনারটি ধ্বংস করে দেয়। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও রাতে আবার শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।
একুশের আন্তর্জাতিক মর্যাদার প্রথম দাবি : একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণ করা বাঙালির কাছে যেন খুব পরিচিত কোনো এক উৎসব। একুশ তাই এ দেশের মানুষের চেতনার গভীরে গ্রোথিত। তবে আত্মগত অনুভবে নিজ ভূখণ্ডের সীমাকে ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও এর মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানায় প্রথম ‘গফরগাঁও থিয়েটার’ নামের এক সংগঠন। তারা ১৯৯৯ সালে ‘অর্ঘ্য’ নামের সংকলনের প্রচ্ছদে লেখে—
‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস চাই
২১শের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই।’
একই বছরে গফরগাঁওয়ের নাট্যকর্মীরা একুশের বিশ্ব মর্যাদা দাবি করে শোভাযাত্রা করে। শহরের দেয়ালে পোস্টার লাগায় এবং বাসে ও ট্রেনে স্টিকার লাগায়। ৩০ নভেম্বর ১৯৯৯ তারিখে ‘The Daily Bangladesh Observer’ পত্রিকা চুয়াডাঙ্গা থেকে ইনামুল হকের একটি চিঠি প্রকাশ করে। চিঠিতে ইনামুল হক দাবি করেন—১৯৯৮ সালের ২৫ মার্চ তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দানের আহ্বান জানিয়ে প্রথমে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধানভাবে ফল বয়ে এনেছিল কানাডার বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা প্রেমিক গ্রুপের উদ্যোগেই। তাই পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা ‘শৈলী’ ১৯৯৯ সালে পঞ্চম বর্ষ ১৯ সংখ্যায় (১৬-২৯ ফেব্রুয়ারি) সম্পাদকীয়তে লিখেছে—‘১৯৫২ সালের সংগ্রাম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে জয়ী হয়ে বাঙালি পৃথিবীর সকল জাতির সেরা জাতি হিসেবে মর্যাদাবান হয়েছে।’
[বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়]