বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিংসহ রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি খাতে দুর্নীতি ও লুটপাট অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। বিশেষ করে শিক্ষা খাতে শুধু দুর্নীতিই নয়, আরো বহু অব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। ভুলে ভরা পাঠ্যবই এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি শিক্ষার্থীদের মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। আশা করা হয়েছিল, ব্যাপক রক্তক্ষয়ী জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা হবে এবং ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে।
কিন্তু পরিস্থিতি বলছে, সেই আশার বাস্তবায়ন এখনো সুদূরপরাহত।
গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও শিক্ষা খাতের দুর্নীতিতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপানোর ক্ষেত্রে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করে শতকোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। পাঁচ মাস পেরোতে না পেরোতেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো কিছু বই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
আরো উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষেও মানহীন বই ছাপার প্রস্তুতি চলছে। প্রেস মালিকদের অসাধু চক্র, বিশেষ করে যাদের সঙ্গে পতিত সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংযোগ ছিল (যেমন আনন্দ প্রিন্টার্সের মালিক রব্বানি জব্বার, যিনি একজন মন্ত্রীর ভাই এবং চেয়ারম্যান ছিলেন), তারা এখনো সক্রিয় রয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে শিক্ষা খাতে দুর্নীতির চক্র এবং তার শিকড়-বাকড় অক্ষুণ্নই রয়ে গেছে।
এনসিটিবির ৩২টি টিমের ৬৪টি জেলা থেকে পাঠানো প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৩৩ শতাংশ বা প্রায় ১৩ কোটি বই নিম্নমানের, যেখানে জিএসএম, ঔজ্জ্বল্য, বাঁধাই—কোনো কিছুই ঠিক নেই।
এর পেছনে শতকোটি টাকা অতিরিক্ত লোপাট করা হয়েছে। লেটার এন কালার লি., অনুপম প্রিন্টার্স, অক্সফোর্ড প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনসহ বহু প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত মানের চেয়েও নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করেছে। শতকোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগের বিপরীতে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে কেবল ২০ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হাস্যকর। এটি দুর্নীতির প্রতি এক ধরনের নীরব সম্মতিকে ইঙ্গিত করে। নিম্নমানের বই এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বারবার কারিকুলাম পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। এটি বিস্ময়কর। যেখানে শিক্ষার মান, কারিকুলাম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং দুর্নীতির মতো মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে গভীর সংস্কার প্রয়োজন, সেখানে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হতাশাজনক। এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে কেবল সরকার পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য। শিক্ষা খাতকে দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে এবং একটি মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি।