প্রায় দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি সহিংস সংঘাত অব্যাহত আছে। এর মধ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে শুরু হওয়া পাল্টাপাল্টি সামরিক হামলা মধ্যপ্রাচ্যের সমগ্র অঞ্চল তো বটেই, বিশ্বজুড়েই এক গভীর উদ্বেগ জন্ম দিয়েছে। একদিকে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, অন্যদিকে ইরানও ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাল্টা জবাব দিয়েছে। এই হামলা-পাল্টা হামলার চক্রটি শুধু সামরিক ক্ষয়ক্ষতি দিয়েই নয় বরং মানবিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং ভূ-রাজনৈতিক অচলাবস্থার শঙ্কাকে উসকে দিয়েছে।
সংযম প্রদর্শন করতে হবে
- ইসরায়েল-ইরান পাল্টাপাল্টি হামলা

এই সংঘাতের প্রত্যক্ষ প্রভাব হিসেবে দেখা যাচ্ছে ব্যাপক প্রাণহানি এবং অবকাঠামোগত ক্ষতি। তেহরানে আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ইসরায়েলেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছেন। প্রতিটি জীবনহানিই মানবজাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
অর্থনৈতিকভাবে এই সংঘাতের প্রভাব এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে পড়া শুরু করেছে। ইরানে ইসরায়েলের হামলার পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম ৯ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে, যা প্রায় পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন পথ হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। তেলের দামের এই ঊর্ধ্বগতি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংঘাত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য এক গুরুতর হুমকি। যুক্তরাষ্ট্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। ইসরায়েলের এই হামলা গাজা সংকটকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগকে সরাসরি উপেক্ষা করেছে।
জাতিসংঘের পারমাণবিক তদারকি সংস্থা আইএইএর প্রধানের সতর্কতা যে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা ‘ভয়াবহ পরিণতি’ ডেকে আনতে পারে, যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া এবং তিনটি দেশের আকাশসীমা বন্ধ হওয়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টানাপড়েন এবং নিরাপত্তার ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়।
ফিলিস্তিন ইস্যু এবং গাজার চলমান মানবিক বিপর্যয়, গণহত্যা ও ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ অবস্থান এই সমগ্র পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। একদিকে গাজায় ইসরায়েলের অবিরাম হামলায় মানবিক সংকট চরমে, অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে নতুন এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যকে এক ভয়াবহ আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতি এই অস্থিরতার মূল কারণ হিসেবে বারবার উঠে আসছে।
জাতিসংঘ, বাংলাদেশ, চীন, রাশিয়া, কাতার, ওমান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপানসহ অনেক দেশ হামলার নিন্দা এবং সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহবান জানিয়েছে। এই মুহূর্তে সব পক্ষকে সংঘাত বন্ধ করে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসা অত্যন্ত জরুরি। সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ সমাধানই পারে এই অঞ্চলের অস্থিরতা দূর করতে এবং বিশ্বকে এক বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে।
সম্পর্কিত খবর

জননিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
- আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি

দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাহাজানি, খুনখারাবি ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। বাড়ছে কিশোর গ্যাং নামে জীবন অতিষ্ঠকারী অপরাধচক্রের সংখ্যা। মানুষ এখন নিজের ঘরবাড়িতেও নিরাপদ নয়।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত অপর এক খবরে দেখা যায়, রাজধানীতে কিশোর গ্যাং সদস্যরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ গত বুধবার এক ঘণ্টার ব্যবধানে মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় দুজনকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মানুষ একবেলা কম খেয়ে হলেও নিরাপদে ও মানসম্মান নিয়ে জীবনযাপন করতে চায়। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেবে।

পুনরাবৃত্তি যেন না হয়
- গোপালগঞ্জে সহিংসতা

গোপালগঞ্জ শহরে এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত বুধবারের হামলা-সংঘর্ষের পর থেকে কিছু সময়ের বিরতি দিয়ে কারফিউ চলছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কারফিউ চলমান থাকবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যৌথ বাহিনী গতকাল রাত পর্যন্ত অন্তত ২৫ জনকে আটক করেছে।
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক দলসহ নানা মহল থেকে নিন্দা ও প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্ত ও সমর্থকদের হামলায় হতাহতের ঘটনায় গভীর নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি এই ঘটনাসহ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার সঙ্গে আসন্ন নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র কাজ করছে বলেও মনে করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুধীমহল।
গোপালগঞ্জের এই ঘটনায় অন্যান্য বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সেনাবাহিনী অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর যে ভূমিকা নিয়েছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে জাতীয়তাবাদী যুবদল আয়োজিত সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘এখন গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখানো হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে ইস্যু সৃষ্টি করে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী দল বিএনপিকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘আমরা জুলাই ছাত্র-অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছিলাম ডেমোক্রেসির জন্য। এখন দেখতে পাচ্ছি সারা দেশে ডেমোক্রেসির পরিবর্তে মবক্রেসির রাজত্ব চলছে।’
আমরা চাই গোপালগঞ্জে হামলার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। পাশাপাশি এই ঘটনার সঙ্গে ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের যেসব অভিযোগ উঠছে, সেগুলো জাতির সামনে স্পষ্ট করা হোক। এমন সহিংসতার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সে জন্য গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হবে।

বৈষম্য কাম্য নয়
- নারী শহীদদের পরিবারে হাহাকার

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরশাসনের পতন হয়েছিল। আর এই অভ্যুত্থানের সাফল্যের পেছনে আছে অনেক করুণ কাহিনি। অনেক রক্ত ঝরেছে। অনেক মা তাঁর সন্তান হারিয়েছেন, ভাই বোন হারিয়েছে, সন্তান মা-বাবা হারিয়েছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন রিতা আক্তার (১৮)। বাবা রিকশা চালিয়ে আর মা বাসাবাড়িতে কাজ করে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গত বছর ৫ আগস্ট তিনি যোগ দিয়েছিলেন ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে।
অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে এখন এক ধরনের কাড়াকাড়ি চলছে। কিন্তু আসল কৃতিত্ব যাঁদের, যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের পরিবারগুলো কেমন আছে সেই খোঁজ কজন রাখেন? যে বৈষম্য বিলোপে এত আত্মত্যাগ, আমরা চাই না শহীদদের পরিবারগুলো সেই বৈষম্যের শিকার হোক।

জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করুন
- গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলা

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্বনির্ধারিত পদযাত্রা ও সমাবেশে হামলার ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে পতিত হলেও স্বৈরাচারের চরিত্র পাল্টায়নি। তাদের হামলায় বুধবার গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গাড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলা হামলা-সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন।
গোপালগঞ্জে এনসিপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বুধবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয় এবং হামলাকারীদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়।
প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের গাড়িবহর গোপালগঞ্জে পৌঁছার আগেই সকাল সাড়ে ৯টায় সদর উপজেলার উলপুর-দুর্গাপুর সড়কের খাটিয়াগড় চরপাড়ায় ছাত্রলীগের কর্মীরা পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন তিন পুলিশ সদস্য হামলার শিকার হন। সকাল ১১টায় টেকেরহাট সড়কের কংশুরে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িতেও হামলা চালালে গাড়িচালক মো. মইন আহত হন। কেন্দ্রীয় নেতারা দুপুর ২টার পর সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন এবং সমাবেশ শুরু হয়। বিকেল পৌনে ৩টায় সমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিছু সশস্ত্র ব্যক্তি নেতাকর্মীদের ওপর হামলার চেষ্টা চালায়।
গোপালগঞ্জের ঘটনায় আবারও প্রমাণ হলো দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কতটা জরুরি। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সেনাবাহিনী গোপালগঞ্জের সহিংসতাকে যেভাবে মোকাবেলা করেছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাদের সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে এনসিপির নেতাকর্মীরা রক্ষা পেয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।
নিকট অতীতে দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। মতপ্রকাশের অধিকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল। দেশের সম্পদ লুটপাট করা হয়েছিল। আর এসব কারণে গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেশের মানুষ একযোগে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। দেড় দশকের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছিল। তারা আবারও নানাভাবে মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। দেশে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। এসব অপচেষ্টা প্রতিরোধে দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।