অর্থনীতিতে ডলারের ঊর্ধ্বগতি এবং রাজস্ব খাতের অচলাবস্থা উভয়ই গভীর উদ্বেগের কারণ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশনে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার কার্যকরের পর থেকে ডলারের দাম বাড়ছে। আন্ত ব্যাংক ও খোলাবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সামনে এর দর স্থিতিশীল রাখা বড় চ্যালেঞ্জ।
জোড়া সংকটে অর্থনীতি
- ডলারে ঊর্ধ্বগতি ও রাজস্বে স্থবিরতা

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মানি এক্সচেঞ্জগুলোর নোটিশ বোর্ডে প্রতি ডলারের বিক্রয়মূল্য ১২৪ টাকা লেখা থাকলেও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু জায়গায় ডলার পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে ১২৭ টাকায়।
অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন রাজস্ব খাতকে প্রায় অচল করে দিয়েছে। এনবিআর দুই ভাগ করে অধ্যাদেশ জারির প্রতিবাদে এই কর্মবিরতি পালন করা হচ্ছে, যা আমদানি-রপ্তানি, শিল্প উৎপাদন এবং ভোগ্যপণ্যের বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
আশার কথা, আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের উদ্বেগ এবং অধ্যাদেশ বাস্তবায়নে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এনবিআর বিভক্তি সংক্রান্ত অধ্যাদেশ সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে গত মঙ্গলবারের বৈঠক ফলপ্রসূ না হওয়ায় শনিবার থেকে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হয়েছে।
এই দুটি পরিস্থিতিই দেশের অর্থনীতিকে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের উচিত দ্রুত এই দুটি সংকটের সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে কঠোর নজরদারি এবং অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি রাজস্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে অচলাবস্থা নিরসন করা অত্যাবশ্যক।
সম্পর্কিত খবর

পরিস্থিতি মোকাবেলায় উদ্যোগ নিন
- ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামার আশঙ্কা

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা এখন রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত। আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়টি কার্যকর হবে। কিন্তু শুল্ক কমানোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। গত রবিবার ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক : কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের অন্যতম রপ্তানিকারক ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে আজাদ বলেন, ৪০ বছরের ব্যাবসায়িক জীবনে তিনি রপ্তানি খাতে এমন সংকট কখনো দেখেননি।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। আর তার প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে আরোপিত শুল্কের আংশিক বহনের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু আমাদের লভ্যাংশ এত কম যে শুল্ক শেয়ার করার মতো সক্ষমতাই নেই।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত একটি সমাধানে আসতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।

গণতান্ত্রিক উত্তরণে ঐক্য জরুরি
- রাজনীতি অঙ্গনে বিভক্তি বাড়ছে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। সেই সরকারের এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু যে গণতান্ত্রিক, দুর্নীতিমুক্ত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল, সেই স্বপ্ন এখনো অধরাই রয়ে গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা এবং রাজনীতিকে শুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু করে নানামুখী সংস্কার, কিন্তু সেখানেও রয়েছে বিস্তর মতপার্থক্য।
সার্বিক এই পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবাই একমত হবে—এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং এই সংস্কারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট করে তুলেছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, একটি ভ্রান্ত ধারণা থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং এই সংস্কারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট করে তুলেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ সরকার। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এনসিপি, জামায়াতকে নানাভাবে এই সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে অনেকে মনে করেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অর্জনকে ধরে রাখতে হবে। লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির ঐক্য অত্যন্ত জরুরি। আমরা মনে করি, জনপ্রত্যাশা বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে এগিয়ে যাবে।

দ্রুত নিবন্ধন ও নীতিমালা করুন
- সড়কের বিভীষিকা ইজি বাইক

সড়কে প্রাণহানি বাড়ছে প্রতিদিন। প্রধান কারণ নছিমন, করিমন, আলমসাধু ও ভটভটির মতো দেশীয়ভাবে তৈরি যানবাহন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাটারিচালিত ইজি বাইক ও রিকশা। মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসব তিন চাকার যানবাহন।
বুয়েটের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবাধে এ ধরনের বাহন বেড়ে যাওয়ায় প্রাণহানিও বাড়ছে।
২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে অটোরিকশাসহ তিন চাকার সব বাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। হাইকোর্ট শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিনে নির্মিত এসব যানবাহন বন্ধে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি আদেশ দিলেও এগুলো বন্ধ করা যায়নি। মহাসড়কে চলা এসব বাহনকে নিবন্ধন দেওয়ার জন্য ২০২১ সালের নভেম্বরে খসড়া নীতিমালা করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এতে বলা হয়েছিল, কারিগরি মানোন্নয়নের শর্তে এলাকা ও সড়ক ভেদে এ ধরনের নির্দিষ্টসংখ্যক যানবাহন চলতে পারবে। তবে এগুলোর নিবন্ধন এখনো দেওয়া শুরু করেনি সরকার।
২০১৫ সালে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এসব গাড়ি আমদানি বন্ধের প্রস্তাব করা হয়। তবে কর্মসংস্থান রক্ষার যুক্তিতে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের বিরোধিতায় তা অনুমোদন করা যায়নি। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বিআরটিএর ‘দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়ন কমিটি’র প্রতিবেদনে জানা যায়, সারা দেশে অটোরিকশাসহ কমপক্ষে ১৫ লাখ ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন চলছে। এতে অন্তত ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাই আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা বিবেচনায় এসব যানবাহনকে অনুমতি দিয়ে চালকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা করা যেমন জরুরি, একইভাবে নিরাপদ সড়কও জরুরি। মৃত্যুর মিছিল ক্রমাগত বেড়ে চলাটাও কাম্য নয়। যানজট কমানো এবং সড়কে যানবাহনের গতি রক্ষাও জরুরি। ইজি বাইক নামক যানবাহনগুলোর নিরাপত্তার মানোন্নয়ন ও চালকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এগুলোকে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে।

সংকট কাটাতে উদ্যোগ নিন
- ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা

দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা চরম শঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকটজনক অবস্থায় তাঁরা কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও মূল্যস্ফীতি, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, ঋণের উচ্চ সুদহার, টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি ব্যবসার খরচ ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগ করতেও সাহস পাচ্ছেন না।
চলমান সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে মার্কিন শুল্কনীতি। আগামী ১ আগস্ট থেকে মার্কিন বাজারে পণ্য রপ্তানিতে ৩৫ শতাংশ (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) শুল্ক আরোপিত হবে। এর ফলে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলোকে নিশ্চিতভাবেই বড় ধরনের বিপর্যয় মোকাবেলা করতে হবে।
ব্যবসায় মন্দা এবং বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিও বহুলাংশে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিগত অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশে মূলধনী যন্ত্রের আমদানি কমেছে ১৯.৬ শতাংশ। এতে হয়তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বাড়তে পারে, কিন্তু দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগে যে ধস নামছে, তা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও এক অশনিসংকেত। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্টের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত না হওয়ায় দেশের বিনিয়োগে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। এ সময় কলকারখানা বন্ধ হয়েছে; বেকার হয়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক।’ তিনি আরো বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীল সরকার না হলে ব্যবসা ও বিনিয়োগে স্থিতিশীলতা আসবে না।
শিল্প ও বিনিয়োগের এমন দুরবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে তা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেবে। বেকারত্ব বড় ধরনের সামাজিক সমস্যার কারণ হবে। অর্থনীতির এই পতন ঠেকাতে হবে। আর এ জন্য শিল্প সুরক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে, অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।