রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুরবস্থা সর্বজনবিদিত। এর জন্য মূলত দায়ী করা হয় সংস্থাটির অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে। গতকাল কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কিছু ট্রাভেল এজেন্সি বিমানে টিকিট কালোবাজারি করছে। আর তাদের লোভের মাসুল গুনছে রেমিট্যান্সযোদ্ধা প্রবাসী বাংলাদেশিসহ সাধারণ বিমানযাত্রীরা।
মনিটরিং জোরদার করুন
- সিন্ডিকেটের কবলে বিমানের টিকিট

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য নিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইনস ব্যবসায়ী এবং দেশীয় কিছু ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো সময়ে কোনো কোনো রুটে টিকিটের চাহিদা বেড়ে যায়। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সিন্ডিকেটভুক্ত এজেন্সিগুলো নিজেদের চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত লাভের আশায় বিভিন্ন এয়ারলাইনসের টিকিট ব্লক করে রাখে। আর বিমান বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বেশি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি কমাতে সরকারকে এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে অথবা ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা বলে সমঝোতা করতে হবে। সিন্ডিকেট বন্ধে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। যেসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের যাতায়াত বেশি, সেসব দেশে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটগুলোতে স্বচ্ছন্দে টিকিটপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
সম্পর্কিত খবর

উচ্ছেদ আতঙ্কে স্থানীয়রা
- জটিল হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা

রোহিঙ্গা সংকট ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। টেকনাফের বাতাসে এখন অস্ত্রের ঝনঝনানি। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের পাশাপাশি ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণসহ নানা অপরাধ তৎপরতা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। খুনাখুনি লেগেই আছে।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় স্থানীয় অধিবাসীর সংখ্যা ছয় লাখ, আর রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। তার পরও প্রতিদিনই মায়ানমার থেকে আসছে রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, গত ১৮ মাসে এসেছে আরো দেড় লাখ রোহিঙ্গা।
শুধু রোহিঙ্গার সংখ্যা বৃদ্ধিই সমস্যার কারণ নেই। রোহিঙ্গাদের জন্য প্রদত্ত আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা ক্রমেই কমছে।
উখিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি সরওয়ার জাহান চৌধুরী জানান, মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে অস্ত্র ও মাদকের চোরাচালান কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। তিনি জানান, অস্ত্র ও মাদক প্রথমে ক্যাম্পগুলোতে মজুদ করা হয়, পরে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী জানান, এলাকাবাসীর প্রতিটি দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাছে একরকম জিম্মিদশার মধ্যে আছে উখিয়ার মানুষ। তাদের ভয়ে সারাক্ষণ স্থানীয়দের তটস্থ থাকতে হয়। স্থানীয়দের রাত কাটে রোহিঙ্গাদের অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্যে।
আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনে জোর দিতে হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত আশ্রয়শিবিরগুলোতে কঠোর নজরদারি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চোরাচালান বন্ধে ব্যাপক পদক্ষেপ নিতে হবে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে বিশেষ অভিযান চালাতে হবে।

পোশাকশিল্প রক্ষা করতে হবে
- ১০ লাখ শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি) দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। এই খাত শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মূল উৎস নয়, প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাঁদের বড় অংশ নারী, এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা গোটা অর্থনীতিকেই গভীর অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের ঘোষণা কার্যকর হলে প্রায় ১০ লাখ পোশাক শ্রমিকের কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা দেশের কর্মসংস্থান ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বর্তমানে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে তা বেড়ে প্রায় ৫১ শতাংশে দাঁড়াবে। এই বর্ধিত শুল্কের বোঝা বহন করা ছোট ও মাঝারি পোশাক কারখানাগুলোর জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে সহস্রাধিক কারখানা।
এই শুল্কচাপ এমন এক সময়ে এসেছে, যখন দেশের বস্ত্র খাতও অভ্যন্তরীণভাবে গভীর সংকটে ভুগছে। করোনাভাইরাস-পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট, ব্যাংকের উচ্চ সুদহার, রপ্তানি প্রণোদনা হ্রাস, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি এবং তুলা আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত্ত—সবকিছুই এই শিল্পের ওপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি বৃহৎ ও সম্ভাবনাময় রপ্তানি বাজার বাংলাদেশ হারাতে পারে না।’ তিনি শুল্কসংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে সরকারকে জোরালো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারাও সরকারের কাছে লবিইস্ট নিয়োগসহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছেন।
এই মহাচ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের শক্তিশালী কূটনৈতিক পদক্ষেপ অপরিহার্য। শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নয়, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কার্যকর আলোচনা প্রয়োজন। সরকার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘জিটুজি’ ভিত্তিতে গম আমদানিসহ বিভিন্ন পণ্যে বাণিজ্য সমন্বয়ের চেষ্টা করছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে তা যথেষ্ট নয়। ১ আগস্টের আগেই আলোচনায় স্পষ্ট অগ্রগতি ও সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন।
অভ্যন্তরীণ শিল্প বাঁচাতে এআইটি ও সুনির্দিষ্ট কর প্রত্যাহারের মতো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পোশাক ও বস্ত্র খাতের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। অন্যথায় লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে এবং দেশের অর্থনীতি এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সম্মুখীন হবে।

দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি রোধ করুন
- পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে আবারও সিন্ডিকেট

পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু প্রতিবছরই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই ছাপার ক্ষেত্রে এক ধরনের সিন্ডিকেটের খবর উঠে আসে। এই চক্র শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই জিম্মি করে রাখছে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনসিটিবি ঘিরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটে এখনো পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠরাই কলকাঠি নাড়ছে।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে বই ছাপার জন্য এবারও কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে ক্ষমতার প্রভাবে সক্ষমতার বাইরে কাজ নিয়েছে। গত রবিবার মুদ্রণশিল্প সমিতিতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলেও তার আগেই আওয়ামী সিন্ডিকেট, বিশেষ করে সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই মো. রাব্বানি জব্বারের নেতৃত্বে বেশির ভাগ কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে। জানা যায়, প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার পাঠ্যবই ছাপার কাজে সিন্ডিকেটের ইচ্ছামতো কাজ ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। সক্ষমতার বাইরে গিয়ে বড় ধরনের কাজ ধরে রাখা এবং বন্ধ প্রেসের নামে কাজ নেওয়ার মতো অনিয়মগুলো অন্যান্য প্রেস মালিকদের অসহায় করে তুলছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এরই মধ্যে চলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপায় ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে। নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার, দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, অতিরিক্ত বই ছাপিয়ে অর্থ আত্মসাৎ এবং শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির নামে ৩৩ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ৩৬ জন প্রেস মালিকের বিষয়ে এনসিটিবির কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে।
দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক সময়ে মানসম্মত বই সরবরাহ করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। পাঠ্যবই ছাপার মতো একটি মৌলিক বিষয়ে সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিকেই দুর্বল করে দিচ্ছে।

নির্বাচন ব্যাহত করার ষড়যন্ত্র!
- রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি কেন

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান শক্তি ছিল শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রসহ সারা দেশের সব মানুষের ইস্পাতকঠিন ঐক্য। সেই ঐক্যের জোরেই স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এক বছর যেতে না যেতেই সেই ঐক্য প্রায় হারিয়ে গেছে। রাজনীতিতে অনেক পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে।
সম্প্রতি ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙ্গারি পণ্যের ব্যবসায়ী লালচাঁদ সোহাগের হত্যাকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠেছে। লন্ডনে অবস্থানকারী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করা হচ্ছে, নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিএনপি মনে করছে, এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অপপ্রচার চালাচ্ছে।
নয়াপল্টনের সমাবেশে অংশ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আহবান জানান।
এমন আশঙ্কাই করেছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ সেনা দিবস উপলক্ষে রাওয়া ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘নিজেরা কাদা ছোড়াছুড়ি, মারামারি ও কাটাকাটি করলে দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।’ প্রায় পাঁচ মাস পর এসে সেনাপ্রধানের সেই সতর্কবার্তাই সচেতন সব মহলে গুরুত্ব পাচ্ছে। অনেকেরই উপলব্ধি, সেনাপ্রধান সঠিক আশঙ্কাই করেছিলেন।
দেশের মানুষ আর কোনো সংঘাত-সহিংসতা চায় না। সংঘাত-সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতা মূলত রাষ্ট্রের, রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের। আমরা মনে করি, মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা হবে। ‘গুপ্ত সংগঠনের’ অভিযোগ দ্রুত খতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করতে হবে।