বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে জবাবদিহির দাবি বহুদিনের। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ সেই জবাবদিহির পথে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এটি জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত অপরাধের প্রথম কোনো মামলার বিচারকাজ শুরু এবং এর গুরুত্ব অপরিসীম। অভিযোগগুলোর মধ্যে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতন নির্দেশের দায়সহ হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ব্যাপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্র এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ অন্তর্ভুক্ত।
এই বিচার বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করছে, যেখানে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও আইনের ঊর্ধ্বে নন—এই বার্তাটি স্পষ্ট হচ্ছে।
এই বিচারিক প্রক্রিয়ার একটি চাঞ্চল্যকর দিক হলো মামলার অন্যতম আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের দোষ স্বীকার এবং রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ঘটনার ভেতরের সত্য উদঘাটনে আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। আমরা মনে করি, তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাঁকে সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করা গেলে মামলার গতি-প্রকৃতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
একই সঙ্গে ‘শেখ হাসিনার কৃষি ভাবনার আড়ালে দুর্নীতির চাষাবাদ!’ শীর্ষক আইএমইডির প্রতিবেদনটি আরো একটি গুরুতর দিক তুলে ধরেছে। ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষক সেবা কেন্দ্র ও প্রযুক্তি সমপ্রসারণ’ প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকার অপচয় ও দুর্নীতির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। প্রায় ৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২৪টি সেবাকেন্দ্রের মধ্যে ১৪টির সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা অকার্যকর, যন্ত্রপাতি চুরি হয়েছে বা অব্যবহৃত এবং ভবন নির্মাণে নিম্নমান ও রক্ষণাবেক্ষণে বাজেটের অভাব—এগুলোর সবই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভয়াবহ গাফিলতি, নজরদারিহীনতা ও দুর্নীতির স্পষ্ট প্রমাণ। কৃষকদের হাতে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়ার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হওয়া এই প্রকল্প বাস্তবে ‘কাগুজে সফলতায়’ পর্যবসিত হয়েছে, যেখানে সাধারণ কৃষকরা কোনো দৃশ্যমান সুবিধা পাননি।
এই দুটি ঘটনা বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং আইনের শাসনের গুরুত্বকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। একসময় যাঁরা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতেন, তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং তাঁদের শাসনামলে সংঘটিত দুর্নীতির তদন্ত ও উন্মোচন করা ‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের একটি অপরিহার্য ধাপ। বিশেষ করে যখন আইএমইডির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানই দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে পায়, তখন এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক।
তবে এই বিচারিক প্রক্রিয়া এবং দুর্নীতি দমনে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। শুধু সাবেক সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিচার করলেই হবে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে, যেখানে ক্ষমতাশীল ব্যক্তিরা জনগণের সম্পদ লুটপাট করতে সাহস পাবেন না।
জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে এই মামলাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত, নিরপেক্ষ বিচার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বজায় রাখতে হবে। এই পদক্ষেপগুলোই বাংলাদেশকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।