বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে গবেষণা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গবেষণার মধ্য দিয়েই একজন শিক্ষার্থীর মেধার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই গবেষণার মান ও স্বকীয়তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে। অনেকের পিএইচডি থিসিসেও চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে।
ঢাবির প্রশংসনীয় পদক্ষেপ
- চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধে নীতিমালা

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এখানে যাঁরা শিক্ষা নেবেন তাঁদের সততা, নিষ্ঠা, মেধা ও মনমানসিকতা সবই সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, তার অনেক ঘাটতি রয়েছে। সে কারণেই গবেষণায়, থিসিস প্রণয়নে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ পাওয়া যায়। গবেষণার মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
গবেষণাকর্মে চৌর্যবৃত্তির এই সমস্যাটি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই সমস্যা। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধের যে উদ্যোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েছে, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমরা মনে করি, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনুরূপ উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
সম্পর্কিত খবর

শিল্প রক্ষায় উদ্যোগ নিন
- সংকটে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি

যেকোনো দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। বর্তমানে বাংলাদেশ বিনিয়োগ নিয়ে গভীর সংকটে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মব সন্ত্রাস, প্রশাসনিক দুর্বলতা, মূল্যস্ফীতি এবং উচ্চ সুদহারের কারণে দেশে যেমন বিদেশি বিনিয়োগ কমছে, তেমনি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দেশি উদ্যোক্তারাও। বিদ্যমান শিল্পগুলোও ধুঁকছে।
গত রবিবার কালের কণ্ঠে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন বাংলাদেশের অর্থনীতির এই সংকটময় দিক তুলে ধরেছে।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিল্প-কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিদেশি ও দেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্যোবিদায়ি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ ৯১ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ)মন্তব্য, তুলা আমদানিতে নতুন করে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপ করা দেশের বস্ত্রশিল্পের জন্য ‘কফিনে শেষ পেরেক’ হিসেবে কাজ করবে। বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল এবং অন্য নেতারা এটিকে পার্শ্ববর্তী একটি দেশের ‘নীলনকশা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যার উদ্দেশ্য দেশটির শিল্পকে শক্তিশালী করা এবং বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পকে রুগ্ণ করে দেওয়া। তাঁদের মতে, ১৮ শতাংশ সুদের ব্যাংকঋণ এবং ৫০ শতাংশ কার্যকর করের বোঝা নিয়ে বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তাদের পক্ষে কারখানা চালু রাখা অসম্ভব।
বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের উচিত অতি দ্রুত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো। একই সঙ্গে বস্ত্রশিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর সমস্যাগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। অযৌক্তিক কর আরোপ প্রত্যাহার এবং শিল্পবান্ধব নীতি প্রণয়ন না করা হলে দেশের অর্থনীতি ক্রমেই ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে।

ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হোক
- রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়ছে

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় বা অনিশ্চয়তা যেমন বাড়ছে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান বা পরস্পরকে দোষারোপ করার প্রবণতাও ক্রমে বাড়ছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল চাচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দ্রুত অনুষ্ঠিত হোক। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হোক। নির্বাচিত সংসদ বড় ধরনের সংস্কারসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত নিক।
দেশের অর্থনীতি ধুঁকছে। শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান গত শনিবার ফেনীতে এক সমাবেশে বলেছেন, ‘ফ্যাসিজম তৈরির পথ বন্ধ করতে হলে পিআর পদ্ধতিকে বেছে নিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।’ গত শনিবার বগুড়ায় এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আগে গণহত্যার বিচার, সংস্কার, তারপর নির্বাচন।’ অন্যদিকে শনিবার কেরানীগঞ্জের এক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, কিছু দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষ পিআর পদ্ধতি বোঝেন না। তাঁরা এ পদ্ধতিতে কখনো ভোট দেননি। যারা পিআর নির্বাচনের কথা বলে, তাদের ভোট নেই। নির্বাচন হলে তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।
রাজনীতি অস্থিতিশীল বা সংঘাতময় হোক, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনীতির স্বার্থে এবং মানুষের দুর্ভোগ কমাতে অনির্বাচিত সরকারের মেয়াদ আর দীর্ঘায়িত করা উচিত হবে না। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন দেওয়াটাই সবচেয়ে যৌক্তিক হবে।

মব সন্ত্রাস থামান
- আইনের প্রতি আস্থাহীনতা

সাম্প্রতিককালে দেশের নানা প্রান্তে যেভাবে মব সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে, তা শুধু ভয়াবহ নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের যৌথ ব্যর্থতার প্রকাশ। কুমিল্লার মুরাদনগরে মা, ছেলে ও মেয়েকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার রেশ না কাটতেই গাজীপুর, লালমনিরহাট, ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে একের পর এক গণপিটুনির খবর এসেছে। এই নির্মম ঘটনাগুলোর পরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হয়নি কিংবা দায়ীদের গ্রেপ্তারে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন এবং সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদার অভিমত থেকে স্পষ্ট হয় যে এই মব সন্ত্রাসের পেছনে রয়েছে সমাজের অস্থিরতা, আইনের প্রতি অবজ্ঞা এবং সরকারের সদিচ্ছার অভাব।
মুরাদনগরের ঘটনাটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, যেখানে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারের উপস্থিতিতে সালিসি বৈঠকের নামে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহতদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ থাকলেও কাউকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে চলমান ‘মব সন্ত্রাসে’ সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। ভুক্তভোগীরা আছে আতঙ্কে।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা যথার্থই বলেছেন, মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তাঁর মতে, সরকার যদি কঠোর অবস্থানে থাকত, তাহলে এভাবে একের পর এক মব সৃষ্টি হতো না। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, আইনের প্রতি আস্থাহীনতা, রাজনৈতিক বিরোধ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থাসহ নানা কারণে গণপিটুনির ঘটনা বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও মব তৈরি করছেন, যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর ও দ্রুত পদক্ষেপ অপরিহার্য।

জনপ্রত্যাশাকে মূল্য দিন
- নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা

আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে বা রোজার আগে নির্বাচন হতে পারে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এমন ঘোষণার পর দেশে একটি নির্বাচনী আমেজ তৈরি হয়েছে। মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে নির্বাচনী উৎসবকে উপভোগ করার জন্য। সম্ভাব্য প্রার্থীরা গণযোগাযোগ শুরু করে দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও প্রার্থী বাছাই, জোট গঠনসহ নির্বাচনকে উপলক্ষ করে নানা রকম কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছে।
গত শুক্রবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘দেশের এই পরিস্থিতিতে কিসের নির্বাচন? কী নির্বাচন হবে? সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অবশ্যই আগে পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’ অন্যদিকে কোনো কোনো দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দাবি করছে।
গত শুক্রবার রংপুরের জনসভায় জামায়াতের আমির বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কিছু মৌলিক সংস্কার অপরিহার্য।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বলছে, নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে অনির্বাচিত সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার অপচেষ্টা চলছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তোলা তেমনই একটি অপচেষ্টা। এর আগে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির, সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পিআর পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। ভোট ডাকাতির সুযোগ থাকবে না বলেই কেউ কেউ পিআর পদ্ধতির নির্বাচনকে ভয় পায়।’ এসব কারণে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে যে গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ক্রমেই বিভেদ বাড়ছে। একই সঙ্গে নির্বাচন নিয়েও এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান উভয়েই জাতীয় স্বার্থে ‘ঐক্যের’ আহবান জানিয়েছেন এবং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবাইকে এক থাকার কথা বলেছেন।
গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রত্যাশা মানুষের ভোটাধিকার বা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। সেই প্রত্যাশা পূরণের পথেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। অনির্দিষ্টকাল ধরে দেশ অনির্বাচিত সরকারের অধীনে থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়।