গাছে বেশ কিছু বানর ছিল। বানরগুলো এক ডাল থেকে আরেক ডালে ছোটাছুটি করছিল। এর মধ্যেই দুটি বাঘ দৌড়াতে দৌড়াতে গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো। এদিক-সেদিক তাকিয়ে গাছের চারদিকে ঘুরতে লাগল। অপুরা ভয়ে অস্থির। বানরগুলো ওদের কাছে এসে এমন ভাব করছে, যেন ওদের সাহস দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর গাছের গোড়ায় মাটিতে মুখ দিয়ে দুটি বাঘ একসঙ্গে চিত্কার শুরু করল। দুই বাঘের চিত্কারে বড় গাছটা থর থর করে কাঁপতে থাকে। অপুরা শক্ত করে গাছের ডাল ধরে আছে; কিন্তু কিছু বানর ডাল ধরেও রক্ষা পেল না। কয়েকটা ধপাস ধপাস করে মাটিতে পড়ল। আর অমনি বাঘ দুটি কয়েকটা বানরকে পাকড়াও করল। সঙ্গে সঙ্গে গাছে থাকা বানরগুলো চিত্কার-চেঁচামেচি শুরু করল। কোনো কোনো বানরের অবস্থা দেখে মনে হলো, মানুষের মতো চিত্কার দিয়ে কাঁদছে।
চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখতে পারছিল না অপু ও তার বন্ধুরা। পাঁচজনই কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখল। ওদের ভয়, ওরা কেউ নিচে পড়লেই বাঘের মুখে পড়তে হবে!
অপু ভয়ে কাতর। সে কাঁপা কাঁপা গলায় রাজনকে বলল, কাণ্ডটা দেখলি?
আমার ভয় লাগছে। এই দৃশ্য দেখা যায়! বাঘ যেভাবে বানরটাকে একটা আছাড় মারল! মাই গড! আচ্ছা, চিতাবাঘও রয়েল বেঙ্গলের মতো কাণ্ড করে নাকি?
মুহিত বলল, কী রকম?
রাজন বলল, আমরা তো জানতাম, রয়েল বেঙ্গল টাইগার খাবার না পেলে গাছের নিচে এসে প্রবল শব্দে চিত্কার করতে থাকে। বাঘের চিত্কারে বানর গাছ থেকে নিচে পড়ে যায়। তারপর সেগুলো ওরা ধরে ধরে শিকার করে।
ও তাই! মুহিত বলল।
অপু সবাইকে সতর্ক করে বলল, খুব সাবধান! পড়ে গেলে কিন্তু সব শেষ! চিতাবাঘ দুটি কেমন করছে দেখছিস? একেবারে পাগলা হয়ে গেছে। মনে হয়, অনেক দিনের না খাওয়া।
রনি, রুবেলকে উদ্দেশ করে অপু বলল, তোরা ঠিক আছিস তো?
রনি বলল, খুবই ভয়ের মধ্যে আছি।
রুবেল বলল, কয়েকটা বানরকে তো খাইল। এখনো এগুলো যায় না কেন? আমরা তো দেখছি মহাবিপদে পড়েছি। এখন উপায় কী হবে!
অপু রুবেলকে বলল, এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই রুবেল। আরেকটু ধৈর্য ধর।
বিকেল হয়ে গেল যে! বাসায় যেতে হবে না!
অবশ্যই যেতে হবে। আমরা সবাই একসঙ্গে যাব।
রুবেল আর কোনো কথা বলল না। রাজন বলল, আমার মনে হয় আর বেশিক্ষণ বাঘ দুটি থাকবে না। চলে যাবে।
কী করে বুঝলি? অপু রাজনের কাছে জানতে চাইল।
তুই ভালো করে তাকিয়ে দেখ, খুব রিলাস্ক মুডে আছে না! আমাদের যেভাবে তাড়া করল, সেই রূপ এখন আছে?
তা নেই। কিন্তু তুই এখন ওই বাঘের সামনে পড়ে দেখ!
ও মাই গড! তা হলে তো শেষ!
অপু নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। বাঘ দুটি চলে গেছে কি না তা দেখছে। হঠাত্ দেখে, বাঘ দুটি নেই! অপু চিত্কার দিয়ে রাজন, মুহিত, রুবেল ও রনিকে ডেকে বলল, তাড়াতাড়ি নেমে আয়। এই সুযোগে পালাই!
ওরা দ্রুত গাছ থেকে নামল। চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল চিতাবাঘ দুটি আছে কি না। তা ছাড়া ভালুক, বন্য হাতিও থাকতে পারে। সে বিষয়টিও ওদের মাথায় ছিল। তারপর ওরা দ্রুত এগিয়ে যায় লেকের দিকে।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এগিয়ে গেল। কিন্তু লেকের ধারে-কাছেও পৌঁছতে পারল না। সবাই ভীষণ টায়ার্ড। আর পা চলতে চায় না। কোথাও বসে জিরিয়ে নিলে ভালো হয়। আবার বনের মধ্যে কোথায় বসবে, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যায়।
রনি বলল, আমি আর কিছুতেই হাঁটতে পারছি না। আমার পা আর চলছে না।
রুবেল বলল, আমার ভীষণ ক্ষুধা লাগছে। কোথাও বসে কয়েকটা পেয়ারা খেয়ে নিই!
মুহিত বলল, পেয়ারা কোথায় পাবি?
রুবেল আঙুল দিয়ে পেয়ারাগাছ দেখিয়ে বলল, দেখছিস তো! চল, খেয়ে নিই কয়েকটা।
সবাই এগিয়ে গেল পেয়ারাগাছের দিকে। রুবেল গাছের ওপরে উঠে পেয়ারা পাড়ছে আর নিচে ফেলছে। অন্যরা সেগুলো এক জায়গায় করছে। বিশ-একুশটি পাড়ার পর অপু বলল, এবার নেমে আয়। আর লাগবে না। এতে আমাদের সবার পেট ভরে যাবে।
অপু, রাজনরা পেয়ারা খাওয়া শুরু করল। রুবেলও নিচে নেমে এসে সবার সঙ্গে খেতে লাগল। পেয়ারাগুলোর ভেতরটা লাল। ভীষণ মিষ্টি। এত ভালো পেয়ারা ওরা শিগিগর খায়নি। পেয়ারা খাওয়া শেষ করে আবার ওরা হাঁটতে শুরু করল। পেয়ারা খাওয়ার পর পেটে কিছুটা ফুয়েল ঢুকেছে—এমন একটা ভাব ওদের।
এই পাহাড়ের কোথাও ভালো কোনো রাস্তা নেই। পুরোটাই পাহাড়ি ঢাল। খুব সাবধানে পা ফেলতে হয় ওদের। কোথাও কোথাও এমন অবস্থা যে পা পিছলে পড়লেই একেবারে নিচে চলে যাবে। তাকে আর কেউ খুঁজেও পাবে না।
কোথাও কোথাও ওরা একজন আরেকজনের হাত ধরে এগোয়। ওরা যে পথে বনের ভেতরে ঢুকেছিল, সে পথ আর খুঁজে পাচ্ছে না। অন্য পথ দিয়ে যেতে হচ্ছে। সব কিছুই অচেনা। এত হাঁটছে, তার পরও লেকের ধারে-কাছে পৌঁছতে পারেনি। সবার মনে এক প্রশ্ন, আমরা কি পথ ভুল করলাম!
পাহাড়ের ঢাল পেয়ে অপু, রাজনরা শুধু ঘুরছে। লেকের রাস্তা আর খুঁজে পাচ্ছে না।
উদ্বিগ্ন হয়ে অপু বলে, এখন কী হবে! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এর মধ্যে লেক পার হয়ে যেতে না পারলে আমরা তো ভয়ংকর বিপদে পড়ব!
রাজন অপুর কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলল, দিনের বেলায়ই চিতা, ভালুুক আর বন্য হাতির যন্ত্রণায় টেকা দায়। রাতে তো এগুলো ভয়ংকর হয়ে উঠবে!
মুহিত কিছুটা ঠাণ্ডা মাথার ছেলে। সে ধীরস্থিরপ্রকৃতির। যেকোনো বিপদে কিংবা সংকটে উদ্বিগ্ন হয় না। বরং ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করে। অপু সংকটে পড়লে বেশির ভাগ সময়ই মুহিতের ওপর নির্ভর করে। এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। সে মুহিতকে বলল—মুহিত, বল তো কী করা যায়? আমরা কিন্তু সত্যি সত্যিই বিপদের মধ্যে আছি। ধর, এখন যদি কোনো বন্য প্রাণী তাড়া করে, কোথায় যাব?
মুহিত বিজ্ঞের মতো কিছুক্ষণ ভাবে। আমি একটা কথা বলি? তোরা ধৈর্য ধরে শোন। আগে আমি শেষ করি, তারপর তোরা বলবি।
অপু বলল, আচ্ছা বল। এই! তোরা সবাই মনোযোগ দিয়ে মুহিতের কথা শোন।
মুহিত বলল, আমরা যদি কোনো কারণে এই পাহাড় থেকে বের হতে না পারি, তাহলে কী করব?
রুবেল উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, এসব কী বলিস?
এ রকম ঘটতেও তো পারে। পারে না?
রনি বলল, হ্যাঁ পারে। আমরা আগে বের হওয়ার চেষ্টা তো করি!
তা তো অবশ্যই করব। আমরা বের হতে পারলে তো কোনো কথাই নেই। যদি বের হতে না পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের এই পাহাড়ে থাকতে হবে।
রাজন বলল, না না! এটা কী করে সম্ভব? আমাদের পাঁচজনকেই চিতাবাঘ এসে আস্ত গিলে ফেলবে!
রাজনকে থামিয়ে দিয়ে মুহিত বলল, শোন, আমরা রাতে থাকার জন্য বড় একটা গাছ বেছে নিই। আমাদের ব্যাগে যে শুকনো খাবার আছে, তা দিয়ে রাত চলে যাবে তো?
রাজন বলল, নিশ্চয়ই যাবে। কিন্তু গাছের ওপর থাকা কি আদৌ সম্ভব?
অপু সঙ্গে সঙ্গে বলল, কেন সম্ভব না? ঠেকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। রনি, রুবেল তোরা কী বলিস?
ওরা দু’জনই ভীষণ চিন্তিত। ওরা কোনো কথা বলল না। তারা বাসায় ফিরবে কী করে তা নিয়ে ভাবে। অপু দু’জনের কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনার সুরে বলে, এই! এত টেনশন কেন করছিস? নিশ্চয়ই একটা পথ বের হবে। এখন আমরা সবাই একটা বিপদের মধ্যে আছি। এ সময় সবার মনোবল শক্ত রাখতে হবে।
মুহিতও অপুর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলল, একেবারে ঠিক কথা। মনোবল শক্ত রাখতে হবে। আমরা তাহলে একটা বড় গাছ দেখি। সেই গাছে পাঁচজনের একটা থাকার ব্যবস্থা করি।