হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) একটি নাম, একটি ইতিহাস। পাক-ভারত উপমহাদেশে যেসব আকাবের ও সলফে সালেহীন অতিবাহিত হয়েছেন, অলিকুল শিরোমণি হজরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। কোরআন ও সুন্নাহর বাস্তব প্রতিচ্ছবি এ মোর্শেদে কামেল ও জ্ঞানতাপস বুজুর্গের দৃষ্টান্ত সমকালীন আলেমদের মধ্যে বিরল। সর্বাধিক ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী যুগের শ্রেষ্ঠ আল্লাহওয়ালা উস্তাদদের সান্নিধ্য ও সযত্ন তত্ত্বাবধানে থেকে তিনি ইসলামী শিক্ষা ও দীক্ষা লাভ করেছিলেন।
তিনি নিজেকে কোরআন ও সুন্নাতে রাসুলের বাস্তব নমুনারূপে গড়ে তোলার সাধনায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিলেতিলে কাজে লাগিয়েছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মহান সংস্কারক হাকিমুল উম্মত হজরত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সুদীর্ঘ সাহচর্যের বরকতে শরিয়তের জ্ঞানের পাশাপাশি তাজকিয়া, সুলুক ও মারেফতে ইলাহির তিনি শীর্ষ চূড়ায় আরোহণ করেছিলেন। ফলে ইসলামী শরিয়তের জ্ঞান তাঁর স্বভাব ও মজ্জার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন কোরআন ও হাদিসের গভীর জ্ঞানের অধিকারী। যাঁরা তাঁর জীবনাচার প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা অবলীলায় স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর জীবন ছিল কোরআন ও সুন্নাতের বাস্তব নমুনা।
তিনি ৭ মে ১৯৮৭ ঈসায়ি মোতাবেক ৮ রমজান ১৪০৭ হিজরি সালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। চারদিকে একটাই রব- হাফেজ্জী হুজুর চলে গেলেন।
রাজধানী ঢাকার রমরমা অশান্তমুখর পরিবেশেও নেমে এলো স্তব্ধ নীরবতা। নিমেষেই তা যেন এক শোকের নগরীতে রূপ নিল। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) যে মাসে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন সেই মাসটি মুমিন বান্দাদের জন্য অনেক বড় একটি মুবারক মাস। এ মাসের সিয়াম ও কিয়াম সাধনা জান্নাত লাভের জন্য সুনিশ্চিত একটি ব্যবস্থা।
এ মাসটি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) কিভাবে কাটাতেন
রমজান মাস ছাড়াও তিনি প্রতিটি মুহূর্তের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতেন।
আর রমজান মাস এসে উপস্থিত হলে তাঁর চেহারায় অন্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি আনন্দ উৎফুল্লতা ও গাম্ভীর্য ফুটে উঠত। রমজানের বরকত ও কল্যাণ লাভে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। অতি কাছের মানুষ ও আপনজনরাও তখন তাঁর কাছে অপরিচিত হয়ে যেত। রমজান মাসে কামরাঙ্গীরচরের মাদ্রাসা নূরিয়ার বিস্তৃত অঙ্গন নূরানি বরকতময় পরিবেশে পরিণত হতো। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে মাহে রমজান কাটানোর উদ্দেশ্যে তাঁর মুরিদ, ভক্ত ও অনুরক্তদের আগমনে মাদ্রাসা নূরিয়ার মাঠ ও বিস্তৃত এলাকা এক পুণ্যভূমিতে পরিণত হতো। রমজানে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অগণিত আল্লাহপ্রেমিক ও আলেম-ওলামার আগমন ঘটত। আল্লাহপ্রেমিকদের জিকির, তিলাওয়াত ও রোনাজারির (কান্নাকাটির) গুঞ্জন নূরিয়ার গোটা পরিবেশকে মুখরিত করে তুলত। সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকত তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তরবিয়াতুল মোয়াল্লেমিন (শিক্ষক ট্রেনিং কোর্স) এবং তাঁর তারবিয়াতুস সালেকিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিগুলো।
তিনি প্রতিদিন জোহরের নামাজের পর আগত ভক্ত ও সাক্ষাৎপ্রার্থীদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত নসিহত ও সাক্ষাৎদান করতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন এবং আমাদের তাঁর উত্তম অনুসারী হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
লেখক : খতিব, আম্বর শাহ শাহি মসজিদ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা