ঢাকা, মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৯ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৯ মহররম ১৪৪৭

বিশ্বের নন্দিত-নিন্দিত মানুষের তালিকা প্রসঙ্গে

মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ
মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ
শেয়ার
বিশ্বের নন্দিত-নিন্দিত মানুষের তালিকা প্রসঙ্গে

নায়ক, নায়ক রাজ, মহানায়ক, খলনায়ক অভিধাগুলো চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল বিশেষভাবে। বৈশ্বিক দৃশ্যপটের দ্রুত ও মারাত্মক উত্থান-পতন রাজনৈতিক অঙ্গনেও এর ব্যবহার এনে দিয়েছে। আসলে বাংলা 'নায়ক' শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Protagonist, Advocate, Syndic, Second, Backer, Upholder, Prop, Captain, Prefect ইত্যাদি। অতএব, যেকোনো বিষয়ে সৃষ্টিধর্মী কর্মকাণ্ডের পথনির্দেশক 'নায়ক' খেতাবের জন্য মনোনীত হতে পারেন।

তাই বলে মানব সভ্যতার ইতিহাসে নায়ক, মহানায়ক নির্বাচন সহজ বিষয় নয়। সম্প্রতি উঠতি বয়সের (গড় ২৩ বছর) কিছু বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া যুবক এ দুঃসাধ্য কাজে হাত দিয়েছেন। এ কাজে গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, আর্জেন্টিনাসহ ৩৭টি দেশের কয়েকটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় হাজার ৯০২ জন গবেষক। তাঁদের গবেষণায় আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নায়ক হিসেবে বিশিষ্ট পদার্থবিদ ও আপেক্ষিকতাবাদের জনক আইনস্টাইন আর শ্রেষ্ঠ খলনায়ক হিসেবে ৬০ লাখ ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে হত্যাকারী অ্যাডলফ হিটলারের নাম উঠে এসেছে।
শীর্ষ দশ নায়কের তালিকায় পর্যায়ক্রমে আছেন আইনস্টাইন, মাদার তেরেসা, মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, আইজাক নিউটন, যিশুখ্রিস্ট, নেলসন ম্যান্ডেলা, টমাস এডিসন, আব্রাহাম লিংকন ও গৌতম বুদ্ধ। আর খলনায়কদের তালিকায় আছেন যথাক্রমে অ্যাডলফ হিটলার, ওসামা বিন লাদেন, সাদ্দাম হোসেন, জর্জ ডাব্লিউ বুশ, স্তালিন, মাও জে দং, লেলিন, চেঙ্গিস খান, সালাদিন ও কিন সি হুয়াং।

গবেষণার বিষয়টিই বলে দেয়, কাজটি ছিল খুবই জটিল এবং অত্যন্ত সাহসিকতার। বিশ্ববাসীর সামনে গবেষকদের গবেষণার ফল একটি বিষয়কে সন্দেহাতীতভাবে উপস্থাপন করেছে যে, সমাজতন্ত্রের নামে ধর্মহীনতা, লুটপাট, হত্যা, ধ্বংস, মাদকাসক্তি, অবৈধ যৌনাচার এবং নিরাপত্তার মিথ্যা অজুহাতে যুদ্ধ- কোনোটাই আধুনিক সভ্যতায় গ্রহণীয় নয়।

খলনায়কদের তালিকা সে কথাই প্রমাণ করে। আর এ কথাটা স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে যে, সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ দুটোই আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার আদিশত্রু। প্রণীত নায়কদের তালিকাও প্রমাণ করে, সভ্যতা আর মানবতার জন্য উৎসর্গীকৃতদেরই কেবল ইতিহাস শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকে। গবেষকদলের মুখপাত্র University of the Basque country, Spain-এর প্রভাষক দারিও পাস নায়ক নির্বাচনে বিজ্ঞানী, মানবতাবাদী, স্বাধীনতাকামী ও উন্নয়নকামী ব্যক্তিরা প্রাধান্য পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। নির্বাচিতদের ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।
তবে তালিকায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম না আসাটা 'কোন বিবেচনায় তিনি বাদ পড়লেন'? জিজ্ঞাসার জন্ম দেয় বৈকি! যেকোনো বিবেচনায় বাছাই করা হোক না কেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-ই হবেন আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নায়ক, এমনটিই আমাদের বিশ্বাস। উল্লিখিত চারটি বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর অবদান সম্পর্কে সংক্ষিত আলোচনা দরকার।

বিজ্ঞানে অবদান : বোরাকে (বিদ্যুতে) মহানবীর মেরাজ সফরে বিদ্যুৎ শক্তিকে যান্ত্রিক ব্যবহারের পথনির্দেশনা, অঙ্গুলি নির্দেশে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিতকরণে গ্রহ-নক্ষত্রে মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত, ক্ষতস্থানে মুখের লালা ও চাটাইয়ের ছাই লাগানো এবং বিশেষ বিশেষ রোগে কালোজিরা, মধুর ব্যবহার ও স্বাভাবিক সুস্থতার জন্য রোজার অনুশীলন, সালমান ফারসি (রা.)-এর মুক্তিপণ হিসেবে বৃক্ষরোপণ এবং তাতে অস্বাভাবিক দ্রুততায় ফলন প্রাপ্তি ইত্যাদি বিশ্লেষণ করলে গতিবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, সৌরবিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্বমানবতার জন্য মহানবীর অবদানের অনেক বড় তালিকা তৈরি হবে। পৃথিবীর ইতিহাস এমন কোনো একক ব্যক্তির নাম সংরক্ষণ করেছে যার জীবনে বিজ্ঞানের একাধিক শাখার সমাবেশ ঘটেছে?

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা : মাত্র ১৪ বছর বয়সে মহানবীর হিলফুল ফুজুল (সেবা সংঘ) গঠনে অংশগ্রহণ, সমাজের দুঃখী-দরিদ্র মানুষের কলাণে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া, নির্মম নির্যাতনের পর তায়েফবাসীর মঙ্গল কামনা করে মহান স্রষ্টার দরবারে প্রার্থনা করা, মক্কা বিজয়ের দিন সমবেত জনতার উদ্দেশে যারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল, অমানুষিক নির্যাতনে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করেছিল 'আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তোমরা সবাই মুক্ত' ঘোষণা দেওয়া, বিদায় হজের ভাষণে 'সাবধান! তোমরা নরীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবে, তাদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার আছে' সাবধান বাণী উচ্চারণ, আরব-অনারব, 'সাদা-কালো নির্বিশেষে সব মানুষ একই আদমের সন্তান হিসেবে মানমর্যাদায় সবাই সমান' নীতিনির্ধারণের পরও কি মহানবীর চেয়ে অগ্রসর কোনো মানবতাবাদীকে খুঁজে পাওয়া যাবে- কোনো কালে, কোনো যুগে?

স্বাধীনতা সংগ্রাম : পরাধীনতার জিঞ্জিরে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আরব উপদ্বীপে জন্ম নিয়ে মহানবী (সা.) আজন্ম লড়াই করেছেন স্বাধীনতার জন্য। মানব ইতিহাসের জঘন্যতম 'গোলাম-বাঁদি' প্রথাকে উচ্ছেদে কার্যকর আইনি বিধান প্রণয়ন করেছেন, শেখতন্ত্র, গোত্রীয় শাসন, কুলিন প্রথা উচ্ছেদ করে স্বাধীন চেতনায় উজ্জীবিত একটি জাতি গঠন করেছেন। হিজরতের পর মদিনার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় 'মদিনা সনদ' নামে খ্যাত ঐতিহাসিক সংবিধান রচনা করেছেন। মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসাকে ইমানের অংশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এর পরও কি বলা যায়, স্বাধীনতা অর্জনে এবং সংরক্ষণে মহানবীর চেয়ে বেশি অবদান ইতিহাসে অন্য কেউ রেখে গেছেন?

উন্নয়নকামিতা : মহানবী (সা.) মাত্র দশ বছরের প্রচেষ্টায় মদিনাকে একটি স্বাবলম্বী রাষ্ট্রে উন্নীত করেছিলেন। লুটতরাজে অভ্যস্ত একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে অভিজ্ঞ কর্মিবাহিনীতে পরিণত করেছিলেন। উৎপাদন, বিপণন ও বণ্টন ব্যবস্থা যথাযথকরণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের পথকে সুগম করেছিলেন। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক যোগাযোগ সহজিকরণের মাধ্যমে উন্নয়নের গতিকে দ্রুত করেছিলেন। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে মহানবী (সা.) এমন একটি আদর্শ উন্নত জাতি গঠন করেছিলেন, যাকে মানব সভ্যতার জন্য আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছেন মহানবী নিজেই। তাই বলা যায়, মহানবী (সা.) হলেন মানব সভ্যতার মহানায়ক। মহানবীকে বাদ দিয়ে সভ্যতার ইতিহাসের কোনো আঙ্গিকই পরিপূর্ণতা পেতে পারে না।

লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব,

রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ

maksudullah73@yahoo.com

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ