আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে সৎ কাজের আদেশ দিয়েছেন; পাশাপাশি অন্যায় কাজে বাধা প্রদানের কথাও বলেছেন। আমরা যদি নিজেরা ভালো হওয়ার এবং অন্যকে ভালো করার চেষ্টা না করি, তাহলে এ কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে বা আসমানি গজব এলে ভালো মানুষগুলো যে রক্ষা পাবে না!
বর্ণিত আছে, এক জনপদে ছিল পাপের প্রবল বিস্তার। আল্লাহপাক হজরত জিবরাইল (আ.)-কে পাঠালেন সেই জনপদ ধ্বংস করে দিতে। জিবরাইল (আ.) সেখানে গিয়ে এমন একজন বুজুর্গ লোক দেখেন, যিনি ৭০ বছর পর্যন্ত একটাও গুনাহ করেননি।
বাইরের খারাপ পরিবেশের কারণে তিনি বাইরে বের হন না। মসজিদের ভেতরেই ইবাদত-বন্দেগি করেন। জিবরাইল (আ.) আল্লাহর ফায়সালা জানতে চান। বলা হলো- তাঁকে আগে ধ্বংস করতে। তিনি নিজে ইবাদতে মশগুল থাকলেও সমাজকে অন্যায়ের কাজে বাধা দেননি। এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা আদ, সামুদ ও লুত সমপ্রদায়কে ধ্বংস করেছেন। তাদের বাড়াবাড়ি, অবাধ্যতা এবং সীমাহীন অন্যায় এ ধ্বংস ডেকে এনেছিল।
যারা অন্যায় দেখে চুপ থাকে, তাদের বলা হয় বোবা শয়তান।
এ জন্য আমাদের সৎ কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজে বাধা প্রদানের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে। আজ যদি আমি আমার ও আপনি আপনার পরিবারকে অপরাধমুক্ত করি এবং মহল্লার সবাই নিজ মহল্লার অপরাধ দূর করেন, তাহলে দেখা যাবে, অপরাধমুক্ত পরিবার ও সমাজ তৈরি হয়ে গেছে।
অপরাধ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। হাদিস শরিফে এসেছে- তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন অন্যায় কাজকে বন্ধ করতে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে। যদি এমনটা না করে, তাহলে মুখের ভাষায় প্রতিবাদ করবে।
এমনটিও না হলে অন্তরে পরিকল্পনা করবে সে গর্হিত কাজ বন্ধ করার এবং সেটাকে ঘৃণা করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে অপরাধের উৎস কোথায়?
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- এমন একটা জমানা আসবে, ইসলাম কেবল নামেমাত্র থাকবে। যেমন নুরুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম ইত্যাদি। একেকজন নাস্তিকের নাম খুব সুন্দর ও আনকমন হয়। এদিকে তাকালে মনে হয়- অন্যায়ের কাছে তাদের যাওয়ার প্রশ্নই আসে না! অথচ কাজের বেলায় ইসলামের নাম-নিশানা নেই। আল্লাহর রাসুল বলেন- কোরআন শুধু প্রথায় থাকবে। ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকী, সভা-সেমিনারের শুরুতে সামান্য তেলাওয়াত, মিলাদ-মাহফিলে ইত্যাদি। কোরআনের হাকিকত থাকবে না। কোরআনকে আমরা তাবিজ-কবজে ব্যবহার করছি। তাহলে কোরআন আমাদের কাছে নাজিল হলো কেন? এখন যদি প্রশ্ন রাখি, সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত কার কার মুখস্থ আছে? মোটামুটি সবাই হ্যাঁ বলবেন। কোরআনের আরো তো সুরা আছে, সে সুরা তো মুখস্থ নেই কেন? হাশরের তিন আয়াত কি এ জন্য, পাশে লেখা আছে- এ আয়াতগুলো পাঠ করলে জিনে ধরে না, বিপদাপদ হয় না, ফেরেশতারা দোয়া করে- এমন কিছু সুবিধা আছে বলে? আয়াতের অর্থের নির্যাস হলো- আসমান ও জমিনের মালিক আল্লাহ। স্রষ্টা তিনি। পৃথিবীতে আল্লাহর আইন মেনে চলো। এটাই যে দাবি। কিন্তু আমরা শুধু এর সুবিধা গ্রহণ করছি, দাবি পূরণ করছি না। কোরআন পাঠানো হয়েছে মানুষের ব্যক্তি, পারিবারিক, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তির জন্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এও বলেছেন, কোরআন শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করার লোক পাওয়া যাবে না। পাওয়া গেলেও কোরআন বোঝার মতো লোক পাওয়া যাবে না। এমন হলেও আমল করার লোক পাওয়া যাবে না।
আজ বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে, মুসলিমের চেয়ে অমুসলিম বেশি। বেশির ভাগ লোক আল্লাহর কোরআনকে বিশ্বাস করে না। যারা বিশ্বাস করে, তাদের মধ্যে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক, যারা কোরআন শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করতে পারে। দুই, অথবা পারে না। শুদ্ধ যারা পারেন, তাদের সংখ্যা না পারা লোকদের চেয়ে কম। এই কম লোকগুলোকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যারা পাঠ করতে পারে তবে ভুল হয়। আর এই ভুল হওয়ার চেয়ে শুদ্ধভাবে পড়ার লোক কম। আবার এই কম লোকগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যারা কোরআন শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করে, তারা সবাই অর্থ বোঝে না। অর্থ বোঝে না এমন লোকের সংখ্যা বেশি। আর অর্থ বোঝে যারা, তাদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। কোরআন বোঝে কিন্তু আমলের জন্য না; ওয়াজ-আলোচনা করার জন্য। অথচ তার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে কোরআন নেই। এই আমল যারা করে, তাদের সংখ্যা আমল করে না যারা, তাদের চেয়ে বেশি। আমল করা লোকদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। আমল করে ঠিক, কিন্তু লোক দেখানোর জন্য। অল্প আছেন যারা কেবল আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য ইবাদত-আমল করে। তারা মুখলিস। এখানে সতর্ক থাকতে হবে, কখন যেন আমলের ভেতরে ডাকাত ঢুকে আমলের গোডাউনকে জ্বালিয়ে দেয়।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- শেষ জামানায় মসজিদগুলো খুব চাকচিক্য হবে। মসজিদ থাকবে হেদায়েতশূন্য। (মসজিদের মিম্বার হবে শানদার, কিন্তু হক কথা বলবেন না খতিব সাহেব। কমিটির বা ব্যক্তি বিশেষের মতাদর্শ লালন করবে। অথচ মিম্বারের দাবি ছিল, কাজ ছিল- বিগত সপ্তাহের ভুল-ভ্রান্তির সংশোধন। আগামী দিনের পথচলার দিক-নির্দেশনা।) এবং ওই জমানায় কিছু আলেম পাওয়া যাবে, যাদের লেবাস দেখলে আলেম মনে হবে, কিন্তু তারা আকাশের নিচে জমিনের উপরে সৃষ্টির সর্বনিকৃষ্ট প্রাণী। (কারণ, তারা এলেম থাকা সত্ত্বেও হক কথা বলবে না। মানুষের মন জুগিয়ে চলবে।)
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দিল্লির শাহি মসজিদের ইমাম মোল্লা জিউন রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে বাদশা জাহাঙ্গীর ফতোয়া চাইলেন, পুরুষ রেশমি কাপড় ব্যবহার করতে পারবে কি না? তিনি বললেন- শুক্রবারে মিম্বারে বসে এর উত্তর দেবেন। সেদিন উপস্থিত ছিলেন বাদশা, আমলা এবং সাধারণ মানুষ। বক্তৃৃতায় মোল্লা জিউন রেশমি কাপড় ব্যবহার বৈধ নয় বলেন। বাদশার চাহিদা ভ্রুক্ষেপ না করেই তিনি হক কথা বলে দিলেন। কিন্তু আজকের আমাদের মসজিদগুলোতে নানা বাধা-বিপত্তি বিরাজমান। সঠিক নির্দেশনা ও সংশোধনের পথ সংকুচিত।
লেখক : পীর সাহেব কল্যাণপুর ও প্রিন্সিপাল, জামিয়া ইমদাদিয়া, কল্যাণপুর, ঢাকা।
অনুলিখন : মীর হেলাল