ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫
২৬ আষাঢ় ১৪৩২, ১৪ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫
২৬ আষাঢ় ১৪৩২, ১৪ মহররম ১৪৪৭

তরুণসমাজে ইসলামের আবেদন

মুফতি আবদুল্লাহ সাদেক
মুফতি আবদুল্লাহ সাদেক
শেয়ার
তরুণসমাজে ইসলামের আবেদন

ইসলাম আবির্ভাবের পর দেড় হাজার বছরের দীর্ঘ সময় পার হয়েছে। হজরত মুহম্মদ (সা.) ৪০ বছর বয়সে যদিও নবুয়ত পেয়েছিলেন, তিনি কিশোর বয়স থেকেই বর্বর সমাজে আলো বিলানোর মহান আন্দোলন শুরু করেছিলেন। গঠন করেছিলেন হিলফুল ফুজুল। তরুণ বয়সে তিনি কাবাঘরে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট মহা-উত্তেজনায় সুন্দরতম সমাধান দিয়ে নিজের দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।

কিশোর ও তরুণ বয়সে শুরু করা সমাজ, দেশ তথা অন্ধকার পৃথিবীকে আলোকিত করার প্রতিটি পদক্ষেপ পবিত্র জীবনের ৪০তম বছরে পূর্ণতা পায় নবুয়ত লাভ করার মাধ্যমে। এরপর ইসলামের জন্য তাঁর দাওয়াতে হজরত আবু বকর, হজরত ওমর ও হজরত আলী (রা.)-দের মধ্যে যাঁরাই সাড়া দিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন কিশোর তরুণ। তারুণ্যের শক্তিতেই আজ ইসলাম আমাদের কাছে পৌঁছেছে। ইসলামের ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিটি সাফল্যের পেছনে মুসলিম তরুণদের দক্ষতা, দূরদর্শিতাই প্রধানতম ভূমিকা পালন করেছে।
অথচ আজকের মুসলিম তরুণসমাজ কোথায়? তারা কী করছে? অন্য তরুণরাই বা কী করছে? এখন আমাদের কী করতে হবে? কী না করলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার? এসব বিষয় চিহ্নিত করতে গত ২৫ অক্টোবর শুক্রবার কিশোরগঞ্জের পীর সাহেবের খানকাহ মিলনায়তনে এক ঝাঁক সচেতন মুসলিম কিশোর-তরুণকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে বাংলাদেশ ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার। এতে সঞ্চালক ও সভাপতি ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মুফতি হাসানুল কাদির। প্রধান অতিথি ছিলেন কিশোরগঞ্জের পীর সাহেব আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল। বৈঠকের খোলামেলা আলোচনার নির্বাচিত অংশগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো।

দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি : জামিয়া এমদাদিয়া ঢাকার শিক্ষক মীর হেলাল বলেন, সমাজ পরিবর্তনের আগে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। দলাদলি, অনৈক্য আর সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এক কাতারে কাজ করা চাই। এটা কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু নয়। বৃহৎ স্বার্থেই আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। উদারতার পরিচয় দিয়ে তরুণদের কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

আগামী প্রজন্ম যেন সত্য, সুন্দর পৃথিবী নির্মাণে অসম্ভব দৃঢ়তার ছাপ রাখতে পারে, সে বিষয়ে বর্তমান জামানার তরুণদের নজির স্থাপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হীনম্মন্যতায় ভুগলে হবে না। সাহস ও আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দিতে হবে।

ইসলামের প্রত্যাশা পূরণে প্রয়োজন যোগ্য সংগঠক : বাতিঘর সম্পাদক আমিন আশরাফ বলেন, তারুণ্যই গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। তারুণ্যের প্রতি সবারই লিপ্সা রয়েছে। স্বার্থান্ধরা তারুণ্যকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি চায়। ব্যক্তি, সমাজ ও রাজনীতি- এ শক্তির অপব্যবহার করে চলেছে। সদ্য ফোটা তরুণরাও এক প্রকার না বুঝে এ পথে পা রাখে। ইসলামকে অবলম্বন করে তারুণ্যকে কাজে লাগানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে অনেক সংগঠন গড়ে উঠলেও ব্যক্তিস্বার্থে সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। হীনম্মন্যতা ও অপরিণামদর্শিতায় সম্ভাবনাময় তারুণ্যের বেড়ে ওঠাকে নিজেদের পথের কাঁটা ভেবে অভিযাত্রীদের টুঁটি চেপে ধরে। ফলে গুল্মলতার মতো লকলকে বেড়ে ওঠা তারুণ্যের শক্তি থমকে যায়। তাদের সব সত্তা বেয়ে ছুটে আসে হতাশা নামক অন্ধকার। তাই শূন্য দশকে ইসলামের প্রত্যাশা পূরণে প্রয়োজন যোগ্য সংগঠকের, যার পরম স্পর্শে ইসলামী তারুণ্যের শক্তি যুগের প্রত্যাশা পূরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে।

চাই কাজের ক্ষেত্রের প্রসারতা : আল আরকাম ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এনামুল হাসান বলেন, চলতি জামানায় অনেক তরুণ মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। মিডিয়াতেও সাফল্য লক্ষণীয়। কিন্তু তাদের কাজের ক্ষেত্র খুব কম। বড়রা তুলে আনছেন না নবীন-তরুণদের। অথচ তারাই আগামীর সম্ভাবনা। অপরিপক্ব মনোভাবের ফলে সেই সাফল্যের যৌবনে আজ টান পড়েছে। ইসলামকে উপজীব্য করে এগিয়ে চলা তরুণদের বুকভরা দরদের মূল্যায়ন চাই। আর তাই বড়দের কাছে সময়ের অনিবার্য দাবি হলো, তারুণ্যের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা।

সময়ের দাবি মেটাতে শুদ্ধতার বিকল্প নেই : কাশফুলের সহযোগী সম্পাদক আবদুল্লাহ আশরাফ বলেন, সৃষ্টিলগ্ন থেকে তরুণরাই বড় বড় সব বিপ্লব ঘটিয়েছে। একেকজন তরুণ একেকটি রাজপথ। যেদিকে পা বাড়ায় সে পথ হয় সুগম। ইসলামী ভাবধারায় যারা গড়ে উঠেছি পরিমার্জিত হয়ে, খেয়াল রাখা উচিত, দূষিত পরিবেশ থেকে দূরে সরে থাকলেই চলবে না। দূষিত পরিবেশের সঙ্গে মিশে শুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ওই সব বন্ধুকে জানতে হবে, জানাতে হবে। তবেই তাদের ইসলামের শাশ্বত আদর্শে আদর্শবান করে তুলতে সক্ষম হব।

পবিত্র আদর্শের বাস্তবায়ন চাই : ফরিদাবাদ মাদ্রাসার ছাত্র আবদুর রহমান জুনাইদ বলেন, আমাদের করণীয় বা কাজ অনেক কিছুই আছে। কমবেশি আমরা তা করছি অথবা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু সফলতার মুখ খুব কমই দেখছি। আলোচনার মাধ্যমে যেসব কারণ বেরিয়ে এসেছে তা হলো- ১. নিজেদের মধ্যে অনাস্থা ২. স্বার্থপরতা ৩. পদের লোভ ইত্যাদি। সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় আমি মনে করি, প্রথমে আদর্শ ঠিক করা। আদর্শকেন্দ্রিক চিন্তাচেতনা লালন করে এর সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। তাহলেই আমরা সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে কাজ করতে সক্ষম হব।

শিক্ষাধারার বিভাজন নয় : কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র শহিদুল ইসলাম মামুন বলেন, আমাদের সমাজে দুটি শিক্ষাধারা চলছে। কিন্তু এক ধর্মের অনুসারী হওয়ার পরও মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত সাংঘর্ষিক মনোভাব। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা মনে করে, তারাই শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভাবে, নিজেরাই শিক্ষিত সমাজ। এ দূরত্ব তারুণ্যের কাছে ইসলামের নির্মোহ প্রত্যাশাকে ফিকে করে দেয়। ইসলাম পরিণত হয় বেওয়ারিশ লাশে। অথচ ইসলামের চাওয়া-পাওয়া রয়েছে সমগ্র মানবজাতির কাছে। দুটি শিক্ষাধারার এ বিভাজন ইসলামের প্রসারতাকে অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করে দেয়। তাই শিক্ষার মৌলিক দাবি হলো- বিভাজনের দেয়াল সরিয়ে ফেলা। একটি জাতপাতহীন সুন্দর ইসলামী সমাজ গড়ে তুলতে তরুণসমাজকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এমনকি প্রয়োজনে নেতৃত্বও তাদের মধ্যেই কাউকে দিতে হবে।

এ ছাড়া আরো অনেক তরুণকে ইসলামের দাওয়াত কৌশলে প্রচার করা, অমুসলিম কিশোর-তরুণদের মধ্যেও ইসলামের সুন্দরতম দিকগুলো তুলে ধরার ওপর গুরুত্বারোপ করে। তারা প্রত্যেকেই বৃত্ত ভাঙার ডাক দিয়ে বলেছে, শুনলেই কিছুতে বিশ্বাস করা যাবে না। যা-ই শুনব, যাচাই-বাছাই করে তবে বিশ্বাস করব। এটাই ইসলামের শিক্ষা। শুধু আখিরাতের পেছনে লেগে না থাকে দুনিয়ার জীবনেও সুখশান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে। তাঁরা বলেন, সামাজিক পরিবর্তন চাইলে আগে নিজেদের চিন্তা-চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন চাই। ক্ষুদ্র মানসিকতা নিয়ে সমাজ পরের কথা, নিজেরই পরিবর্তন সম্ভব নয়। মুক্ত মনে মানুষের সঙ্গে মিলতে হবে। পড়াশোনা করতে হবে।

অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন আবু উবায়দা, আবু হুরায়রা, মুহাম্মদ আবদুল হক, এমদাদুল্লাহ, মুস্তাফিজুর রহমান, আবদুল হক শিবলি ও আবদুল আজিম হাম্মাদ।

প্রধান অতিথির সমাপনী বক্তব্যে আল্লামা শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল বলেন, আল্লাহর প্রতি ভয় থাকতে হবে। এটি যদি থাকে, তাহলে কোনো তরুণ বিপথগামী হতে পারে না। যে তরুণের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয় আছে, সে কখনো সন্ত্রাস করতে পারে না, কখনো ধর্ষণ করতে পারে না, কখনো মাদক গ্রহণ করতে পারে না, কখনো সে অন্য কোনো মুসলিম ভাইবোনকে কষ্ট দিতে পারে না। যার মধ্যে আল্লাহর প্রতি ভয় আছে, সে চাইলে তরুণ বয়সেই আল্লাহর অলি হতে পারে। তার দুনিয়া-আখিরাত সব উজ্জ্বল হবে। তিনি বলেন, ইসলামের ইতিহাসের মহান বুজুর্গদের কিশোর ও তরুণ বয়সের ইতিহাস পড়লে প্রমাণ হয়, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই কিশোর বয়সেই আল্লাহর অলিতে পরিণত হয়েছিলেন। আজকের তরুণসমাজ নিজেদের খুব পণ্ডিত ভাবে। এটা উচিত নয়। অবশ্যই কোনো একজন মুরব্বির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে তাঁর নির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করতে হবে। তবেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হবে।

সভাপতির বক্তব্যে হাসানুল কাদির বলেন, বাংলাদেশ ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার চিন্তা ও চেতনায় ইসলামী মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ইতিবাচক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় প্রত্যেককে ধন্যবাদ দেন। পরে পীর সাহেব হুজুরের মোনাজাতের মাধ্যমে বৈঠক শেষ হয়।

 

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ