১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে। ক্ষমতা হস্তান্তরে শাসকগোষ্ঠীর এই অনীহা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ।
বিভীষিকাময় সেই রাতের কথা
notdefined

এক আর্মি ওই ক্যান্টিন বয়ের মুখে প্রস্রাব করে দেয়
আবু শামা (সামাদ)
তত্কালীন হেড কনস্টেবল, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস
আমি ছিলাম কনস্টেবল। আমার কাজ ছিল অস্ত্রাগারের অস্ত্র ইস্যু রাখা ও জমা করা। আমাদের ইনচার্জ ছিলেন সুবেদার আবুল হাশেম। ২৫ মার্চ দিনভর আমরা নানা রকম গুঞ্জন শুনছিলাম।
আপনারা প্রস্তুত থাকেন, মিলিটারি আসছে
কনস্টেবল শাহজাহান মিয়া
তত্কালীন ওয়্যারলেস অপারেটর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস
আমি ছিলাম ওয়্যারলেস কন্ট্রোলরুমের দায়িত্বে। রাতের একপর্যায়ে আইজিপির বডিগার্ড আ. আলী আমাদের খবর দেন, মিলিটারি আসছে। অন্যদিকে মেইন গেটে আসেন এক যুবক। তিনি বলেন, ‘আমি শেখ কামাল, আপনারা প্রস্তুত থাকেন, মিলিটারি আসছে।’ শেখ কামাল এসে মিলিটারির খবর দিয়ে গেছেন। আমরা মিলিটারি আসার দুটি খবর শুনলাম। চিন্তা করলাম, যে করেই হোক প্রতিরোধ গড়ে তুলব। রাজারবাগের রিজার্ভ ইন্সপেক্টরের (আরআই) কাছে ছিল অস্ত্রাগারের চাবি। তিনি প্রথমে চাবি দিতে চাননি। পরে তাঁকে বুঝিয়ে চাবি নিয়ে আসি। আমরা প্রথম অস্ত্রাগারটি লুট করে সেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ ২০০-২৫০ জনের মধ্যে বণ্টন করি। পরে দ্বিতীয় একটি অস্ত্রাগার শাবল দিয়ে ভেঙে আরো ৩০০-৪০০ জনের মধ্যে অস্ত্র বণ্টন করি। মনির হোসেন ও আমি বেইস স্টেশনে অবস্থান নিই। রাত সাড়ে ১০টার সময় সে আমাকে জানায়, ৩৭টি ট্রাকযোগে আর্মিরা আসছে। আমরা নিশ্চিত হয়ে গেলাম, ভয়াবহ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আ. আলিম পাগলাঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন। ৩০০-৪০০ জন ব্যারাক থেকে নিচে এলেন। আমরা বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নিলাম। ভবনের ছাদ, ব্যারাক, পুকুরপাড়, মালিবাগ রাস্তার পাশ, শান্তিবাগ, চামেলীবাগ প্রভৃতি এলাকায়। রাত ১১টার দিকে আর্মিরা শান্তিনগর মোড় পার হলো। সেখানে ব্যারিকেড থাকায় প্রতিরোধে পড়ে সেনাবাহিনী। আমরা তিনতলা থেকে গুলি ছুড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে দুই সৈনিক মারা গেল। আর্মিরা ছুড়তে থাকে হাজার হাজার গুলি, মেশিনগান কেঁপে ওঠে ভয়াবহ শব্দে। ওই রাতেই আমি ইংরেজিতে একটা বার্তা জানিয়ে দিলাম ওয়্যারলেসের মাধ্যমে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আর্মিরা আক্রমণ করেছে, সেই বার্তাটি সারা দেশে পৌঁছে দিলাম ওয়্যারলেসের মাধ্যমে, যাতে মানুষ ঢাকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে। একসময় আমাদের গোলাবারুদ কমে আসতে থাকে। প্রতিরোধ ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে। রাত আড়াইটার দিকে মিলিটারিরা পুলিশের চারটি ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই রাতে আমাদের এক শ থেকে দেড় শ জন মারা যায়। রাত ৪টার দিকে আমরা পানির ট্যাংকের নিচে পালাই। সেখান থেকে মিলিটারিরা আমাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে। আমাদের রাজারবাগে বন্দি করে রাখা হয়। তিন দিন আমাদের ওপর চরম নির্যাতন করেছে। ২৮ মার্চ বিকেল ৩টা পর্যন্ত এই তিন দিনে আমাদের কিছু খেতে দেওয়া হয়নি, এমনকি পানি পর্যন্ত না। ২৮ মার্চ বিকেলে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের জিম্মায় আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
বাবাকে আমার চোখের সামনে কপালে গুলি করে
আবু মুসা ম মাসুদউজ্জামান জাকারিয়া মাসুদ
অধ্যাপক আবু নাসের মোহাম্মদ মনিরউজ্জামানের ছেলে
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় সেনাবাহিনীর চারটি ট্রাক বের হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ট্রাকটি আসে তা প্রথমেই ঢুকে পড়ে আমাদের আবাসিক কোয়ার্টারে। এ সময় মিলিটারিদের সহায়তা করেছিলেন বাবার কলিগ ও একসময়ের ছাত্র ড. ওবায়দুল্লাহসহ (আসকার ইবনে শাইখ) চারজন। আসকার ইবনে শাইখ সেনাবাহিনীর মাইক দিয়ে ঘোষণা করেন—‘প্রফেসর মনিরুজ্জামান, জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আপনারা নিচে নেমে আসুন।’ কিন্তু কেউ নিচে নামেননি। একসময় আমাদের দরজায় কড়া পড়ে। বাবা এগিয়ে আসেন। এক সেনা কর্মকর্তা বাবাকে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করে। বাবা নাম বলেন। আগে থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের কাছে তালিকা ছিল কাকে কাকে হত্যা করবে। সেই তালিকার সঙ্গে বাবার পরিচয় মিলে যাওয়ায় ওই সেনা কর্মকর্তা বাবার হাতের ডান পাশ ধরল। এরপর একে একে আমার চাচা অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান, ভাই আকরামুজ্জামান, আমাদের ফুফাতো ভাই সৈয়দ নাসিরুল ওয়াহাবকে বের করে নিয়ে যায়। সে সময় আমাকেও নিয়ে যাওয়া হলো। ঊর্ধ্বতন এক সেনা কর্মকর্তা বাবাকে মাটিতে বসতে বলল। বাবা কথা শুনলেন না, সঙ্গে সঙ্গে বেয়নেট দিয়ে পায়ের অংশ অনেকখানি ফেড়ে ফেলা হলো। এরপর বাবাকে আমার চোখের সামনে কপালে গুলি করে। বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চাচাকে পর পর দুটি গুলি করে, ভাইকে তলপেটে গুলি করা হয়। এরপর গুহঠাকুরতার বাসায় যায় মিলিটারিরা। গুহঠাকুরতাকে কানের নিচের অংশে গুলি করা হয়। এরপর মিলিটারিরা চলে যায়। মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। একসময় অন্ধকারে ভেসে আসে একটা আর্তনাদ, ‘আমাকে কি জল দেবে, বাসন্তী।’ মা এগিয়ে গিয়ে জানতে চান, ‘আপনি কে?’ তখন তিনি বললেন, ‘আমি নিচতলার গুহঠাকুরতা। আপনার বউদিকে ডেকে দেবেন?’ মা নিচে এসে দেখেন, বাবার লাশ পড়ে আছে। আমার বয়স অল্প হওয়ায় ওই সময় একজন সেনা কর্মকর্তা আমাকে ছেড়ে দেয়। এরপর তারা চলে যায় জগন্নাথ হলের দিকে। সেখানে চালানো হয় নির্বিচার গুলি। জগন্নাথ হলের ওখানে বাবার লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে আরো অগণিত লাশ রাখা হয়। লাশ টানার জন্য হলের সাধারণ ছাত্রদের ব্যবহার করে তারা। লাশ টানা শেষে ওই ছাত্রদের লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। আমাকে দ্বিতীয়বার ধরে আনার পর ওই লাইনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রাতে যে কর্মকর্তা আমাকে ছেড়ে দেয় সে আমাকে দেখে চিনতে পারে। এরপর আমাকে লাইন থেকে সরিয়ে নেওয়ার পরপরই ব্রাশফায়ার করা হয়। পুরো লাইনের সব মানুষ মারা যায়, বেঁচে ছিল শুধু একটি ছাত্র। সে সময় তার হাতে গুলি লাগে। এরপর পড়ে থাকা লাশগুলো গণকবর দেওয়া হয় জগন্নাথ হলের মাঠে।
পুলিশ একটা গুলি ছোড়ে আর ওরা ছোড়ে হাজার হাজার
শাহীন রেজা নূর
নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক
২৫ মার্চ থেকেই নানা কথা শোনা যাচ্ছিল। আশা ছিল, ভয় ছিল, নিরাশা ছিল। এভাবে দোলাচলে কাটছিল ঢাকার বেশির ভাগ মানুষের সময়। না-জানি কী হয়। আবার আশার বাণীও শোনা যাচ্ছিল—এবার বোধ হয় ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা ফলপ্রসূ হলো। আমার বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেন তখন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক। সে সময় আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি। ২৫ মার্চ বিকেলে বাবা আমাকে বাজার করে আনতে বললেন। শোনা যাচ্ছিল, মিলিটারি ক্র্যাকডাউন হতে পারে। এটা হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নাগালে পাওয়া যাবে না, খাদ্যাভাব দেখা দেবে। এই ভেবে বাবা আমাকে পাঠালেন চাল কিনতে, যাতে চালের সংকট না পড়ে। কারণ আমাদের পরিবারে আট ভাই, এ ছাড়া ফুফু ও তাঁর ছেলে-মেয়েও আমাদের বাড়িতে এসেছে। আমি বিকেলের দিকে চাল কিনতে গেলাম। আমার মনে আছে, ১০০ টাকা দিয়ে আড়াই মণ চাল কিনেছিলাম। সঙ্গে কেরোসিন তেলও। পুরো শহরে কেমন যেন থমথমে ভাব। ছাত্রলীগ নেতারা, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা—নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, তাঁরা বাবার কাছে টেলিফোন করছেন, পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিক্ষিপ্ত খবর আসছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যার দিকে ভুট্টো, ইয়াহিয়া চলে গেলেন। বোঝা গেল, ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে যৌক্তিক কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এই খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল জনতা। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ঝাঁকে ঝাঁকে। কেউ কেউ সড়কে ব্যারিকেড দেওয়া শুরু করল। শোনা যাচ্ছিল স্লোগান—‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। আমিও যোগ দিলাম এ রকম একটি ব্যারিকেডে। স্লোগান দিচ্ছি, বিভিন্ন রকম গাড়ি সরিয়ে দিচ্ছি, আবার ব্যারিকেড দিচ্ছি। রাত সাড়ে ৮টা কিংবা ৯টার দিকে পুরো ঢাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। বন্ধ করে দেওয়া হয় টেলিফোন সংযোগ। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস থেকে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য চামেলীবাগে আমাদের বাসাসহ আশপাশের বাসার ছাদে অবস্থান নেয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে মালিবাগ-শান্তিনগর সড়কে ঢুকে পড়ে মিলিটারির ট্রাক-জিপ। রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি দিয়ে একটি গুলি ছোড়ে আর ওরা গুলি ছুড়তে থাকে হাজার হাজার। আতঙ্কে আমাদের বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করছে। এভাবে প্রতিরোধযুদ্ধ চলার একপর্যায়ে রাত ২টার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়। আমরা দেখতে পাই, পুলিশ ব্যারাকে আগুন জ্বলছে। শান্তিনগর বাজারে মিলিটারিরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। চাল পুড়েছে, ডাল পুড়েছে, তরিতরকারি সব পুড়ে গেছে।
সম্পর্কিত খবর