বাক্সের মতো দেখতে 'পালকি'-ই ছিল ঢাকার আদি বাহন। ছোট আকারের পালকি বহন করতে চারজন আর বড় আকারের জন্য লাগত আটজন বাহক। প্রথম দিকে এটি ছিল ধনীদের চলাচলের মাধ্যম। পরে সাধারণ মানুষরাও এর ব্যবহার শুরু করে।
ঢাকার জনপরিবহন
ঢাকার জনপরিবহন ব্যবস্থার বয়সকাল প্রায় দেড় শ বছর হতে চলল। পালকি, রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে শুরু করে বাস, অটোরিকশা, ট্যাক্সিতে চড়ছে আজকের ঢাকাকাসী। এসব বিবর্তনের কথা জানাচ্ছেন শামীম আমিনুর রহমান ও রিদওয়ান আক্রাম

ইঞ্জিনচালিত গাড়ি রাস্তায় নামার আগে বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি চলেছে দীর্ঘকাল।
প্রকৃত জনপরিবহন ব্যবস্থার জন্য ঢাকাবাসীকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে চালু করার কৃতিত্ব ঢাকার আর্মেনি ব্যবসায়ী সিরকোরসের।
১৮৮৫ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও পরের বছর ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বিস্তৃত হয়।
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার অন্যান্য অঞ্চল থেকে ঢাকা আসা সহজ হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক কারণেই ঢাকায় জনবাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার বেড়ে যায়।
বিশ শতকের প্রথম থেকেই ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি ও জমিদাররা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য গাড়ি ব্যবহার করতেন।
পরিবহন ব্যবসার প্রথম সারিতে ছিলেন সর্দার মাওলা বখশ। তাঁর গাড়ি চলত ঢাকা-কালিয়াকৈর, ঢাকা-নয়ারহাট, ঢাকা-মিরপুর, ঢাকা-ডেমরা ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রবাহিনী বিশেষ করে মার্কিন বাহিনী অনেক গাড়ি ও ট্রাক নিলামে বিক্রি করে দেয়। এসব গাড়ি কিনে সেগুলোতে বডি জুড়ে দিয়ে বাসে রূপান্তর করা হয়। এসব বাসের বডি কাঠের ফ্রেমের সঙ্গে টিন মুড়ে দিয়ে তৈরি হয়েছিল বলে অনেকেই এগুলোকে বলত 'মুড়ির টিন'। ১৯৪৭ সালের আগে ঢাকা পৌরসভার আওতায় ১০০ মাইলেরও কম রাস্তা ছিল। এর অর্ধেক ছিল সিমেন্ট বা পিচঢালা। বাকি রাস্তাগুলো ছিল কাঁচা। অভ্যন্তরীণ গণপরিবহন হিসেবে তখন মোটরগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি এবং স্থানীয়ভাবে নির্মিত কয়েকটি বাস (মুড়ির টিন) দেখা যেত। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এসব 'মুড়ির টিন' রামপুরা থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চলাচল করত।
১৯৪৮ সালে ফুলবাড়িয়া থেকে চকবাজার পর্যন্ত বাস চলত। ঢাকার বাইরে যাতায়াতের জন্য প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে। ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসে যুক্ত হয় 'ডাবল ডেকার' বাস। তবে স্থানীয়ভাবে এটি 'দোতলা বাস' নামে পরিচিতি পায়। এসব বাস আনা হয়েছিল যুক্তরাজ্য থেকে। লাল রঙের গাড়িগুলো ঢাকাবাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিল। দেশ স্বাধীনের পর ভারত থেকে কিছু অশোক-লেল্যান্ডের তৈরি ডাবল ডেকার বাস আমদানি করা হয়। যার হাতেগোনা কয়েকটি এখনো দেখা যায়। বেশ কয়েক বছর আগে ইউরোপ থেকে বেশ কিছু ডাবল ডেকার আনা হয়েছিল, যা এখন আর তেমন রাস্তায় দেখা যায় না। জনবাহন হিসেবে ডাবল ডেকার বাসে প্রথম চড়ার অভিজ্ঞতা অনেকের মনেই দাগ কেটেছিল। ১৯৯০ সালের শেষ দিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিলাসবহুল বাস ও ট্যাক্সির প্রচলন হয়। গত বছর ঢাকায় প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে আরটিকুলেটেড বাস সার্ভিস। যা দেখতে অনেকটা ট্রেনের মতো। মূলত দুটি বাস সংযোজন করে এটি তৈরি করা হয়।
ঢাকার আরেক জনপ্রিয় বাহন 'রিকশা'। কম খরচে চলাচল করা যেত বলে দ্রুত এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা পৌরসভার রেকর্ড অনুযায়ী ১৯৪১ সালে রিকশার সংখ্যা ছিল মোটে ৩৭টি। পরে ঢাকায় রিকশার সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে একসময় ঢাকা পরিচিতিই পায় 'রিকশার নগরী' হিসেবে। সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তন এসেছে রিকশায়ও। মূল কাঠামো ঠিক রেখে সংযোজিত হয়েছে ইঞ্জিন। গতির কারণে এই রিকশা গ্রহণযোগ্য হলেও মাঝেমধ্যে এই অনিয়ন্ত্রিত গতিই জন্ম দেয় নানা দুর্ঘটনার।
রিকশার পাশাপাশি মধ্যবিত্তের কাছে জনপ্রিয় আরেক বাহন 'অটোরিকশা'। পাকিস্তান আমলে চালু হওয়া এই বাহনটি পরিচিতি পায় 'বেবি ট্যাক্সি নামে। হলুদ আর কালো রঙের এই বেবি ট্যাক্সি ছিল টু স্ট্রোকের। পরিবেশদূষণের কারণে সরকার ২০০২ সালের পর থেকে এই বাহন ঢাকায় চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়। এরপর ঢাকা শহরে চালু হয় প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজিচালিত সবুজ অটোরিকশা।
ঢাকায় বিভিন্ন সময় চালু হয়েছে ট্যাক্সি সার্ভিস। তবে সরকারের যথাযথ দেখভালের অভাবে এটি প্রয়োজন থাকা সত্ত্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।
সম্পর্কিত খবর