ঢাকা, মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৯ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৯ মহররম ১৪৪৭

দেশের বিপন্ন প্রাণী

  • চয়ন বিকাশ ভদ্র, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
দেশের বিপন্ন প্রাণী

একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির জীববিজ্ঞান প্রথম পত্র অর্থাৎ উদ্ভিদবিজ্ঞান বইয়ের দ্বাদশ অধ্যায়ের শিরোনাম হলো জীবের পরিবেশ, বিস্তার ও সংরক্ষণ। এই অধ্যায়ে বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় জীবের পরিচিতি শিক্ষার্থীদের জানা প্রয়োজন।

বাঘ

জীববৈচিত্র্য খাদ্যশৃঙ্খল ও প্রতিবেশচক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়েও সুন্দরবনে বাঘ ভালো নেই। বিশ্বব্যাপী বাঘের বিপন্নতার হাত ধরে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারও মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

বিশ্ববাসী বাঘ রক্ষায় সোচ্চার হলেও টাইগার কান্ট্রির অন্যতম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে কার্যকর ও যথোপযুক্ত উদ্যোগের অভাব রয়েছে। এ কারণে বাঘের আশ্রয়স্থলে হস্তক্ষেপ, চোরাশিকারিদের উপদ্রব, বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব, খাদ্যশৃঙ্খলে ব্যত্যয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, সর্বোপরি বাঘের প্রতি জিঘাংসাপরায়ণ মনোভাব হিংস্র অথচ অনিন্দ্যসুন্দর জাতীয় প্রাণীটির বেঁচে থাকাই সংকটাপন্ন করে তুলেছে। সুন্দরবনে বাঘের হোম রেঞ্জ মোটামুটিভাবে ১৪-১৬ বর্গকিলোমিটার। এই বিবেচনার সুন্দরবনের হোম রেঞ্জ ছোট হওয়ায় ধারণা করা হয়, বিশ্বে সুন্দরবনে বাঘের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি এবং তা মোটামুটি স্থিতিশীল।
এরই মধ্যে পৃথিবী থেকে বাঘের তিনটি উপ-প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। পাঁচটি উপ প্রজাতির বাঘ কোনো রকম অস্তিত্বের সংকটেও টিকে আছে। সুন্দরবনে Panthera tigris প্রজাতির রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দশকে সুন্দরবনসহ পৃথিবী থেকে বাঘ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাঘ সংরক্ষণে বিশ্বব্যাংকসহ গ্লোবাল টাইগার ইনিশিয়েটিভ, গ্লোবাল টাইগার ফোরাম ও উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় সরকার দেশে জাতীয় বাঘ পুনরুদ্ধার কর্মসূচি (এনটিআরপি) এবং বাংলাদেশ বাঘ কর্মপরিকল্পনা (২০০৯-২০১৭) বাস্তবায়ন করছে। বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং জামিন অযোগ্য এ আইনে বাঘশিকারি বা হত্যাকারীর দুই থেকে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

 

মেছোবাঘ

বিড়ালগোত্রীয় স্তন্যপায়ী বন্য প্রাণী। বৈজ্ঞানিক নাম Prionailurus viverrinus. বাংলাদেশে এরা মেছোবাঘ নামে পরিচিত। এদের আবাসস্থল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।

বিগত কয়েক দশকে মেছোবাঘের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। জনবসতি স্থাপন, কৃষিজমিতে রূপান্তর ও অন্যান্য কারণে মেছোবাঘের আবাসস্থল জলাভূমিগুলো দিন দিন সংকুচিত ও হ্রাস পাওয়াই এর মূল কারণ। আইইউসিএন ২০০৮ সালে মেছোবাঘকে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। মেছোবাঘ সাধারণত নদীর ধারে, পাহাড়ি ছড়া ও ম্যানগ্রোভ জলাভূমিতে বাস করে। এরা সাঁতারে পারদর্শী বিধায় এ ধরনের পরিবেশে সহজেই খাপ খাওয়াতে পারে।

 

 

গয়াল

বৈজ্ঞানিক নাম Bos frontalis. পার্বত্য চট্টগ্রামের পাবলাখালী, সাজেক ভ্যালি ও মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন পাহাড়ি বনে গয়ালের বিচরণ রয়েছে। মাঝেমধ্যে আদিবাসীরা দু-একটি গয়ালের খোঁজ পায় এবং শিকার করে বলেও জানা গেছে। ১৯৬৭ সালে গাই মাউন্টফোর্ট তৎকালীন পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের বন্য প্রাণীর ধরন জানতে পাবলাখালীতে গয়ালের সন্ধান পান এবং ছবি তোলেন। গি ও মাউন্টফোর্ট উভয়েই গয়ালকে গাউর ও দেশি গরুর মিশ্রণ বলে শনাক্ত করেন; কিন্তু গয়াল বন্য পরিবেশে থাকতে অভ্যস্ত। ভোর থেকে শেষ রাত পর্যন্ত এরা পাহাড়ি জঙ্গলের প্রান্তে দ্রুত খাবার খায় মাংসাশী জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য। দিনের বেলায় ঘনজঙ্গলে জাবর কাটে। শক্ত ও কর্কশ ঘাস খাওয়ায় এদের দাঁত দ্রুত ক্ষয় হয়। এই ক্ষয়পূরণে এদের ক্ষার ও লবণযুক্ত মাটি খেতে হয়। অবশ্য লবণ খায় অন্ত্রের পোকা কমানোর জন্য।

 

শুশুক

বৈজ্ঞানিক নাম Platanista gangetica. আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের নদীগুলোতে অনেক শুশুক বা ডলফিন দেখা যেত। এখন আর দেখা যাচ্ছে না। ১৯৯৬ সাল থেকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নাম উঠে গেছে শুশুকের। নদীতে বাঁধ দেওয়া, সেতু তৈরি ইত্যাদি কারণে নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে শুশুকের আবাস ও প্রজননস্থল। আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর অনেক জায়গায় পলি পড়ে গেছে। ফলে শুশুকরা এখানে চলে এসে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। শুশুক রক্ষায় আড়াই বছর আগে সুন্দরবনের অন্তর্গত ৩১ কিলোমিটার জলজ এলাকায় অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে সরকার। তবে বাস্তবায়নের কাজ এখনো শুরু হয়নি। বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সেটাসিয়ান ডাইভারসিটি প্রজেক্ট বা বিসিডিপি সরকারের বন বিভাগের সহায়তায় অভয়ারণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। বিসিডিপির উদ্যোগে সুন্দরবন এলাকায় গত পাঁচ বছর ধরে শুশুক মেলা হচ্ছে। এর মাধ্যমে শুশুক রক্ষায় জনসাধারণকে সচেতন করার চেষ্টা চলছে।

 

বনরুই

বনরুই আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। মুখে দাঁত না থাকায় আগে দাঁতহীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। পিঁপড়া ও পিঁপড়াজাতীয় প্রাণী খায় বলে এটি আঁশযুক্ত পিঁপড়াভুক নামেও পরিচিত। বনরুই আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। পৃথিবীতে সাত প্রজাতির বনরুই রয়েছে। এশিয়ায় আছে তিন প্রজাতির। তিনটিই বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এরা প্রধানত চিরসবুজ ও আধা চিরসবুজ বনে থাকে। দেশি ছাড়া অন্য দুটি প্রজাতি সব জায়গায় দেখা যায় না। চীনা প্রজাতিটি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট এবং মালয় বনরুই শুধু সিলেটের জঙ্গলে বাস করে। অত্যন্ত লাজুক ও নিশাচর বলে এ দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যায় থাকা সত্ত্বেও প্রকৃতিতে বনরুইয়ের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তিন প্রজাতির বনরুইয়ের মধ্যে আকারে দেশিগুলোই বড়। মাটিতে বাস করলেও গাছে চড়তে ওস্তাদ, বিশেষ করে চীনা ও মালয়গুলো। বনরুই অত্যন্ত অলস ও ধীরগতিসম্পন্ন প্রাণী। গারো পাহাড়, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে বনরুই দেখতে পাওয়া যায়। বনরুই বর্তমানে এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে। কারণ কোনো কোনো আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে এদের মাংস অত্যন্ত প্রিয়। তা ছাড়া কিছু ভণ্ড কবিরাজ বনরুই মেরে দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে তথাকথিত ওষুধ তৈরি করে এদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। কাজেই বিলুপ্তির হাত থেকে এদের রক্ষা করার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

 

উল্লুক

বিপন্ন নিরীহ প্রাণী উল্লুক। বৈজ্ঞানিক নাম Hoolock hoolock. বাংলাদেশের লাউয়াছড়া, সাতছড়িসহ পাহাড়ের দু-একটি বনে এদের দেখা মেলে। তবে সংখ্যায় খুবই কম। বনে এদের দেখা পাওয়া দুষ্কর; দিনের বিশেষ সময়ই শুধু এরা বের হয়। থাকে গাছের মগডালে।

প্রাণীটি যে বিপন্ন এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ নেই। সচেতন না হলে দক্ষিণ এশিয়ার এ বিশেষ প্রজাতিটি যে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। লাউয়াছড়া বনাঞ্চল হচ্ছে উল্লুুকদের শেষ নিশ্চিত আবাসস্থল, যেখানে বর্তমানে ১৬টি পরিবারে মোট ৫৯টি উল্লুক বাস করছে। এ বনের আকার এর চেয়ে বেশি উল্লুককে স্থান দিতে সক্ষম নয়। আইইউসিএন উল্লুককে একটি বিপন্ন প্রাণী হিসেবে শ্রেণিবিন্যস্ত করেছে। প্রতিটি উল্লুকের পরিবারের একটি নির্দিষ্ট বিচরণ এলাকা আছে। সম্মিলিত গানের মাধ্যমে তারা এর আধিপত্য ঘোষণা করে। তাদের জীবন নির্ভর করে বড় গাছের চিরসবুজ বনের ওপর। গাছ কাটা মানেই এদের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনা।

 

 

ঘড়িয়াল

বৈজ্ঞানিক নাম Gavialis gangeticus. বর্তমানে বলতে গেলে ঘড়িয়াল চিড়িয়াখানায় সীমাবদ্ধ। পদ্মা, যমুনায় এখন আর আগের মতো ঘড়িয়াল দেখা যায় না। ঘড়িয়াল দেখতে কুমিরের মতো হওয়ায়ই ঘটেছে যত বিপত্তি। মানুষ কুমির মনে করে এদের দেখা মাত্রই আক্রমণ করে। ঘড়িয়ালের প্রধান খাদ্য মাছ হওয়ায় এদের অন্য নাম মেছোকুমির। বাংলাদেশের পদ্মা ও যমুনায় ঘড়িয়াল পাওয়া যায়। পারতপক্ষে ঘড়িয়ালের কোনো প্রাকৃতিক শত্রু নেই। ঘড়িয়ালছানা শিকারি পাখি, মাছ, কুমির ও বোয়ালজাতীয় রাক্ষুসে মাছের পেটে চলে যায়। বাংলাদেশের নদীগুলোয় ব্যাপক জায়গাজুড়ে চর পড়েছে। আর সেসব জায়গায় মানুষের বসবাস শুরু হওয়ায় ঘড়িয়ালের বংশবৃদ্ধিতে বাধা পড়েছে। এ ছাড়া নির্বিবাদে হত্যা ও সরকারের উদাসীনতার কারণে বর্তমানে ঘড়িয়াল আমাদের দেশে বিলুপ্তপ্রায়। বিপন্ন এসব প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। কারণ আমাদের স্বার্থেই তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ