বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় সরকারি জমি দখলের গতি থামছে না। কেউ দখল করছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ। কেউ বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মালিকানাধীন জমি। দখলকারীরা সরকারি কর্মচারী হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না! দখল বৈধ করতে তাঁরা
তৈরি করছেন নানান কাগজপত্রও।
বিস্তারিত জানাচ্ছেন : মনু ইসলাম, বান্দরবান
বান্দরবানে সরকারি জমি দখল চলছেই। দখলবাজির মধ্যে সবচেয়ে বেশি হুমকির মধ্যে রয়েছে আলীকদমের ভরিরমুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পুরাতন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভরিরমুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মালিকানাধীন জায়গা দখল করছেন পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসকারী কয়েকজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক। অন্যদিকে সরকারি কর্মচারী হিসেবে মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে পুরাতন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোয়ার্টার বরাদ্দ নিয়ে এখন তা দখল করে আছেন সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক।
উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভরিরমুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি বর্তমানে সেখানে ঘরবাড়ি নির্মাণ এবং স্কুলের জমি অন্যদের কাছে বিক্রি করে দখল বুঝিয়ে দিচ্ছেন। একের পর এক জমি বেদখল হয়ে যাওয়ায় স্কুলের খেলার মাঠটি ক্রমশঃ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে ভরিরমুখ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এ সময় ২৮৯ নম্বর চৈক্ষ্যং মৌজার ১২৮ নম্বর হোল্ডিংভুক্ত (পরবর্তীতে ১১৫ নম্বর খতিয়ানের দাগ নম্বর-৭০২) জমি থেকে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ভরিরমুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে ১ একর ৬০ শতাংশ জমি বন্দোবস্তি প্রদান করেন।
সরকারি বরাদ্দ পাওয়া জমির একপাশে একটি টিনশেড ভবন তৈরি করে সেখানে শ্রেণি কর্যক্রম শুরু হয়। পরে সেখানে একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সরকারি জমি দখল করার সাথে জড়িত স্কুলের পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ, মাওলানা আবদুল মান্নান, মোহাম্মদ হোসেন ও আবদুল হান্নান জড়িত। ইতোমধ্যে তাঁরা ১ একর ২০ শতক জমি নিজেদের দখলে নিয়ে গেছেন। দখল করা জমিতে তাঁরা ঘরবাড়ি তৈরি, জমি বিক্রি ও কিছু জমিতে চাষাবাদ করছেন।
দেলোয়ার হোসেন নামে স্থানীয় একজন বাসিন্দা অভিযোগ করেন, স্কুলের জমি বেহাত হয়ে যাওয়ার বিষয়ে তাঁরা জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করেছেন। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনো প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেননি।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিদ্যালয় ভবনের সামনের বিশাল খেলার মাঠটি বর্তমানে সর্বোচ্চ ৪ শতক জমিতে এসে ঠেকেছে। একের পর এক বেদখল হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে স্কুলের দখলে থাকা মোট জমির পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪০ শতক। স্কুল ভবনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সীমানায় দখলদারদের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে একটি পাকা ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। আশপাশের জমিতে করা হচ্ছে চাষাবাদ।
দেলোয়ার হোসেন জানান, স্কুলের সীমানা প্রাচীর না থাকায় যে যাঁর মতো করে স্কুলের জমি গ্রাস করছে। দীর্ঘদিন ধরে স্কুলের জায়গা দখল করে কয়েকজন প্রভাবশালী বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার করলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন তা বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলাম জানান, স্কুল পরিচালনা কমিটির নির্লিপ্ততার সুযোগে স্থানীয় দুজন স্কুল শিক্ষক এবং তাঁদের কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন মিলে স্কুলের ১ একর ২০ শতক জমি দখল করে নিয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়, বর্তমানে দখলদাররা এসব জমি তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে দাবি করছেন। এদিকে ভরিরমুখ স্কুলের জমির অন্যতম দখলদার শিক্ষক আবদুল হান্নান জানান, ১৯৫৮-৫৯ সালে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর বাবার মালিকানাধীন ৬৩০ নম্বর রিজামশন মামলা মূলে সরকার ২৮৯ নম্বর চৈক্ষ্যং মৌজার ৩৩ নম্বর খতিয়ানের ৪ একর ৬৩ শতক জমি খাস করে ওই জমি থেকে ১ একর ৬০ শতক জমি ভরিরমুখ স্কুলের নামে বরাদ্দ দেয়। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে ওই রিজামশান মামলার বিরুদ্ধে তাঁরা আদালতে রিভিউ মোকাদ্দমা করেন। ১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক আদেশে তৎকালীন জেলা প্রশাসক তাঁর দেওয়া জমি খাস করার রিজামশান মোকাদ্দমার আদেশ বাতিল করে দিয়েছেন। ফলে আইন অনুযায়ী বর্তমানে ওই জমির মালিকানা ভরিরমুখ স্কুলের থাকার কোনো কারণ নেই। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ইস্কান্দর নুরী জানান, স্কুলের জমি দখলের বিষয়টি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়েছে। ঊর্ধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আলীকদমে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জমি কর্মচারীর দখলে : উপজেলার পুরাতন সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১০ শতক জমি অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মচারীর অবৈধ দখলে চলে গেছে। উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েও কর্মচারীর কাছ থেকে জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অভিযোগ ওঠেছে, হাসপাতালের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ইয়াছিন শরীফ ও তাঁর স্ত্রী সরকারি জমিটি কর্তৃপক্ষের কোনো বৈধ অনুমতি ছাড়ায় তাঁদের দখলে রেখেছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৮২ সালে আলীকদমকে মানোন্নীত থানা ঘোষণার পর সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ২৮৮ নম্বর আলীকদম মৌজার ৭ নম্বর সিটের দাগ নং-৯৭৪, ৯৭৫, ৯৭৬ এর আন্দর ৬৪ শতক জমিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবকাঠামো নির্মিত হয়। সেই থেকে ৬৪ শতক জমি স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে থাকায় কর্তৃপক্ষ সরকারকে নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর দিচ্ছে।
১৯৯৪ সালে উপজেলা সদরের চৌমুহনীতে নতুন ভবন নির্মাণের পর থেকে নতুন ঠিকানায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্থানান্তর হয়। এরপর থেকে অফিস আদেশ প্রদানের মাধ্যমে পুরাতন হাসপাতাল ভবন ও টিনশেড কোয়ার্টারগুলিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মচারীদের কাছে বাসা হিসেবে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। কয়েক বছর আগে পুরাতন হাসপাতালের একটি অংশে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা ভবন নির্মিত হয়। কিন্তু দখলদারকে উচ্ছেদ না করেই পুরাতন হাসপাতালের জমির মাঝখানে ভবনটি নির্মিত হওয়ার ফলে ভবনের উত্তর অংশে প্রায় ১০ শতক জমি অবৈধ দখলে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেই সময়ে পুরাতন হাসপাতালের উত্তরের টিনশেড ঘরটি ভাড়া নেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আয়া জোহরা বেগম। ২০০০ সালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ইয়াছিন শরীফের সাথে ওই আয়ার বিয়ে হওয়ার পর থেকে তাঁরা পুরাতন হাসপাতালের বরাদ্দ নেওয়া কোয়ার্টারে একসঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি সম্পদ রক্ষায় উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের উদাসীনতার সুযোগে ভাড়ায় ব্যবহার করা কোয়ার্টার ও পাশের জমিটি নিজেদের দখলে নিতে অপতৎপরতা শুরু করেন তাঁরা।
২০১০ সালে ইয়াছিন শরীফের স্ত্রী জোহরা বেগম আয়া পদ থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি গ্রহণ করলেও তাঁর নামে বরাদ্দ দেওয়া সরকারি কোয়ার্টারটি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে না দিয়ে নিজেদের দখলে রেখেছেন।
এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কোয়ার্টারসহ পার্শ্ববর্তী ১০ শতক জমি নিজেদের নামে বন্দোবস্তি নেওয়ার কৌশল হিসেবে ইয়াছিন শরীফ মৌজা হেডম্যানের কাছ থেকে গোপনে রিপোর্ট নিয়ে রেখেছেন।
২০১৩ সালে বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের দেওয়া এক আদেশবলে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসাদুজ্জামান সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ইয়াছিন শরীফকে সরকারি হাসপাতলের জমি থেকে উচ্ছেদের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তিনি অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়ার কারণে উচ্ছেদ উদ্যোগটি স্থগিত হয়ে যায়।
সম্প্রতি দখলদার ইয়াছিন শরীফ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘রেকর্ড অনুযায়ী আমার দখলীয় জমিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নয়। এটি একটি খাস খতিয়ানভুক্ত জমি। বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী সংশ্লিষ্ট মৌজা হেডম্যানকে দাখিলা ফি জমা দিয়ে ওই জমি ভোগ দখলে আছি।’
জানতে চাইলে শরীফের বক্তব্যকে সত্য হিসেবে স্বীকার করে ২৮৮ নম্বর আলীকদম মৌজার হেডম্যান অংহ্লাচিং মারমা ইয়াছিন বলেন, ‘বিদ্যমান মাঠ খসড়ায় পুরাতন হাসপাতালের দাগে কিছু খাসজমি থাকায় ইয়াছিন শরীফকে ওই জমি থেকে কিছু জমি বন্দোবস্তি দিতে আমি রিপোর্ট দিয়েছি। তবে খাসজমি বন্দোবস্তি দেওয়ার দায়িত্ব আমার নয়। আইন অনুযায়ী বন্দোবস্তি দেওয়ার ক্ষমতা জেলা প্রশাসকের। দাবি উপযুক্ত মনে করলে তিনি বন্দোবস্তি দেবেন। আইনসম্মত না হলে ইয়াছিন শরীফের বন্দোবস্তির আবেদন স্বাভাবিকভাবেই বাতিল হয়ে যাবে।’
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা. অং সুই প্রু মারমা জানান, ‘আলীকদমে নতুন অবস্থানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণের পর পুরাতন হাসপাতালের ভূমি ও অবকাঠামো পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের অনুকূলে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
স্থানীয় প্রভাবের কারণে অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তারা ভূমি রক্ষার মতো বিষয়ে কুলিয়ে ওঠতে পারছেন না স্বীকার করেন সিভিল সার্জন।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের ভূমি বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল আফসার বলেন, ‘অতীতের ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে কাটিয়ে সরকারি ভূমি রক্ষা ও দখলমুক্ত করার জন্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বিরোধীয় জায়গাগুলোতে আমাদের সার্ভেয়ারকে পাঠিয়ে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’