ঢাকা, শনিবার ১৯ জুলাই ২০২৫
৪ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৩ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, শনিবার ১৯ জুলাই ২০২৫
৪ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৩ মহররম ১৪৪৭

মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন

  • বিধান চন্দ্র দাস
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন

জাতিসংঘের দেওয়া (ওয়ার্ল্ড সয়েল ডে, ২০২২ ওয়েবপেজ) হিসাব অনুযায়ী একটি টেবিল চামচ পরিমাণ উর্বর মাটিতে বসবাস করে ৮০০ কোটিরও বেশি জীব! শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি বিজ্ঞানীদের করা হিসাব। কাজেই মাটিকে শুধু নিরেট জড় পদার্থ হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। এখন থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগে (১৯১১) পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (যুক্তরাষ্ট্র) বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী প্রফেসর উইলিয়াম হার্সবার্গার (১৮৬৯-১৯২৯) সায়েন্স পত্রিকায় ‘মাটি, এক জীবন্ত জিনিস’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। আসলে তিনি উর্বর আর অনুর্বর মাটিকে তুলনা করে উর্বর মাটিকে জীবন্ত আর  অনুর্বর মাটিকে মৃত বলে উল্লেখ করেছিলেন।

তাঁর এই তুলনার ১০০ বছরের বেশি সময় পরেও মৃত্তিকাবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিজ্ঞানী ও নানা ধরনের সংস্থা মাটিকে জীবন্ত হিসেবে বিবেচনা করে তাকে বাঁচিয়ে রাখার আবেদন জানাচ্ছে।

মাটিতে বসবাসকারী জীব নিয়ে গঠিত হয়েছে বিশাল মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্যজগৎ। মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্যকে তাদের আকৃতি-প্রকৃতি অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করা হয় এবং এদের কাজও চার ভাগে বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে : ১. ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণী (ব্যাঙ, ইঁদুর, খরগোশ ইত্যাদি)।

এরা সাধারণত মাটি ওল্টানো ও মাটি বিন্যাসের কাজ করে। ২. অমেরুদণ্ডী প্রাণী (কেঁচো, উইপোকা, পিঁপড়া ইত্যাদি)। এরা প্রধানত মাটির পানি নিষ্কাশন ও মাটির মধ্যে বাতাস চলাচলে সাহায্য করে। ৩. আণুবীক্ষণিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী (কলেমবোলা, নেমাটোড, মাইটস ইত্যাদি)।
এই ধরনের প্রাণী বিভিন্ন জিনিসের পচন নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। ৪. অণুজীব/ক্ষুদ্র জীব (ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়ানস, ফানজাই ইত্যাদি)। এরা জীব-ভূ-রাসায়নিক চক্র বজায় রাখে।

মাটি জীবন্ত বা উর্বর রাখার জন্য মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যময় উপস্থিতি প্রয়োজন। ভারসাম্যময় অবস্থায় এরা আমাদের নানা ধরনের সেবা প্রদান করে থাকে।

তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাটি  তৈরি, মাটির গঠন উন্নয়ন, পুষ্টি চক্র তৈরি, পানি ধরে রাখা ও তাকে বিশুদ্ধ করা, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ, মৃত্তিকাদূষণ প্রতিকার, ওষুধের উৎস, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ইত্যাদি। বলা হয়ে থাকে, মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্য আছে বলেই পৃথিবীর জীব-ভূ-রাসায়নিক চক্র বজায় আছে এবং এর ফলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকে আছে। সমুদ্রের পর বিশ্বব্যাপী মৃত্তিকা হচ্ছে দ্বিতীয় বড় কার্বন আধার। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাব অনুযায়ী, মাটির ওপর থেকে ৩০ সেমি নিচ পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি কার্বন আছে। আর এই কার্বন জমাকরণে মাটিতে থাকা অণুজীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতপক্ষে মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্য তাদের নানা কর্মকাণ্ড সম্পাদনের মাধ্যমে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বব্যাপী মাটির অবনয়ন (ডিগ্রেডেশন) ঘটেছে। এফএওর হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর ৩৩ শতাংশ মাটির অবনয়ন ঘটেছে অর্থাৎ অনুর্বর হয়ে পড়েছে। পৃথিবীতে বছরে এক কোটি ২০ লাখ হেক্টর অর্থাৎ প্রতি মিনিটে ২৩ হেক্টর ভূমির অবনয়ন ঘটছে। ভূমিক্ষয়ের কারণে প্রতিবছর দুই হাজার ৪০০ টন উর্বর মাটি হারিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ ভূমি অবক্ষয়জনিত কারণে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অটেকসই কৃষি, বন উজাড়, দাবানল, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় উর্বর মাটির জন্য সবচেয়ে বড় ধরনের হুমকি তৈরি করেছে।

জাতিসংঘ মাটিকে অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। কারণ মাটির অবনয়ন যত দ্রুত ঘটে থাকে, তত দ্রুত মাটি তৈরি হতে পারে না। দেখা গেছে, কোনো জায়গায় এক সেমি পুরু মাটির একটি স্তর সৃষ্টি হতে ১০০ থেকে এক হাজার বছর সময়ের প্রয়োজন হয়। উদ্ভিদের জন্য যে ১৮টি রাসায়নিক উপাদান প্রাকৃতিকভাবেই পাওয়া যায়, তার ১৫টির জোগান দেয় মাটি।

কাজেই মাটি এক অমূল্য সম্পদ। আমাদের ৯৫ শতাংশ খাদ্য প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আসে মাটি থেকেই। তাই আমাদের বেঁচে থাকার জন্য মাটির উর্বরতা রক্ষা করা প্রয়োজন। আর সে জন্য দরকার ব্যাপক জনসচেতনতা। সেই লক্ষ্যে ২০১৪ সাল থেকে জাতিসংঘ প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালন করে আসছে। এ বছর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘মাটি :  যেখান থেকে খাদ্যশস্য তৈরি শুরু হয়’। জাতিসংঘের ভাষায়, এ বছর এই প্রতিপাদ্য স্থির করার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মাটি ব্যবস্থাপনায় ক্রমবর্ধমান সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যকর বাস্তুতন্ত্র ও মানবকল্যাণ বজায় রাখাসহ মাটি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমাজকে মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য উৎসাহ দেওয়া।

মাটির স্বাস্থ্য তথা উর্বরতা রক্ষার জন্য নিয়মিতভাবে মাটি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। মাটিতে জীববৈচিত্র্য, জৈব পদার্থ ও অন্যান্য উপাদান, বিশেষ করে নাইট্রোজেন, সালফার, বোরন, ক্লোরাইড, ম্যাঙ্গানিজ নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করা, সেই মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। ভূমির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার (নিবিড় কৃষি), অতিরিক্ত কর্ষণ, একক ফসল চাষ, অতিরিক্ত চারণ, বন উজাড়, নগর প্রসারণ, শিল্প ও খনিজ কার্যক্রম ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যত দূর সম্ভব এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এফএও কর্তৃক ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে পানি, বাতাস ও কর্ষণজনিত মাটিক্ষয় সীমিত করতে নিয়ন্ত্রিত কর্ষণ কিংবা কর্ষণ ছাড়াই চাষ এবং জমির মাঝে সুবিধামতো অন্যান্য গাছ (আচ্ছাদন শস্য) লাগানোর কথা বলা হয়েছে। 

অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও মাটির স্বাস্থ্য ভালো নেই। দেশের দক্ষিণের ১৯ জেলার অর্ধেক চাষের জমি লবণাক্ততার শিকার বলে জানা যাচ্ছে (কালের কণ্ঠ, ১৯ নভেম্বর ২০২২)। বাংলাদেশ মৃত্তিকা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি গ্রন্থেও দেশে মাটির স্বাস্থ্য ভালো নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘অতীতে বাংলাদেশের মাটির স্বাস্থ্য তত দিন পর্যন্ত ভালো ছিল, যত দিন এর ওপরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়নি।’ এই গ্রন্থে ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, দেশের কৃষিজমিতে অম্লত্ব বেড়েছে। অন্যদিকে ফসফরাস, পটাসিয়াম, সালফার, জিংক, বোরন ইত্যাদির পরিমাণ কমেছে। এই অবস্থা নির্দেশ করছে যে বাংলাদেশের মাটির ক্রমাগতভাবে অবনয়ন হচ্ছে। অবশ্য গ্রন্থটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেড়েছে বলা হয়েছে। গ্রন্থে নাইট্রোজেন সম্পর্কে কোনো সাল উল্লেখ না করে বলা হয়েছে যে ক্রমাগতভাবে এই উপাদানও হ্রাসমান। এই প্রকাশনায় বাংলাদেশের মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই, যদিও মাটির উর্বরতার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের সঙ্গে সেগুলোরও উল্লেখ করা হয়েছে।

আসলে বাংলাদেশে মেরুদণ্ডী প্রাণী ছাড়া অমেরুদণ্ডী প্রাণী কিংবা অন্যান্য আণুবীক্ষণিক প্রাণী বা জীব সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত খুবই অপ্রতুল। অথচ এরাই জীববৈচিত্র্যের ৮০ শতাংশেরও বেশি। সব ধরনের বাস্তুতন্ত্রের জন্য এরা অপরিহার্য জীব। এফএও থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব আন্তর্জাতিক মহল মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব স্বীকার করলেও আমাদের দেশে এসবের গুরুত্ব দেওয়া হয় না। প্রভাবশালী নেচার গ্রুপের একটি জার্নালে (নেচার কমিউনিকেশন : ২০২০) মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্যের অপরিসীম গুরুত্বের কথা তুলে ধরা হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্য বিষয়ক গবেষণাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না। বাংলাদেশে এদের বেশির ভাগ সদস্য অনাবিষ্কৃৃত। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। বাংলাদেশে মার্টির উর্বরতা নিশ্চিত করতে হলে মাটির জৈব পদার্থ ও অন্যান্য উপাদান, বিশেষ করে নাইট্রোজেন, সালফার, বোরন,  ক্লোরাইড, ম্যাঙ্গানিজ ছাড়াও মৃত্তিকা জীববৈচিত্র্যকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া মাটির অনুর্বরতা ও ক্ষয়রোধে এফএও কর্তৃক ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলো যত দূর সম্ভব বিবেচনায় নেওয়া দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, মাটি রক্ষায় আমাদের সবার সচেতনতা প্রয়োজন।

 

লেখক : অধ্যাপক (পিআরএল), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস ও ঝুঁকিতে বিনিয়োগ

    আবু তাহের খান
শেয়ার
মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস ও ঝুঁকিতে বিনিয়োগ

২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ ছিল ৪.৮৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪.৮৪ বিলিয়ন ডলারে। সদ্যঃসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এ বিষয়ক চূড়ান্ত হিসাবের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে উক্ত অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে মাত্র ২.৩৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির তথ্য থেকে এটি স্পষ্ট যে পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় আমদানির পরিমাণ অন্তত ৩৫ শতাংশ কম হবে।

এবং দেশে বর্তমানে যে ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ্যত্ব চলছে, তাতে আশঙ্কা করার সমূহ কারণ রয়েছে যে সদ্য শুরু হওয়া ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সেটি নামতে নামতে কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে?

মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস দেশে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। আর বিনিয়োগ ও উৎপাদন কার্যক্রমে ভাটা পড়লে অনিবার্যভাবেই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না এবং সেটি দেশে বিরাজমান নাজুক বেকারত্ব পরিস্থিতিকে আরো অধিক নাজুক করে তুলবে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তা রপ্তানি বাণিজ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশ যে নানা মাত্রিক কসরত চালিয়ে যাচ্ছে, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার ফলে সে কসরত যে কোনো কাজে আসবে না, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কেন কমছে? সরল জবাব হচ্ছে, দেশের বর্তমান অস্থির ও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কোনো উদ্যোক্তার পক্ষেই ঝুঁকি নিয়ে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখানো সম্ভব নয়। সেটি তারা করছেনও না এবং এর ফলে নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির প্রয়োজনও হচ্ছে না। একইভাবে বিদ্যমান উদ্যোক্তাও সেই একই কারণে তার কারখানা সম্প্রসারণের কথা ভাবছেন না। অন্যদিকে যে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না, সেই একই কারণে এখানে বিনিয়োগ করতে আসছেন না বিদেশি উদ্যোক্তারাও।

আর এটি তো বিশ্বজুড়েই সর্বজনীন সত্য যে কোনো দেশে স্থানীয় বিনিয়োগের ধারা সক্রিয় ও গতিশীল না থাকলে সে দেশে কখনো প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আসে না। অতএব এফডিআই আসছে না বলে তাদের মাধ্যমে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির বিষয়টিও স্বভাবতই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি না হওয়া তথা নতুন বিনিয়োগে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের এগিয়ে না আসার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে বিনিয়োগসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডকে জোরদারকরণের বিষয়ে সরকারের সীমাহীন নির্লিপ্ততা, যা আসলে বিনিয়োগকারীদের প্রতি এক ধরনের উপেক্ষা ও অবহেলারই শামিল। উদ্যোক্তারা হয়তো দেশে নিয়মিত রাজনৈতিক সরকার না থাকার বিষয়টিকে উপেক্ষা করতেন যদি তাঁরা দেখতেন যে সরকার অস্থায়ী হলেও তারা বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে। কিন্তু তা করা হচ্ছে না।

এ অবস্থায় নতুন-পুরনো কোনো বিনিয়োগকেই তাঁরা নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। কিন্তু অবাক হতে হচ্ছে এই কারণে যে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি প্রচণ্ডভাবে কমে যাওয়ার পরও এ বিষয়ে সরকার বিন্দুমাত্রও উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে না।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সাম্প্রতিক নানা প্রচেষ্টা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বস্তুত এ বিষয়ে তাঁর ও অর্থ উপদেষ্টা মহোদয়ের বেশ কিছু পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যাপকভাবে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি যদি এভাবে কমতে থাকে অর্থাৎ বিনিয়োগ যদি না বাড়ে এবং সে কারণে উৎপাদনের ওপর যদি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাহলে মূল্যস্ফীতিকে কি শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে? মোটেও না। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশের মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতির চেয়েও এখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসন। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যদি অবিলম্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত করার মাধ্যমে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক গতিধারা ফিরিয়ে আনা না যায়, তাহলে আর্থিক ও মুদ্রানীতির আওতাধীন কোনো পদক্ষেপই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে নাহবেই না।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধের পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এখন ২৯.৫২ বিলিয়ন ডলার, যেটিকে মোটামুটি সন্তোষজনক বলেই অভিহিত করা যেতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বন্ধ রেখে বা তা আমদানি না হওয়ার কারণে সে অব্যয়িত অর্থের সুবাদে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হৃষ্টপুষ্ট থাকাটা মোটেও কোনো সুখবর নয়। তার চেয়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ যদি আরো কমও হয়, তাহলে সেটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতিশীলতার মানদণ্ডে অধিকতর সুখপ্রদ। কারণ তাতে উৎপাদন, কর্মসংস্থান, রপ্তানি ইত্যাদি বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও তা অধিকতর সহায়ক হবে। এ অবস্থায় মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এ ক্ষেত্রে ব্যাংকসমূহের বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রয় কার্যক্রম তথা আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে বলে মনে করি। এতে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কিছুটা হলেও বাড়বে বলে আশা করা যায়।

দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার বিষয়টি অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে অনেক বড় দুঃসংবাদ। এ অবস্থায় সংবাদ সম্মেলন করে বা গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এ অবস্থার পক্ষে ব্যাখ্যা দান করার চেয়েও অধিক জরুরি হচ্ছে, দেশে যত দ্রুত সম্ভব বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করা। কারণ ব্যাখ্যায় বিনিয়োগ বাড়বে না বা অন্য কোনো ব্যাখ্যা এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যও নয়। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। আর এটি যত তাড়াতাড়ি করা যাবে, বিনিয়োগের পরিবেশও ততই তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। বস্তুত সে প্রক্রিয়াতেই মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি যেমনি বাড়বে, তেমনি বাড়বে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, রপ্তানি ইত্যাদিও। এবং সেটিই হচ্ছে এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসার অন্যতম পূর্বশর্ত, যা দেখার জন্য সাধারণ মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

লেখক : অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি;

সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়

মন্তব্য

স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে অনন্য তারেক রহমান

    শাহেদ শফিক
শেয়ার
স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে অনন্য তারেক রহমান
ফাইল ছবি

রাজনীতি কোনো ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। এই প্রমাণ যুগে যুগে বহু নেতাই দিয়েছেন। গণতন্ত্রবিনাশী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ইতিহাসে বহু জনপ্রিয় নেতা হয়েছেন নির্বাসিত, কিন্তু তাঁদের অনেকেই নির্বাসনের কারণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। তবে এর ব্যতিক্রম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

তিনি দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসনে থেকেও দল পরিচালনায় আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তিনির্ভর কৌশল অবলম্বন করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও ভার্চুয়াল নেতৃত্ব আজ রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।

ইতিহাসে দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনি, স্পেনের জোসে মনুয়েল গার্সিয়া বা তিব্বতের দালাই লামা এমন বহু নেতা স্বদেশে ফিরে পরিবর্তনের পথ তৈরি করেছেন বা প্রবাসে থেকেই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দীর্ঘ সময় বিদেশে থেকেও দেশ ও জনগণের মুক্তির স্বপ্ন ত্যাগ করেননি।

তারেক রহমানও সেই ধারার একজন আধুনিক প্রতিনিধি। হাসিনা সরকারের দমন-পীড়নের কারণে বাংলাদেশে ফিরতে না পারলেও লন্ডন থেকে দলকে সুসংগঠিত রাখেন, ভার্চুয়াল সভা, সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা ও রাজনৈতিক বার্তা প্রদান করেন।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/19-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgবিশেষ করে বিএনপির ভিশন ২০৩০ ঘোষণায় তাঁর নেতৃত্ব ও চিন্তাধারার প্রতিফলন দেখা যায়। যেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের দিকনির্দেশনা তুলে ধরা হয়েছে।

ডিজিটাল যোগাযোগ ও আন্তর্জাতিক সংযোগের মাধ্যমে তিনি বিএনপিকে আধুনিক একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে দল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে।

প্রবাসে থেকেও তিনি কখনো দলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে দেননি। নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার পাশাপাশি সরকারের দুর্নীতি, দমননীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বক্তব্য রেখেছেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রভাব ফেলেছে। এটা বলা বাহুল্য, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন কঠিন হয়ে ওঠে, তখন নেতৃত্বের ধরন ও কৌশলই হয়ে ওঠে আন্দোলনের প্রাণ।

তারেক রহমানের প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।

তারেক রহমান দেখিয়েছেন, শারীরিকভাবে দেশে না থেকেও একটি রাজনৈতিক দলকে কৌশলগতভাবে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব। তিনি প্রমাণ করেছেন সংগঠনের সঙ্গে সুসংবদ্ধ যোগাযোগ, রাজনৈতিক বার্তার স্পষ্টতা এবং নৈতিক দৃঢ়তা থাকলে প্রবাস থেকেও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা যায়। তিনি প্রমাণ করেছেন আদর্শ, প্রযুক্তি ও নেতৃত্বের ভারসাম্য থাকলে দূরত্ব কখনো সংগ্রামের বাধা হতে পারে না।

তাঁর ডাকে মানুষ আবার রাজপথে নামে এবং গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যা ইতিহাসে আজ জুলাই বিপ্লব নামে চিহ্নিত। এই বিপ্লবে তারেক রহমান শুধু রাজনৈতিক বার্তাদানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আন্দোলনের ধারাকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করেন।

তাঁর নেতৃত্বের মাধ্যমে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো নেতৃত্ব মানে শুধু উপস্থিতি নয়, বরং সঠিক সময়, সঠিক বার্তা ও কার্যকর সংযোগের মাধ্যমে জনগণের শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। তারেক রহমানের জুলাই বিপ্লব কৌশল প্রমাণ করে, স্বৈরাচার যতই শক্তিশালী হোক, সংগঠিত জনশক্তি ও দূরদর্শী নেতৃত্বই তাকে নতজানু করতে পারে।

স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে অনন্য তারেক রহমান। তাঁর প্রবাসজীবন শুধু আত্মরক্ষার উপায় নয়, বরং তা এক

রূপান্তরমূলক রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপ নিয়েছে। দেশের মানুষ এখন তাঁকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল ও পরিণত নেতা হিসেবে দেখছে, যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা সম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

মন্তব্য
সেলাই করা খোলা মুখ

সোহাগ ওরফে লাল চাঁদের মৃত্যু : বিক্ষিপ্ত ভাবনা

    মোফাজ্জল করিম
শেয়ার
সোহাগ ওরফে লাল চাঁদের মৃত্যু : বিক্ষিপ্ত ভাবনা

অপরাধবিজ্ঞানে হেইনাস ক্রাইম বা জঘন্য অপরাধ বলে একটা কথা আছে। সাধারণভাবে যেকোনো অপরাধকে শুধু অপরাধই বলা হয়, তার আগে কোনো বিশেষণ ব্যবহৃত হয় না। যেমনচুরি-চামারি, মারদাঙ্গা, কিলাকিলি, ঘুষাঘুষি ইত্যাদি শুধুই অপরাধএগুলোর আগে জঘন্য, ঘৃণ্য, রোমহর্ষক বা ওই জাতীয় কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু সংঘটিত অপরাধটি যদি এতই মারাত্মক বা নিন্দনীয় হয় যে শুনলেই গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যায় বা ঘৃণায় দেহ-মন রি রি করে ওঠে, তখন এটাকে বলা হবে হেইনাস ক্রাইম বা জঘন্য অপরাধ।

কোনো থানায় কোনো মাসে ধরা যাক ২০টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এর ভেতর চুরি ১০টি, জমিদখল দুটি, পকেটমারের ঘটনা পাঁচটি, মার্ডার একটি এবং ধর্ষণ দুটি। এর মধ্যে মার্ডার বা খুনের মামলা ও ধর্ষণের মামলাকে বলা হবে হেইনাস ক্রাইম বা জঘন্য অপরাধ। কোনো এলাকায় একটি মার্ডার বা নারী নির্যাতন সংঘটিত হলে সেই এলাকা, এমনকি পুরো জেলায় হৈচৈ পড়ে যায়।
কারণ এগুলো নিঃসন্দেহে গুরুতর অপরাধ। মানুষের সব অন্তরাত্মাকে এই ধরনের অপরাধ দলিত-মথিত করে দেয়।

১৯৫০-এর দশকে আমার ছেলেবেলায় বগুড়া শহরে একদিন সকালবেলায় শোনা গেল, আগের রাতে গ্রাম থেকে শহরে স্বামীর সঙ্গে সিনেমা দেখতে আসা এক তরুণী বধূকে কয়েকজন শহুরে দুর্বৃত্ত মেরিনা পার্কের নির্জনতায় ধর্ষণ করেছে। ভোর না হতেই ঘটনাটি চাউর হয়ে যায়।

শহরজুড়ে দূর দূর, ছি ছি রব ওঠে এবং জনসাধারণের সহায়তায় ওই দিনই পুলিশ ধর্ষণকারীদের নেতা শহরের এক মোটামুটি পরিচিত ব্যবসায়ী অমুক মিয়া ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের পাকড়াও করে। মাস কয়েকের মধ্যেই আদালতে তাদের বিচার সম্পন্ন হয় এবং বিভিন্ন মেয়াদে আসামিদের সাজা হয়। হেইনাস বা জঘন্য ক্রাইমের এটা ছিল একটি উদাহরণ। বগুড়া জেলায় সেই আমলে এর আগে বা পরে এ ধরনের চাঞ্চল্যকর অপরাধ সংঘটিত হয়নি। পার্শ্ববর্তী পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর বা রাজশাহীতেও এমন জঘন্য অপরাধ ঘটেছে বলে শোনা যায়নি।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/19-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgআর এখন? সেই দুঃখের কাহিনিটা পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্য নিবন্ধের শুরুতেই এই স্মৃতি রোমন্থন। সেই উনিশ শ পঞ্চাশের দশকে এই বাংলাদেশের লোকসংখ্যা কত ছিল? ছয় কোটি? সাড়ে ছয় কোটি? এ রকমই হবে। আর এখন কেউ বলে ১৮ কোটি, কেউ বলে আরো বেশি। তখন শিক্ষিতের হার ছিল শতকরা মাত্র ২০-২২ জন। আর এখন, মাশাল্লাহ, তা ৭২-৭৩-এরও বেশি। আগে এই ভূখণ্ডের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪০ বা এরও কম। মাথাপিছু আয় ছিল ৪০-৪২ ডলার। এখন সব কিছুই বেড়েছে। কমেছে প্রসূতি মৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। আগের তুলনায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ও তাদের সাজ-সরঞ্জাম বেড়েছে অনেক গুণ। কিন্তু সেই তুলনায় নানা ধরনের অপরাধ, বিশেষ করে হেইনাস ক্রাইম বা খুন-জখম-ধর্ষণ-ছিনতাই ইত্যাদি কি কমেছে? না, কমেনি। বরং অপরাধীরা মনে হয় বুক চিতিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে সর্বসমক্ষে জঘন্য থেকে জঘন্যতম অপরাধ করেই চলেছে।

ইসলামের ইতিহাসে আমরা পড়েছি, ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের আগে আরব দেশে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন-খারাবি, গোত্রে গোত্রে যুদ্ধবিগ্রহ, নারী নির্যাতন ইত্যাদি লেগেই ছিল। ইসলাম-পূর্ব সেই যুগকে ইতিহাসে আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা চরম বর্বরতা ও অজ্ঞতার যুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। খুন কা বদলা খুন, প্রকাশ্যে নারী নির্যাতন, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, বিচারহীনতা এবং বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতা ছিল প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদের বৈশিষ্ট্য। সেখান থেকে বিশ্বনবী আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের ঘোর অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যান। হজরত মুহাম্মদ (সা.) শেষ নবী, রোজ কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে আর কোনো নবীর আগমন হবে না।

বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জন মানুষ আমরা মুসলমান। আমরা কি আমাদের এই সোনার দেশটিকে আমাদের কাজকর্ম দ্বারা দোজখে পরিণত করব, নাকি লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আল্লাহপাকের দান আমাদের এই পবিত্র আমানতটিকে জাহান্নাম নয়, জান্নাতের কুসুমবাগে পরিণত করব? এই সিদ্ধান্তটি নিতে হবে আমাদেরই। এখন তো আর প্রাক-স্বাধীনতা আমলের বিদেশি শাসকগোষ্ঠী নেই যে সব অন্যায়-অবিচার-অনিয়ম-বঞ্চনা-লাঞ্ছনার জন্য তাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাব। এখন আমরাই বাদী, আমরাই বিবাদী। একাত্তরের স্বাধীনতার পর আমরা যে দেশটিকে পেয়েছিলাম, যে দেশটির জন্য আমাদেরই লাখো শহীদ জীবন উৎসর্গ করেছিল, নিজেদের তরতাজা বর্তমানকে বিসর্জন দিয়েছিল আমাদের একটি স্বর্ণকান্তিময় ভবিষ্যতের জন্য, সেই দেশ আজ নীরবে-অলক্ষ্যে অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছে ২০২৪-এর জুলাইয়ে, তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে মিটফোর্ডের হতদরিদ্র সোহাগ মিয়ার করুণ পরিণতি অবলোকন করে। একটি মানুষকে মধ্যযুগীয় কায়দায়, কিংবা তারও আগে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের পাশব শক্তির মতো প্রকাশ্য দিবালোকে নিষ্ঠুরভাবে কে হত্যা করল? না কোনো বিদেশি শক্তি নয়, কোনো রণক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের হাতে নির্মমভাবে নিহত নয় সোহাগ মিয়া, তাকে হত্যা করল তারই দেশবাসী কজন মানুষ। আর শুধু হত্যা করেই থেমে থাকল না তারা, তার নিথর শবদেহ নিয়ে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠল সেই আসব বলের পাশবমত্তরা। সেই মর্মান্তিক দৃশ্যটি পাশে দাঁড়িয়ে অবলোকন করল যারা তারাও বাঙালি।

বিশ্ববাসী কী দেখল? দেখল, যে বাঙালি তাদের কোমল স্বভাব ও নম্রভদ্র আচরণের জন্য আবহমানকাল পৃথিবীর মানুষের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা পেয়ে এসেছে, তারা আজ বর্বরতায়, নিষ্ঠুরতায় অন্য যেকোনো দেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সোহাগ ওরফে লাল চাঁদকে দুর্বৃত্তরা পেটাতে পেটাতে মিটফোর্ড হাসপাতালের সম্মুখের রাস্তা থেকে হাসপাতাল চত্বরের ভেতরে নিয়ে আসে। সেখানে হাসপাতালের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল আনসার বাহিনীর একটি ক্যাম্প। তাদের চোখের সামনেই দুর্বৃত্তরা লাল চাঁদকে বেধড়ক মারধর করে মাটিতে ফেলে দেয় এবং আধলা ইট দিয়ে তার মাথায় বেদম আঘাত করে করে তাকে মেরে ফেলে। আর আমাদের প্রশিক্ষিত আনসার বাহিনীর সদস্যরা সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। আবারও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সেই প্রায়শ অভিনীত নীরব দর্শকের ভূমিকা! হায়, যদি দুজন মানুষও সেদিন লোকটাকে বাঁচাতে এগিয়ে যেত, তাহলে অসহায় মানুষটিকে এভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হতো না। এই কি বাঙালির চিরায়ত একের বিপদে অন্যের বুক পেতে দেওয়ার গৌরবময় ঐতিহ্য। বিদেশিরা চিরকাল বলে এসেছে, বাঙালিরা গরিব হতে পারে, কিন্তু তারা খুবই ভদ্র, পরোপকারী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াকু জাতি। লাল চাঁদের করুণ মৃত্যু কি তারই নমুনা? সেদিন অকুস্থলে উপস্থিত আনসার (যে শব্দটির বাংলা অর্থ সাহায্যকারী) সদস্যরা ও পথচারীরা একি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল? তাদের নিস্পৃহতা ও ক্লীবত্ব পুরো জাতির মুখে যে কলঙ্ক-কালিমা লেপে দিল তা কি সহজে মুছে যাবে? না, নিশ্চয়ই না। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেল এটাই যে এখন থেকে কেউ আর এগিয়ে আসবে না একটি অসহায় মানুষের জীবন রক্ষার্থে। যে কুদৃষ্টান্ত ছিল জাতির দুই চোখের বিষ, তা-ই এখন একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয়ে গেল। যে তরুণদের আমরা হরহামেশা উঠতে-বসতে নানা বিষয়ে নসিহত করি, বক্তৃতায়-বিবৃতিতে উপদেশামৃতের ফোয়ারা ছোটাই, তারা যদি এখন বলে চাচা, আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধ করুন আপনাদের এইসব অমূল্য নসিহতনামা, তার চেয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ভেতরের আনসার ক্যাম্পের সদস্যদের এবং লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী বাঙালিপুঙ্গবদের মতো কী করে মৃত সৈনিকের ভূমিকা পালন করব সে বিষয়ে সবক দিন, যাতে দিনশেষে বলতে পারি, এই দেশেরই গত শতাব্দীর গোড়ার দিকের কবি কামিনী রায়ের বহুল উচ্চারিত পঙক্তি পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও ভুল ছিল, ভুল ছিল পরোপকারী হয়ে জীবন উৎসগ করার মূলমন্ত্র।

এত দুঃখ, এত গ্লানির মধ্যে একটা বিষয় অবশ্যই কিছুটা হলেও শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। সোহাগ ওরফে লাল চাঁদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশের মানুষ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। তারা কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়, তারা সাধারণ মানুষ। সাইলেন্ট মেজরিটি। আর তারা শুধু রাজধানীর অমুক মোড়ে, তমুক সভাস্থলে জড়ো হওয়া সচেতন নাগরিক নয়, তাদের অনেকেই হয়তো রাজনীতিতে জড়িত আছে, তবে বেশির ভাগই রাজনীতিবিমুখ ছা-পোষা মানুষ। তারা স্বজনহারার বেদনা নিয়ে সমবেত হয়েছে প্রতিবাদ জানাতে, বিচারপ্রার্থী হয়ে। উনিশ শ চব্বিশের জুলাইয়ে এরাই ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সম্মুখসারির সৈনিক। সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য যেকোনো সংগ্রামে এরা যখন সম্পৃক্ত হয়ে যায় তখন জাতি স্বপ্ন দেখে সুদিনের। লাল চাঁদের করুণ মৃত্যু সেই সাইলেন্ট মেজরিটি বা জাতির সুপ্ত বিবেককে জাগ্রত করেছে সেটাই বড় সান্ত্বনা। আশা করব আমাদের বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ, সুদক্ষ কর্তৃপক্ষও সুষুপ্তি ঝেড়ে এবার আরেকটু নড়েচড়ে বসবে।

সব কথার শেষ কথা আজকের এই লেখাটি কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল বা মতের পক্ষে-বিপক্ষে নয়এটি মানবতার পক্ষের একটি লেখা। লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ কোন দল করত, তার রাজনৈতিক পরিচয় কী ছিল, এগুলো অবান্তর। তার প্রথম এবং প্রধান পরিচয় সে একজন মানুষ। আমার, আপনার মতো একজন রক্ত-মাংসের মানুষ। দোষে-গুণের মানুষ। একটি স্বাভাবিক মৃত্যুর দাবিদার এই দেশের একজন মানুষ। বহুকাল আগে শ্রদ্ধেয় প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেনের একটি লেখার শিরোনাম ছিল স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। সেই মৃত্যু দল-মত-নির্বিশেষে সবারই কাম্য। কারণ সব কিছুর আগে একজন মানুষের আদি ও অকৃত্রিম পরিচয় সে একজন মানুষ।

 

লেখক : সাবেক সচিব ও কবি

mkarim06@yahoo.com

মন্তব্য

প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন নিশ্চিত হোক

    জব্বার আল নাঈম
শেয়ার
প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন নিশ্চিত হোক

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের থলে থেকে একের পর এক বল ছোড়া হচ্ছে। সাংবিধানিক ব্যবস্থা, পিআর, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস, সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রসার, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, সংবিধান সংশোধনে গণভোটের বিধান, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে নিরপেক্ষ নিয়োগ, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কারের মতো বিষয়গুলো।

গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আলোচিত-ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ এবং রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গনির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য। বিষয়গুলো জটিল সমীকরণে ঘুরপাক খাচ্ছে সত্য।

দুটি বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে বলাও যায়, প্রথমত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল হলো, সরকারের ভেতরে আরেক সরকার। এই কাউন্সিলে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, আইনসভার নিম্নকক্ষের ও উচ্চকক্ষের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার থাকবেন। এমনটা হলে নির্বাচিত সরকার এবং সাংবিধানিক কাউন্সিলের অবস্থান হবে সাংঘর্ষিক! রাষ্ট্রপতি চাইলেই জরুরি অবস্থা ডাকতে পারবেন না, আদতে যা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।

দ্বিতীয়ত, পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) বাংলায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

যখন নির্বাচনের তারিখ প্রায় নির্ধারিত, ঠিক তখনই দেশের মানুষের সামনে নতুন সমীকরণ দাঁড় করানো হলো! অর্থাৎ প্রথম দল ১০ শতাংশ, দ্বিতীয় দল ১২ আর তৃতীয় দল যদি ৩০ শতাংশ ভোট পায়, প্রচলিত পদ্ধতিতে তৃতীয় দল সরকার গঠন করবে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে কেউ শূন্য হবে না৩০০ আসনের মধ্যে তৃতীয় দল পাবে ৯০ আসন, দ্বিতীয় দল ৩৬ এবং প্রথম দল ৩০ আসন পাবে। এই পদ্ধতিতে বড় দলগুলোর সামনে জটিল সমীকরণ হলেও ছোট দলগুলোর সামনে সীমাহীন সুযোগ। ফলে সহজেই সহমত প্রকাশ করে এনসিপি, জামায়াত ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মতো দলগুলোও।
এনসিপি ছয় মাস বয়সী হলেও রাজনীতির মাঠে ঝানু খেলোয়াড় জামায়াতে ইসলামী বিএনপিকে পাশ কাটিয়ে সামনে যেতে চায়। বিএনপি যখন পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে, জামায়াত তখন যেন এক কদম এগিয়ে। নিশ্চয়ই জামায়াতেরও এজেন্ডা আছে, তাদের প্রত্যাশা এটা জাতীয় সরকারের রূপরেখা অথবা বিএনপির সঙ্গে এর মধ্য দিয়ে আসনবণ্টনের সমঝোতা। দলটি তা বাস্তবায়নে কতটুকু সক্ষম ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওল্টালে অনুমান করা সহজ।

নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার পতনের পর ঠিক বর্তমান সময়ের মতোই জামায়াত রাজনীতির ময়দানে চৌকস ভূমিকায় ছিল।

একানব্বই নির্বাচনে ১৮ আসন অর্জন করে। ভোট ছিল ১২.১৩ শতাংশ। পরবর্তী দুই নির্বাচনে (তিন আসন) ৮.৬১ শতাংশ, (দুই আসন) ৪.২৮ শতাংশের বেশি ভোট লাভ করতে ব্যর্থ হয় দলটি। শতাংশ হিসাবে বলা চলে ১৯৯১-এর পর জামায়াতের পতন হয়েছে। কারণ ১৯৯৬-এর পর থেকে দলটি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য বরাবরই প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

২০২৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো স্বৈরাচার পতন হলে জামায়াত আবারও উজ্জীবিত, কর্মীরা প্রাণবন্ত, দলটির ধারণা সমর্থকও বেড়েছে ব্যাপক হারে। ধারণা আর ভাবনা মিলে আশা করছে, দলটি সরকার গঠন করবে, কোনো কারণে ব্যর্থ হলে পিআর পদ্ধতিতে অনেকগুলো আসন পাবে। এনসিপি, জামায়াতসহ ছোট অন্য দলগুলো এই ফর্মুলায় এগোতে চাইলেও বিএনপি পড়বে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। ৫০ শতাংশ ভোট পেলেও (সর্বোচ্চ অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৪০.৯৭ শতাংশ পেয়েছে) বিনিময়ে আসন পাবে ১৫০টি, যা প্রত্যাশার চেয়ে কম। ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, সংস্কারের অভিনব শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।

২.

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে অন্তত ১০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি অসম্মতি প্রকাশ করেছে। এই অসম্মতিই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র না থাকলে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রায় অসম্ভব। বিএনপি সবচেয়ে বড় দল, ফলে সাধারণ মানুষের কথা প্রতিনিয়তই মাথায় রেখে যেকোনো সিদ্ধান্তে সম্মতি দিতে হয়। অথচ আলী রীয়াজ আবারও জোর গলায় বলেন, যেসব প্রস্তাবে একমত হওয়া যাচ্ছে না, আমাদের প্রথম লক্ষ্য হবে দলগুলোর অবস্থানগত দূরত্ব কমিয়ে মধ্যবর্তীভাবে জায়গায় এনে হলেও রাজি করানো।

পিআর বাস্তবায়িত হলে সত্যিকার জনপ্রিয় প্রার্থীদের সামনে আসাটা কঠিন। দলের মধ্যে তেলবাজদের প্রভাব বাড়বে, অবৈধ লেনদেন বাড়বে। এতে যোগ্যরা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সেবা প্রদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রসঙ্গ সামনে টানেন, এখন ঐকমত্য যেগুলোতে হয়েছে সেগুলো করে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে দেন। আর যেগুলোতে ঐকমত্য হবে না সেগুলো বাংলাদেশের জনগণের বাইরে আর কারো করার ক্ষমতা নেই, আমাদেরও ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ কমিশন তার কথার গুরুত্ব হারাচ্ছে। সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হচ্ছে, অদৃশ্য শত্রু ও শক্তির প্রভাব বাংলাদেশে বাড়ছে, বাড়ছে আতঙ্কও। এরই মধ্য দিয়ে ২০২৬ সালের নির্বাচনেও কালক্ষেপণ শুরু হয়েছে।

পিআর অবশ্যই ভালো ও গ্রহণযোগ্য একটি সংযোজন হতো, যদি উন্নত দেশের মতো মানুষ শতভাগ শিক্ষিত ও সচেতন হতো। এই পদ্ধতিতে একজন ইউপি মেম্বারের সমান যোগ্য ব্যক্তিও সাংসদ হতে পারে। সাংসদ হতে পারবে বিত্তবান সিরিয়াস কিলার, ডাকাত, ভূমিদস্যু কিংবা কালো টাকার মালিকরা। প্রথম স্বৈরাচার পতনের পর তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে। তখন ভোটের আনুপাতিক হারের দিকে খেয়াল করলে সামনের পিআরে আওয়ামী লীগও ৬০ থেকে ৮০ আসন সন্দেহাতীতভাবে পাবে। অতএব নির্বাচনের ফলাফল ও ভোটের অনুপাত হিসাব করলে অনুমেয় যে এনসিপি, জামায়াত ও সঙ্গীরা রাজনীতির হাতি, ঘোড়া, কিস্তি বুঝতে পারছে না।

তাই সরকারের উচিত প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন নিশ্চিত করা। সাংবিধানিক কাউন্সিল বিষয়ে আরো ভাবনা সংযোজনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের ওপর দিন ও দিবসবিষয়ক ছুরি চালানো বন্ধ করা।

 

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক

jabbaralnayeem@gmail.com

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ