সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল, স্পেন এবং অন্য কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে মাংকিপক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। শনাক্তকৃত রোগীর সংখ্যা বিচারে সংক্রমণ এবং বিস্তার খুব বড় নয়। এখন পর্যন্ত ৬৮ জন সন্দেহভাজন রোগী, যার মধ্যে আটজন ইংল্যান্ডে এবং ২০ জন পর্তুগালে। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন করে রোগী রিপোর্ট করা হয়েছে।
বিরল মাংকিপক্সের প্রাদুর্ভাব : আমাদের করণীয়
- ড. কবিরুল বাশার
অন্যান্য

এই রোগটির সংক্রমণ ও বিস্তার সম্পর্কে পরিপূর্ণ সঠিক ধারণা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নেই। যৌন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে যে ভাইরাসটি মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে যেকোনো মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে অথবা ছড়িয়ে পড়েছে, যা এখনো শনাক্ত করা যায়নি।
মাংকিপক্স একটি ভয়াবহ রোগ হয়ে যেতে পারে। এটি জ্বর, শরীরে ব্যথা, বর্ধিত লিম্ফ নোড এবং মুখ, হাত ও পায়ে বেদনাদায়ক, তরল ভরা ফোসকা সৃষ্টি করে।
মাংকিপক্সের একটি টাইপ বেশ মারাত্মক, যেটি সংক্রমিত ১০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। বর্তমানে ইংল্যান্ডের টাইপটি মৃদু।
পশ্চিম আফ্রিকা ও মধ্য আফ্রিকা প্রাণী থেকে মাংকিপক্সে মানবদেহে সংক্রমিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করেছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি সংক্রমণ সহজ নয়, কারণ এর জন্য শারীরিক তরলের সঙ্গে সংস্পর্শ প্রয়োজন; যেমন—কাশি থেকে লালা বা ক্ষত থেকে পুঁজ। সুতরাং সাধারণ জনগণের ঝুঁকি কম। কিন্তু ইংল্যান্ডে, আটটি ক্ষেত্রে সাতটি সাম্প্রতিক রোগীর আফ্রিকা ভ্রমণের ইতিহাস নেই। এ ক্ষেত্রে তারা ইংল্যান্ডে সংক্রমিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উপরন্তু এই ব্যক্তিরা এমন কোনো রোগীর সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে আসেনি, যারা নাইজেরিয়া ভ্রমণ করেছে। এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, ভাইরাসটি কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু শনাক্ত করা হয়নি।
ভাইরোলজিস্ট অ্যাঞ্জি রাসমুসেনের ধারণা মতে, এটি আক্রান্ত দেশ থেকে আসা একজন রোগীর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যাকে শনাক্ত করা যায়নি। ভাইরাসটি একটি নতুন সংক্রমণমাধ্যমে, বিশেষ করে যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন পুরুষদের মধ্যে রোগটি শনাক্ত করা হয়েছে, যারা সমকামী, উভকামী বা পুরুষদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী পুরুষ।
ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের বিজ্ঞানীরা ইউরোপের প্রাদুর্ভাব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁরা বলছেন, এটি সাধারণ মাংকিপক্স থেকে আলাদা।
২০১৯ সালে ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মাংকিপক্সের প্রথম ভ্যাকসিন অনুমোদন করে, যা গুটিবসন্ত থেকেও রক্ষা করে। এই ভ্যাকসিনটি স্ট্র্যাটেজিক ন্যাশনাল স্টকপাইলের (এসএনএস) অংশ, যা জনস্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য সম্ভাব্য জীবন রক্ষাকারী ওষুধ।
নাম মাংকিপক্স হলেও এই ভাইরাসটি সত্যিকার অর্থে বানর থেকে আসে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটিকে ‘রডেন্টপ’ বলা উচিত। কারণ এটির মূল রিজার্ভার ইঁদুর শ্রেণির প্রাণী। ১৯৫৮ সালে বানরের দুটি কলোনি থেকে প্রথম মাংকিপক্স শনাক্ত করা হয় এবং বানরের রোগ হিসেবে এই নামে তখন নামকরণ হয়। ১৯৭০ সালে কঙ্গোতে প্রথম মানবদেহে এই রোগটি শনাক্ত হয়। এই ভাইরাসটির প্রধান বাহক বানর নয়। এটি কাঠবিড়ালি, থলিযুক্ত ইঁদুর, ডর্মিস বা অন্য ইঁদুরের মধ্যে থাকতে পারে।
প্রাথমিকভাবে পশুর কামড়, আঁচড় বা প্রাণীর শারীরিক তরলের সংস্পর্শের মাধ্যমে এই ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। ভাইরাসটি কাশি ও হাঁচির মাধ্যমে বা ক্ষত থেকে পুঁজের সংস্পর্শে অন্য লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
মাংকিপক্সের ক্ষতগুলো গুটিবসন্তের সংক্রমণের মতোই হয়। এর সংক্রমণের হার গুটিবসন্তের তুলনায় অনেক কম। বর্তমান প্রাদুর্ভাবে সংক্রমণের হার বেড়েছে কি না বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রিমোইনের মতে, এই রোগটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে। তবে এটিকে মোকাবেলা করার জন্য এর সঠিক সংক্রমণমাধ্যম এবং সঠিক শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গুটিবসন্ত ভ্যাকসিন আসলে মাংকিপক্স থেকে মানুষকে রক্ষা করতে বেশ ভালো কাজ করে। এটি প্রায় ৮৫ শতাংশ কার্যকর, যদিও গুটিবসন্ত ভ্যাকসিনের কিছু নিরাপত্তা উদ্বেগ রয়েছে। কারণ এটি একটি জীবন্ত ভাইরাস এবং এটি দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটাতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন ব্যবহার না করার কারণে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে মাংকিপক্সের সংক্রমণের হার বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০২০ সালে প্রায় চার হাজার ৬০০ সন্দেহভাজন রোগী ছিল, যাদের শরীরে স্মলপক্সের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়নি বা যারা স্মলপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি, তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
এই ভাইরাস স্মলপক্স ভাইরাসের মতো এপিডেমিক বা প্যান্ডেমিক হওয়ার সামর্থ্য রাখে কি না সে বিষয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা করা দরকার। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদেরও সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। এ রোগের কাছাকাছি কোনো লক্ষণ দেখা দিলে মাংকিপক্সের বিষয়টিও যেন বিবেচনায় রাখা হয়। যেসব দেশে এই ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে এবং আক্রান্তের হার বাড়ছে, সেসব দেশ থেকে আসা যাত্রীদের বিশেষ নজরদারির মধ্যে রাখা প্রয়োজন। আগাম প্রতিরোধব্যবস্থাই যেকোনো সংক্রমণ ঠেকাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : অধ্যাপক, গবেষক, কীটতত্ত্ববিদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com
সম্পর্কিত খবর

অকাতরে কেটে যাচ্ছি গাছ, লাগাচ্ছি কয়টি
- এমরান কবির

সারা দেশে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে, যেন গাছ কাটার মহোৎসব চলছে। সম্প্রতি যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা জেনে কোনো বিবেকবান মানুষের মাথা ঠিক থাকার কথা নয়।
বেসরকারি সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)-এর গাছ কাটাবিষয়ক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের মার্চ থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত দেশে সরকারি প্রকল্পে প্রায় ১৩ লাখ গাছ কাটা পড়েছে। এই হিসাবটি স্রেফ সংবাদপত্রের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।
এই গণহত্যার প্রধান রাজা হলো খোদ সরকারি সংস্থা। আরডিআরসির সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে গাছ কাটায় এক্সপার্ট হিসেবে যে সংস্থাগুলোর নাম উঠে এসেছে সেগুলো হলো সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বন বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা মৎস্য কার্যালয়, রাজশাহী জেলা পরিষদ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, যশোর জেলা পরিষদ, মেহেরপুর জেলা পরিষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট।
গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫০ বছর বেঁচে থাকা একটা গাছ জীবন রক্ষাকারী যে অক্সিজেন দেয় তার মূল্য ২৫ লাখ টাকা, বায়ুদূষণ থেকে রক্ষায় ১০ লাখ টাকা, বৃষ্টি ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে বাঁচায় পাঁচ লাখ টাকা, মাটির ক্ষয়রোধ ও উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে বাঁচায় পাঁচ লাখ টাকা, বৃক্ষে বসবাসকারী প্রাণীদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে বাঁচায় পাঁচ লাখ টাকা, আসবাব, জ্বালানি কাঠ ও ফল সরবরাহ করে পাঁচ লাখ টাকা, বিভিন্ন জীবজন্তুর খাদ্য জোগান দিয়ে বাঁচায় আরো ৪০ হাজার টাকা।
কেউ কেউ বলবেন, বৃহত্তর স্বার্থে এমন কিছু কাজ সম্পন্ন করতে হয়, যেখানে গাছ না কেটে উপায় থাকে না। মানলাম সে যুক্তি। কিন্তু এখানে কয়েকটি বিষয় কি বিবেচনা আনা যায় না? যেমন গাছ না কেটে যতদূর সম্ভব প্রকল্প ডিজাইন করা যায় না? যদি কাটতেই হয়, তাহলে ন্যূনতম পর্যায়ে কেটে করা যায় না? গাছ যদি বিশেষ প্রয়োজনে কাটতেই হয়, তাহলে হিসাব করে এর সমসংখ্যায় গাছ কি লাগানো যায় না?
২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভা বৈঠকে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন আইন ২০২১-এর খসড়া অনুমোদনের সময় ব্যক্তিমালিকানায় থাকা গাছ কাটতে অনুমতির বিধান রাখা হয়। সেই বৈঠক শেষে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, ‘যাঁরা সাধারণ বাগান করবেন বা স্থায়ী যে গাছ লাগাবেন সেগুলোও তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামতো কাটতে পারবেন না।
এরপর হাইকোর্ট এক রায়ে বলেন, ‘অনুমতি ছাড়া গাছ কাটা যাবে না, গাছ কাটার আগে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।’ বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। এর পরও গাছ কাটা বা খুন করা থেমে নেই।
হাদিস শরিফে আছে, যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটা গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে। (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ, মুসনাদে আহমাদ)।
জন্মের সময় এই পৃথিবীকে যেমন পেয়েছিলাম, মৃত্যুর আগে যেন তার চেয়ে একটু ভালোর দিকে এগিয়ে দিতে পারি। একজন মানুষের ন্যূনতম কর্তব্য এটি। এটার জন্য জীবন দিতে হবে না। আমরা যদি বছরে একটি করে গাছ লাগাই ও পরিচর্যা করি, তাহলে প্রতিবছর লাগানো গাছের সংখ্যা হবে সতেরো কোটির বেশি। ‘আরেক ফাগুনে’ তা দ্বিগুণ হবে।
আমরা তো কথা লাগাই। ক্যাচাল লাগাই। মারামারি লাগাই। ফেসবুকে ‘লাগানো’ নিয়ে আদিরসাত্মক কৌতুকে মেতে উঠি। কিন্তু আসল কাজ করি না। তাই আসুন, এই মৌসুম থেকেই শুরু করি।
প্রতিবছর অন্তত একটি করে গাছ লাগাই ও পরিচর্যা করি।
লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

এই সহিংসতার শেষ কোথায়
- মিজানুর রহমান

১ জুলাই থেকে সারা দেশে এনসিপি পদযাত্রা শুরু করেছে। এটা তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি। একটি দল যখন কোনো সমাবেশ ঘোষণা করে সেখানে রাষ্ট্রের অনুমতি নিতে হয়। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখা।
সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় জনগণ উদ্বিগ্ন। ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন এক ব্যবসায়ী।
গোপালগঞ্জের ঘটনায় কী দেখা গেছে। সকালে এনসিপি নেতারা গাড়িবহর নিয়ে শহরে ঢোকার আগেই পুলিশের গাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল। গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলো, ইউএনওর গাড়িতে হামলাও হলো। প্রশাসন কী করেছে? এসবের মধ্যেই দুপুর দেড়টার দিকে নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে এসে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্ক এলাকায় সমাবেশস্থলে হামলা চালায়। ব্যাপক ক্ষতিসাধনও করে। নেতারা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে পুলিশি নিরাপত্তায় টেকেরহাট হয়ে মাদারীপুরে যাওয়ার পথে বেলা পৌনে ৩টার দিকে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে ফের হামলা হয়। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকর্মীদের সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
এ পরিস্থিতিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। পরে তাঁরা সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে পুলিশ সুপারের কার্যালয় ছাড়েন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় বুধবার রাত ৮টা থেকে পরবর্তী দিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২২ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়।
পুলিশ কেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? কেন পদে পদে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে? এর প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার, জনবলের অভাব, প্রশিক্ষণের অভাব এবং পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার অভাবও এ ক্ষেত্রে দায়ী হতে পারে। আমরা জানি, অতীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে পুলিশের কাজ ব্যাহত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কথামতো পুলিশ কাজ করেছে। যার ফলে পুলিশের নিরপেক্ষতা নষ্ট হয় এবং তারা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে তখন ব্যর্থ হয়। তা ছাড়া পুলিশের জনবলের ঘাটতি তো আছেই। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুলিশে দ্রুত জনবল নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু নিয়োগ দিলে হবে না, যথাযথ প্রশিক্ষণ, রসদ-সরঞ্জামে পুলিশ বাহিনীকে সক্ষম করে তুলতে হবে। এটা স্বীকার করতেই হবে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে পুলিশের রসদ-সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, গাড়ি ধ্বংস হয়েছে। এখনো হয়তো তারা এগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যদি কাটিয়ে উঠতে না পারে তখন সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক।
বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময় পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এরা দলীয় লোক নিয়োগ দিয়ে তাদের অনুগত বানিয়ে নেতারা অনেক অপকর্ম করেছেন। এর খেসারত এখন জাতিকে পোহাতে হচ্ছে। পুলিশ জনগণের বন্ধু হওয়ার কথা ছিল। পুলিশ এখনো কিন্তু জনগণের বন্ধু হতে পারিনি। তা পারলে সহিংসতা প্রতিরোধে জনগণই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। সেটা এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না। তা ছাড়া আইন প্রয়োগের দুর্বলতাও আছে। বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা পীড়াদায়ক। অনেক সময় দোষীরা পার পেয়ে যায়। দীর্ঘদিনের এসব সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে পুলিশ বাহিনীকে গড়ে তুলতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। সংস্কারের জন্য অনেক সুপারিশ এসেছে। এগুলো পর্যালোচনা করে বাস্তবায়ন করা দরকার। দলমত-নির্বিশেষে সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে সবার আগে পুলিশ সংস্কারের কাজটিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে পুলিশ জনগণের বন্ধু হতে বাধ্য। বিষয়টি এখন খুবই স্পষ্ট হচ্ছে, পুলিশের এ রকম দুর্বলতা নিয়ে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : সাবেক ব্যাংকার ও কলামিস্ট

দায়িত্ব ও মানবিকতার ঘোরতর বিপর্যয়
- কামরুল হাসান

যে বাতাসে পাখির পালকও ভেসে থাকতে পারে না, সেই বাতাসে কী করে হাজার টন ওজনের বিমান ভেসে থাকে তা বিজ্ঞানের এক বিস্ময়! জাহাজে বিপর্যয় ঘটলে নিকটবর্তী জল আছে, সড়কের যানের জন্য রয়েছে মাটি, কিন্তু বিমানের জন্য কিছু নেই। একটি বিমানকে তাই সর্বোচ্চ যত্ন ও দক্ষতা দিয়ে তৈরি করা হয়। যানবাহনে Factor of Safety বলে একটা নিরাপত্তা সূচক আছে। একটি গাড়ির ফ্যাক্টর অব সেফটি ১ হলে একটি বিমানের তা ১০।
বিমান দুর্ঘটনা ঘটবে যদি কোথাও ঘাটতি থেকে যায়। সে ঘাটতি হতে পারে পাইলটের দক্ষতার কিংবা বিমানের ওড়ার সামর্থ্যের। যে বিমানটি গত সোমবার দুপুরে এক অচিন্তনীয় দুর্ঘটনা ঘটাল, আছড়ে পড়ল একটি ছাত্রগিজগিজ বিদ্যালয়ের ওপর, ঢুকে গেল তার শ্রেণিকক্ষে, মুহূর্তে ঝলসে দিল সংখ্যাতীত শিশুর কচি শরীর, হরণ করল অজস্র মা-বাবার প্রাণাধিক সন্তানের জীবন, সেই এফ-৭ বিমানটির উৎপাদন আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল উৎপাদনকারী দেশ চীন। রাশিয়ার তৈরি মিগ-২১-এর অনুকরণে চীন এফ-৭ বিমান সিরিজটির নকশা করে।
আমরা দরিদ্র বুঝলাম, কিন্তু সে কারণে পুরনো অনিরাপদ বিমান কিনে তা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ট্রেনিং পরিচালনা করা মূর্খতা। সেকেলে, ভাঙাচোরা, বাতিল হয়ে যাওয়া বিমান নিয়ে পরশু যে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটল সেটিই প্রথম দুর্ঘটনা নয়। ২০১৭ সালে কক্সবাজারে দুটি ফাইটার বিমান, দুটিই ট্রেনিং জেট। সংঘর্ষ হয়ে দুটি বিমানই বিধ্বস্ত হয়। ভাগ্যক্রমে চারজন পাইলটই বিধ্বস্ত হওয়ার আগে নিজেদের শূন্যে নিক্ষিপ্ত করে প্রাণে বেঁচে যান। এর পরের বছর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় এই একই এফ-৭ বিমান পরিচালনার সময় একজন বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার আনিসুর রহমান মারা যান। সেখানেও কারিগরি ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। ২০২২ সালে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে প্রশিক্ষণের সময় ভূপাতিত হয় আরেকটি এফ-৭ বিমান। উভয় পাইলটই ইজেক্ট করে প্রাণে বেঁচে গেলেও ফাইটার বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। অর্থাৎ ন্যাড়া বারংবার বেলতলায় যাচ্ছে আর তার টেকো মাথায় বেল পড়ছে।
বিমান দুর্ঘটনার অতিরিক্ত বিপদ হলো যে তার পেটের খোঁড়লে থাকা যাত্রীদেরই মৃত্যু ডেকে আনে তা নয়, তা মৃত্যু ঘটায় ভূমির মানুষদেরও, যাদের ওপর সে আছড়ে পড়ে। ঘটতে পারে—এই আশঙ্কা মাথায় রেখে বিমানবন্দরগুলো যথাসম্ভব শহর থেকে দূরে জনবিরল প্রান্তরে তৈরি করা হয়। মিলিটারি এয়ারবেসগুলো থাকে দুর্গম, জনবিরল এলাকায়। কারণ মিলিটারি এয়ারক্রাফটের বেশির ভাগের শব্দের চেয়ে বেশি গতি, কোনোটি শব্দের গতির দ্বিগুণ (Mach 2), কোনোটি তিন গুণ (Mach 3)। তাদের বিধ্বস্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। মিলিটারি এয়ারক্রাফটের চেয়ে সিভিলিয়ান এয়ারক্রাফটের Stability বেশি, কিন্তু সামরিক বিমানের Maneuverability অনেক বেশি থাকায় তাদের ঝুঁকির মাত্রাও বেড়ে যায়। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, ঢাকার মতো দুনিয়ার একটি সর্বোচ্চ ঘনবসতির শহরের কেন্দ্রস্থলে কী করে একটি এয়ারবেস থাকতে পারে এবং কী করে তার আকাশে বিমান প্রশিক্ষণের মহড়ার আয়োজন করা হয়?
মাইলস্টোন কলেজ ও স্কুলে গত সোমবার দুপুরে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে গেল তার দায়িত্ব কে নেবে? একটি বহু পুরনো লক্কড়ঝক্কড় মার্কা বিমানের যে ফিটনেস নেই, তা কেউ কি জানত না? যারা এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল, যারা এই উড্ডয়নের ছাড়পত্র দিয়েছিল তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ঢাকার মতো একটি মানুষঠাসা নগরের আকাশে কী করে পাইলট প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়? এই ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজন কী?
আমাদের মানবিকতা ও মূল্যবোধ যে কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে মাইলস্টোনের দুর্ঘটনা তা আরো একবার নগ্নভাবে উন্মোচিত করে দিয়ে গেল। আগে মানুষ বিপদে পড়লে অপরাপর মানুষ এগিয়ে যেত, এখন তারা ভিডিও করে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়ে ‘লাইভ শো’ করে। উত্তেজনাকর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে তারা হিরো হতে চায়, বিপদে কাতরাচ্ছে যে মানুষ তাকে উদ্ধারে তার মন নেই। আমরা দেখলাম আরো অধঃপতনের চিত্র। ৩০ টাকার পানি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, ৬০ টাকা রিকশা ভাড়া হয়ে গিয়েছিল ৫০০ টাকা। একটি ভিডিওতে দেখলাম অগ্নিদগ্ধ একটি শিশু কাতর হয়ে রিকশা থামানোর চেষ্টা করছে, অমানুষ রিকশাওয়ালা ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে চলে যাচ্ছে। তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে গেছে মানুষ, রক্ত দিয়েছে অনেকে। এটাই মানবিকতা।
আমাদের দূরদর্শিতার অভাব, পরিকল্পনার ঘাটতি, অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার যে সামগ্রিক দুর্দশাগ্রস্ত চিত্র তা-ই যেন উন্মোচিত করে গেল একটি মর্মন্তুদ দুর্ঘটনা। যেসব পিতা-মাতা তাঁদের সন্তানদের হারিয়েছেন শুধু তাঁরাই জানেন সন্তান হারানোর বেদনা কত অসহনীয়, কত ভারী। আমাদের যা রীতি-শোক প্রকাশ, একটা তদন্ত কমিটি গঠন, আর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে দায়িত্ব খালাস। এ যাত্রায়ও তার চেয়ে বেশি কিছু হবে না। পরিকল্পনার অভাবে এতগুলো তরুণ প্রাণ অকালে ঝরে পড়ল (চূড়ান্ত মৃতের সংখ্যা কত হবে কেউ জানে না। কেননা অগ্নিদগ্ধ অর্ধশত মানুষের জীবন সংকটাপন্ন, আর আশি ভাগ দেহ আগুনে পুড়ে গেলে বাঁচার সম্ভাবনা কম), কেন এই প্রাণহানি তা ভাবতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো প্রশিক্ষণ বিমান ঢাকার আকাশে আমরা না দেখি—সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। যে দেশে মানুষ বেশি সে দেশেও মানুষের জীবনের দাম কম নয়—এ সত্য সবাইকে বুঝতে হবে। আর ফিরিয়ে আনতে হবে মানবিকতার সেই সব বোধ, যা বিপদাপন্ন মানুষকে উদ্ধার করে, তাকে নিয়ে ভিডিওচিত্র না বানায়।
লেখক : কবি, অধ্যাপক ও বিমান প্রকৌশলী

রাজনীতিকে ‘অলাভজনক’ করাই হবে সবচেয়ে বড় সংস্কার
- নূরে আলম সিদ্দিকী

জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে চিরদিনের জন্য বদলে ফেলার একটি দুর্লভ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হওয়া দুটি তরুণ প্রজন্ম চরম অপমানজনকভাবে রুখে দিয়েছে বহুল সমালোচিত স্বৈরাচারী শাসনের অগ্রযাত্রাকে। এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল তরুণ প্রজন্ম। তাদের এই অবিস্মরণীয় অর্জন আজ সমগ্র বিশ্বের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
সঠিক গণতন্ত্রের অভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে আছে কেবল ক্ষমতা ভোগ ও লুটপাট। অথচ রাজনীতির মৌলিক উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনকল্যাণ, কিন্তু তা আজ ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রাজনীতিকে ‘অলাভজনক’ করে তোলা এবং সেই সঙ্গে মন্ত্রী, এমপিদের সব ধরনের অনৈতিক আর্থিক ফায়দা লাভের সুযোগ বন্ধ করাই হবে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সংস্কার।
বাংলাদেশে রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে।
দলীয় তহবিল ও নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য স্বচ্ছ ও নির্ধারিত নিয়ম থাকা এবং সেগুলো যাতে কঠোরভাবে মেনে চলা হয়, তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অর্থের অপব্যবহার রোধ করতে দলগুলোর তহবিল পরিচালনা নিয়মিত নিরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে রাজনীতিবিদদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা সীমিত করা উচিত। সরকারি সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও তা কার্যকর করতে হবে। সর্বোপরি রাজনীতিতে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ও মনোযোগ বাড়াতে হবে। যখন জনগণ রাজনীতির প্রতি সচেতন হবে, তখন তারা সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের প্রত্যাখ্যান করবে।
এই প্রক্রিয়ার অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেসব রাজনীতিবিদ রাজনীতিকে ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন, তাঁরা কখনো এই পরিবর্তন মেনে নেবেন না। তাঁদের বিরোধিতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে তারই প্রতিফলন ঘটছে। তা ছাড়া বেশির ভাগ মানুষ রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত নয়। তাদের শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা সময়সাপেক্ষ। সর্বোপরি যেসব প্রতিষ্ঠান রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ছাড়া রাজনীতিকে অলাভজনক করা সম্ভব নয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে সরকারি পদায়ন ও অনৈতিক সুবিধা বন্ধ করতে হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিজেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ব্যাপক সংস্কার এনে এই কমিশনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও কার্যকর দুর্নীতি দমন নিশ্চিত করতে হবে। বিচারব্যবস্থায় সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনীতিতে ও সমাজে নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতার গুরুত্ব নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যাতে তারা অনৈতিক কার্যকলাপ উদঘাটন করতে পারে। শিক্ষিত ও দক্ষ নেতাদের রাজনীতিতে উৎসাহিত করতে হবে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক পদে থাকা ব্যক্তিদের অপ্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা এবং বিশেষাধিকার সীমিত করতে হবে। সরকারি প্রকল্পে রাজনৈতিক প্রভাব এবং অবৈধ সুবিধা অর্জনের পথ বন্ধ করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী এবং তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সব কর্মকাণ্ড ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রেকর্ড করতে হবে, যেন যেকোনো অনিয়ম চিহ্নিত করা যায়। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সমঝোতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
এসব পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারকে গ্রহণ করতে হবে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে। এসব কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নই রাজনীতিকে অলাভজনক ও জনকল্যাণমুখী করার পথে একটি মাইলফলক হতে পারে। আর রাজনীতিকে অলাভজনক করার মাধ্যমে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক সংস্কার নয়, বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনেরও সূচনা। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও জনগণের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট