আর এখন? সেই দুঃখের কাহিনিটা পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্য নিবন্ধের শুরুতেই এই স্মৃতি রোমন্থন। সেই উনিশ শ পঞ্চাশের দশকে এই বাংলাদেশের লোকসংখ্যা কত ছিল? ছয় কোটি? সাড়ে ছয় কোটি? এ রকমই হবে। আর এখন কেউ বলে ১৮ কোটি, কেউ বলে আরো বেশি। তখন শিক্ষিতের হার ছিল শতকরা মাত্র ২০-২২ জন। আর এখন, মাশাল্লাহ, তা ৭২-৭৩-এরও বেশি। আগে এই ভূখণ্ডের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪০ বা এরও কম। মাথাপিছু আয় ছিল ৪০-৪২ ডলার। এখন সব কিছুই বেড়েছে। কমেছে প্রসূতি মৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। আগের তুলনায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ও তাদের সাজ-সরঞ্জাম বেড়েছে অনেক গুণ। কিন্তু সেই তুলনায় নানা ধরনের অপরাধ, বিশেষ করে ‘হেইনাস ক্রাইম’ বা খুন-জখম-ধর্ষণ-ছিনতাই ইত্যাদি কি কমেছে? না, কমেনি। বরং অপরাধীরা মনে হয় বুক চিতিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে সর্বসমক্ষে জঘন্য থেকে জঘন্যতম অপরাধ করেই চলেছে।
ইসলামের ইতিহাসে আমরা পড়েছি, ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের আগে আরব দেশে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন-খারাবি, গোত্রে গোত্রে যুদ্ধবিগ্রহ, নারী নির্যাতন ইত্যাদি লেগেই ছিল। ইসলাম-পূর্ব সেই যুগকে ইতিহাসে আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা চরম বর্বরতা ও অজ্ঞতার যুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ‘খুন কা বদলা খুন’, প্রকাশ্যে নারী নির্যাতন, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, বিচারহীনতা এবং বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতা ছিল প্রাক-ইসলামী যুগে আরবদের বৈশিষ্ট্য। সেখান থেকে বিশ্বনবী আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের ঘোর অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যান। হজরত মুহাম্মদ (সা.) শেষ নবী, রোজ কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে আর কোনো নবীর আগমন হবে না।
বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জন মানুষ আমরা মুসলমান। আমরা কি আমাদের এই সোনার দেশটিকে আমাদের কাজকর্ম দ্বারা দোজখে পরিণত করব, নাকি লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আল্লাহপাকের দান আমাদের এই পবিত্র আমানতটিকে জাহান্নাম নয়, জান্নাতের কুসুমবাগে পরিণত করব? এই সিদ্ধান্তটি নিতে হবে আমাদেরই। এখন তো আর প্রাক-স্বাধীনতা আমলের বিদেশি শাসকগোষ্ঠী নেই যে সব অন্যায়-অবিচার-অনিয়ম-বঞ্চনা-লাঞ্ছনার জন্য তাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাব। এখন আমরাই বাদী, আমরাই বিবাদী। একাত্তরের স্বাধীনতার পর আমরা যে দেশটিকে পেয়েছিলাম, যে দেশটির জন্য আমাদেরই লাখো শহীদ জীবন উৎসর্গ করেছিল, নিজেদের তরতাজা বর্তমানকে বিসর্জন দিয়েছিল আমাদের একটি স্বর্ণকান্তিময় ভবিষ্যতের জন্য, সেই দেশ আজ নীরবে-অলক্ষ্যে অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছে ২০২৪-এর জুলাইয়ে, তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে মিটফোর্ডের হতদরিদ্র সোহাগ মিয়ার করুণ পরিণতি অবলোকন করে। একটি মানুষকে মধ্যযুগীয় কায়দায়, কিংবা তারও আগে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের পাশব শক্তির মতো প্রকাশ্য দিবালোকে নিষ্ঠুরভাবে কে হত্যা করল? না কোনো বিদেশি শক্তি নয়, কোনো রণক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের হাতে নির্মমভাবে নিহত নয় সোহাগ মিয়া, তাকে হত্যা করল তারই দেশবাসী কজন মানুষ। আর শুধু হত্যা করেই থেমে থাকল না তারা, তার নিথর শবদেহ নিয়ে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠল সেই ‘আসব বলের পাশবমত্তরা’। সেই মর্মান্তিক দৃশ্যটি পাশে দাঁড়িয়ে অবলোকন করল যারা তারাও বাঙালি।
বিশ্ববাসী কী দেখল? দেখল, যে বাঙালি তাদের কোমল স্বভাব ও নম্রভদ্র আচরণের জন্য আবহমানকাল পৃথিবীর মানুষের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা পেয়ে এসেছে, তারা আজ বর্বরতায়, নিষ্ঠুরতায় অন্য যেকোনো দেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সোহাগ ওরফে লাল চাঁদকে দুর্বৃত্তরা পেটাতে পেটাতে মিটফোর্ড হাসপাতালের সম্মুখের রাস্তা থেকে হাসপাতাল চত্বরের ভেতরে নিয়ে আসে। সেখানে হাসপাতালের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল আনসার বাহিনীর একটি ক্যাম্প। তাদের চোখের সামনেই দুর্বৃত্তরা লাল চাঁদকে বেধড়ক মারধর করে মাটিতে ফেলে দেয় এবং আধলা ইট দিয়ে তার মাথায় বেদম আঘাত করে করে তাকে মেরে ফেলে। আর আমাদের প্রশিক্ষিত আনসার বাহিনীর সদস্যরা সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। আবারও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সেই প্রায়শ অভিনীত ‘নীরব দর্শকের ভূমিকা’! হায়, যদি দুজন মানুষও সেদিন লোকটাকে বাঁচাতে এগিয়ে যেত, তাহলে অসহায় মানুষটিকে এভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হতো না। এই কি বাঙালির চিরায়ত একের বিপদে অন্যের বুক পেতে দেওয়ার গৌরবময় ঐতিহ্য। বিদেশিরা চিরকাল বলে এসেছে, বাঙালিরা গরিব হতে পারে, কিন্তু তারা খুবই ভদ্র, পরোপকারী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াকু জাতি। লাল চাঁদের করুণ মৃত্যু কি তারই নমুনা? সেদিন অকুস্থলে উপস্থিত আনসার (যে শব্দটির বাংলা অর্থ সাহায্যকারী) সদস্যরা ও পথচারীরা একি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল? তাদের নিস্পৃহতা ও ক্লীবত্ব পুরো জাতির মুখে যে কলঙ্ক-কালিমা লেপে দিল তা কি সহজে মুছে যাবে? না, নিশ্চয়ই না। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেল এটাই যে এখন থেকে কেউ আর এগিয়ে আসবে না একটি অসহায় মানুষের জীবন রক্ষার্থে। যে কুদৃষ্টান্ত ছিল জাতির দুই চোখের বিষ, তা-ই এখন একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয়ে গেল। যে তরুণদের আমরা হরহামেশা উঠতে-বসতে নানা বিষয়ে নসিহত করি, বক্তৃতায়-বিবৃতিতে উপদেশামৃতের ফোয়ারা ছোটাই, তারা যদি এখন বলে ‘চাচা, আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধ করুন আপনাদের এইসব অমূল্য নসিহতনামা, তার চেয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ভেতরের আনসার ক্যাম্পের সদস্যদের এবং লাল চাঁদ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী বাঙালিপুঙ্গবদের মতো কী করে মৃত সৈনিকের ভূমিকা পালন করব সে বিষয়ে সবক দিন, যাতে দিনশেষে বলতে পারি, এই দেশেরই গত শতাব্দীর গোড়ার দিকের কবি কামিনী রায়ের বহুল উচ্চারিত পঙক্তি ‘পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও’ ভুল ছিল, ভুল ছিল পরোপকারী হয়ে জীবন উৎসগ করার মূলমন্ত্র।
এত দুঃখ, এত গ্লানির মধ্যে একটা বিষয় অবশ্যই কিছুটা হলেও শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। সোহাগ ওরফে লাল চাঁদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশের মানুষ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। তারা কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়, তারা সাধারণ মানুষ। সাইলেন্ট মেজরিটি। আর তারা শুধু রাজধানীর অমুক মোড়ে, তমুক সভাস্থলে জড়ো হওয়া সচেতন নাগরিক নয়, তাদের অনেকেই হয়তো রাজনীতিতে জড়িত আছে, তবে বেশির ভাগই রাজনীতিবিমুখ ছা-পোষা মানুষ। তারা স্বজনহারার বেদনা নিয়ে সমবেত হয়েছে প্রতিবাদ জানাতে, বিচারপ্রার্থী হয়ে। উনিশ শ চব্বিশের জুলাইয়ে এরাই ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সম্মুখসারির সৈনিক। সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য যেকোনো সংগ্রামে এরা যখন সম্পৃক্ত হয়ে যায় তখন জাতি স্বপ্ন দেখে সুদিনের। লাল চাঁদের করুণ মৃত্যু সেই সাইলেন্ট মেজরিটি বা জাতির সুপ্ত বিবেককে জাগ্রত করেছে সেটাই বড় সান্ত্বনা। আশা করব আমাদের বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ, সুদক্ষ কর্তৃপক্ষও সুষুপ্তি ঝেড়ে এবার আরেকটু নড়েচড়ে বসবে।
সব কথার শেষ কথা আজকের এই লেখাটি কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল বা মতের পক্ষে-বিপক্ষে নয়—এটি মানবতার পক্ষের একটি লেখা। লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ কোন দল করত, তার রাজনৈতিক পরিচয় কী ছিল, এগুলো অবান্তর। তার প্রথম এবং প্রধান পরিচয় সে একজন মানুষ। আমার, আপনার মতো একজন রক্ত-মাংসের মানুষ। দোষে-গুণের মানুষ। একটি স্বাভাবিক মৃত্যুর দাবিদার এই দেশের একজন মানুষ। বহুকাল আগে শ্রদ্ধেয় প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেনের একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। সেই মৃত্যু দল-মত-নির্বিশেষে সবারই কাম্য। কারণ সব কিছুর আগে একজন মানুষের আদি ও অকৃত্রিম পরিচয় সে একজন মানুষ।
লেখক : সাবেক সচিব ও কবি
mkarim06@yahoo.com