বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন দেশের প্রায় আট কোটি বাস্তুচ্যুত মানুষের মধ্যে ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অধিক ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর প্রবল নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। শুরুতেই বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় লোকজনসহ সর্বস্তরের মানুষ ত্রাণ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে এবং কক্সবাজারের বনভূমি ও কৃষিজমিতে রোহিঙ্গাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে। প্রতিবছর ৩০ হাজারের বেশি শিশু জন্মগ্রহণের পাশাপাশি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০ থেকে ৭০ হাজার জন বাস করায় সেখানে ‘স্থানসংকট’ প্রকট রূপ ধারণ করছে।
ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর যে কারণে দরকার
- তন্ময় চৌধুরী
অন্যান্য

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক জান্তার সহিংস উচ্ছেদ অভিযানের কারণে রোহিঙ্গারা যখন নিঃস্ব ও রক্তাক্ত অবস্থায় বাংলাদেশ সীমানায় প্রবেশ করে, তাত্ক্ষণিকভাবে প্রায় ছয় হাজার একর বনভূমি ও পাহাড় কেটে তাদের জন্য সাময়িক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততায় রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা শুরু করে বাংলাদেশ সরকার। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক হওয়ায় সে দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মিয়ানমারের অনিচ্ছা ও অসহযোগিতার কারণে দীর্ঘ চার বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
পরিবেশগত বিপর্যয় ছাড়াও স্থানীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতির দিকে আলোকপাত করলে যে ভয়ংকর দৃশ্য সামনে আসে, তাতে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কক্সবাজারে সমতল ভূমি অপ্রতুল হওয়ায় পাহাড়বেষ্টিত বনভূমি ধ্বংস করে বানানো ঝুঁকিপূর্ণ অনেক ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা অবস্থান করায় প্রায়ই ঘটছে বিভিন্ন দুর্ঘটনা। প্রতিবছর বর্ষাকালে ভূমিধসের উচ্চঝুঁকিতে থাকে দুই হাজার ৮০০ হেক্টর উপত্যকা এলাকায় বসবাসরত হাজারো বাস্তুচ্যুত পরিবার। কক্সবাজারে গত জুলাই মাসে ভূমিধসে রোহিঙ্গাসহ ২৩ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং অনেকে আহত হয়। অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা দেখা দিলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, যা বিভিন্ন রোগ তৈরির উৎস হিসেবে কাজ করে। গত জুলাই মাসে বন্যার কারণে চার শিশুসহ ১১ জন রোহিঙ্গা মৃত্যুবরণ করে এবং চার হাজার ঘর পানিতে তলিয়ে যায়, যার ফলে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা আবাসহীন হয়ে পড়ে। মাদক ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ থাকায় এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগিয়ে থাকে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ক্যাম্পগুলোর অস্থায়ী ঘরগুলো লাগোয়া এবং দাহ্য পদার্থ বিশিষ্ট হওয়ায় আগুন দ্রুত এক ঘর থেকে অন্য ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভাসানচরের ঘরগুলো ইটের তৈরি এবং পরিকল্পিত হওয়ায় সে ধরনের ঝুঁকি অনেকটাই কম। তাই জীবনের ঝুঁকি কমাতে এবং উন্নততর ও নিরাপদ পরিবেশে জীবন নির্বাহে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যাওয়া উচিত। অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ভাসানচর থেকে পালিয়ে থাকে বলে শোনা যাচ্ছে, যাদের বেশির ভাগই মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত বা এর শিকার। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলোর ত্রাণ কার্যক্রম দ্রুত শুরু হলে ভাসানচরের প্রতি রোহিঙ্গাদের আগ্রহ আরো বাড়বে বলে মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেন। বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শন শেষে ইইউ, ওআইসি এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা ও জীবনযাত্রার সার্বিক অবস্থা বিষয়ে খুবই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন এবং জাতিসংঘ ভাসানচরের সার্বিক কার্যক্রমে যুক্ত হবে বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে।
ভাসানচর একটি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা হওয়ার যেসব আপত্তি শুরুতে ছিল, তা সাম্প্রতিক সময়ে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ ও ‘ইয়াস’-এর পরবর্তী টেকসই ও সহনশীল ভাসানচরের চিত্র দ্বারা খণ্ডিত হয়। তাই শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরকে ‘শান্তির চর’ বললেও ভুল হবে না। পরিকল্পিত ও প্রশস্ত আবাসন, স্কুল, মাঠ, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও সাইক্লোন শেল্টারসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে ভাসানচরে। রোহিঙ্গাদের জীবন মানোন্নয়নে ভাসানচরে বর্তমানে ২২টি এনজিও সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলো কার্যক্রম শুরু করলে ১৬ হাজার একর ভাসানচরে আরো কর্মসংস্থানমূলক নতুন প্রচুর প্রকল্প (যেমন—মৎস্য আহরণ, গবাদি পশু পালন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কারখানা স্থাপন ইত্যাদি) বাস্তবায়নের সুযোগ রয়েছে, যা কক্সবাজারের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পগুলোতে অসম্ভব। ভাসানচরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য ‘চট্টগ্রাম-হাতিয়া থেকে ভাসানচরের সঙ্গে নৌযোগাযোগ উন্নয়ন’ নামে একটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এতে ভাসানচর ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের মধ্যে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় পণ্য আনা-নেওয়া আরো সহজ হবে। প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাংলাদেশ সরকারের এমন মহৎ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আরো বেসরকারি সংগঠনগুলো দ্রুত সম্পৃক্ত হলে মিয়ানমারে গণহত্যা ও বীভৎস অবস্থার শিকার এই হতাশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘পোস্ট ট্রমাটিক গ্রোথ ও রেজিলিয়েন্স’ গঠন সহজ হবে।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের একমাত্র উপায় হলো রোহিঙ্গাদের তাদের আদিনিবাস রাখাইনে প্রত্যাবাসন করা। কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামরিক অভ্যুত্থান তাতে অনেকটা অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এমন অনিশ্চিত ও দীর্ঘ সময়ের জন্য ১১ লাখ রোহিঙ্গার জনাকীর্ণ অবস্থায় কক্সবাজারের পাহাড়ঘেঁষা ভূমিতে অবস্থান তাদের জীবনের ওপর হুমকি তৈরি করবে। তাই এক লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তরিত হলে তাদের নিজেদের মধ্যে কোন্দল কমে সদ্ভাব তৈরি হবে এবং বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনগুলোর পক্ষে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনা করা সহজ হবে।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক
ctonmoy555@gmail.com
সম্পর্কিত খবর

ক্রীড়াঙ্গনে কতটুকু প্রাপ্তি চেতনে ও অবচেতনে
- ইকরামউজ্জমান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে কতটুকু প্রাপ্তি চেতনে ও অবচেতনে? গত এক বছরের সংস্কার একটি বহুল শ্রুত শব্দে পরিণত হয়েছে। মানুষ এই রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কিভাবে দেখতে চেয়েছে। চব্বিশের মূল দর্শন ক্রীড়াঙ্গনের ক্ষেত্রে হলো নারী-পুরুষে বৈষম্যের অবসান, গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে সংগঠকদের মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার। আর এটি অগ্রাধিকার নির্ণয় করে; কেননা সংস্কার তো একটি চলমান বিষয়, এটি ছাড়া তো ক্রীড়াঙ্গন অচল ও অকার্যকর হতে বাধ্য।
মানুষ তো কেবল তার স্বপ্নের সমান। সে আশা করে, অপেক্ষা করে। বাস্তবতার জমিনে দাঁড়িয়ে যদি আমরা সঠিকভাবে ক্রীড়াঙ্গনকে আত্মস্থ করতে পারতাম, তাহলে আগামী দিনে আমরা অনেক বেশি স্বপ্ন দেখতে পারতাম। তবে ক্রীড়াঙ্গনে একটি ঝাঁকুনি দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠকরা যদি খেলাকে ভালোবেসে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে সবাই মিলে লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে বিভিন্ন খেলা দারুণভাবে ‘সাফার’ করবে। ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে কাজ করানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান তো নেই।
বর্তমানে পুরো দেশে সার্বিক ক্রীড়াঙ্গনের অবস্থা মোটেই ক্রীড়াবান্ধব নয়। অপ্রিয় শোনালেও এটাই বাস্তবতা। ব্যক্তিস্বার্থ থেকে ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থকে বড় করে দেখতে না পারলে ক্রীড়াঙ্গনে পরিবর্তনের সুফল পাওয়া যাবে না। জোড়াতালি আর ধামাচাপা দিয়ে ক্রীড়াঙ্গন চলবে না। এ ক্ষেত্রে মৌলিক বিষয়গুলো আমলে রাখতেই হবে। ক্রীড়াচেতনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্রীড়াঙ্গনে আস্থা ও বিশ্বাসের বিকল্প নেই। মানুষ এখন ক্রীড়াঙ্গনকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করেছে। তারা ক্রীড়াঙ্গনের মধ্যে দেশকে দেখতে চায়। দেখতে চায় জাতিচরিত্রের প্রতিফলন। ক্রীড়াঙ্গনের সবকিছু স্পষ্ট হওয়া উচিত। আমরা অনেক বেশি আশা করেছি—ভাবা হয়েছে, আমরা একবারে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলব। এটি কিন্তু সম্ভব নয়। সমস্যার পরিধি তো ব্যাপক। সবাই লক্ষণ নিয়ে ভাবছেন, মূলের দিকে তাকাচ্ছেন না। ক্রীড়াঙ্গন বোঝাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ক্রীড়াঙ্গনে যেমন অতীতকে আঁকড়ে ধরে রাখার সুযোগ নেই, তেমনি সুযোগ নেই অতীতকে অস্বীকার করার। খেলার চর্চা একটি লম্বা সফর। এই সফরে আছে টিমের নিরলস চেষ্টা। আছে সফলতা, ব্যর্থতা আর সীমাবদ্ধতা। খেলার চর্চাকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে, এটি দরকারি বিষয়। প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন এবং সাফল্যের স্বাদ পেতে পারেন, যদি তিনি যা করছেন তার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ও সত্যিকারের আন্তরিক হন।
একসময়ের ‘ঢাকা স্টেডিয়াম’-এর নাম বদল করে ১৯৯৬ সালে নতুন নামকরণ হয়েছে। এরপর আবার চলতি বছর (২০২৫) সেই স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়েছে ‘জাতীয় স্টেডিয়াম’। এটি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে এই স্টেডিয়াম সুস্থভাবে ক্রীড়াচর্চার মাধ্যমে প্রাণচঞ্চল হচ্ছে কি না এটি গুরুত্বপূর্ণ। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো স্টেডিয়ামের সঠিক ব্যবহার, এর রক্ষণাবেক্ষণ। ‘মেইন সাবজেক্ট’ থেকে ‘ঐচ্ছিক সাবজেক্ট’ তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবেগের প্রয়োজন আছে, কিন্তু শুধু আবেগ দিয়ে ক্রীড়াঙ্গন চলে না।
ক্রীড়াঙ্গনকে ঘিরে শূন্যে বুলি আর আশ্বাসের বাণী শোনানোর দিন এখন আর নেই। সচেতনতা বেড়েছে। বেড়েছে সাদা-কালো বোঝার ক্ষমতা। এরই মধ্যে অনেক বেলা হয়ে গেছে। মানুষ এখন দেখতে চায় কল্যাণমুখী ক্রীড়াঙ্গন। দেখতে চায় ন্যায়ভিত্তিক সমতার ক্রীড়াঙ্গন। দেখতে চায় উপেক্ষা আর অবহেলার অবসান। ক্রীড়াঙ্গনে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের খেলা বন্ধ হওয়া দরকার। দরকার সুবিধাভোগীদের খপ্পর থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে মুক্ত করা।
ক্রীড়াঙ্গনে সমস্যা হলো নীতিতে সমন্বয়হীনতা ও নেতৃত্বের অভাব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিন্তার জগৎ সেই পুরনো দিকেই থেকে গেছে। জীবন কিংবা খেলাধুলা তো রূপকথার গল্পের মতো নয়। অনেক সময় কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যেতে হবে। মেনে নিতে হবে। একে অপরকে দোষারোপ করে, একে অপরকে হিংসা করে বিরুদ্ধাচরণ ও অভিযোগ উত্থাপন করে তো সমস্যার সমাধান হয় না। প্রয়োজন যে খেলাই হোক না কেন, সেই খেলার স্বার্থে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ ও ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে কাজ করা।
আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে হওয়া উচিত একটি উদ্দেশ্য নিয়ে টেকসই মডেল, যা কাঠামোগত সমস্যার সমাধান করে এবং সবার জন্য ক্রীড়াঙ্গন নিশ্চিত করবে। পদে পদে ক্রীড়াঙ্গনে সব সময় বড় বেশি অজুহাত। ক্রীড়াঙ্গনের ভালো চাইলে, ক্রীড়াঙ্গনকে যুগোপযোগী করতে হলে প্রয়োজন জিরো অজুহাত নীতিতে কাজ করা। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে উদ্ভাবনী শক্তিটা সত্যি দুর্বল। একটি ধারণা আরেকটি ধারণার জন্ম দেয়। উদ্দেশ্য নিয়ে যখন উদ্ভাবন হয়, তখন তাতে আসে স্থায়ী পরিবর্তন। ক্রীড়াঙ্গনে সাময়িক আত্মতৃপ্তি বলতে কিছু নেই।
খেলাধুলায় নেতৃত্ব বিকাশে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা আছে। সার্চ কমিটি কাজ করতে গিয়ে সেটি লক্ষ করেছে। তবে সমস্যার সমাধানে তারা আশাব্যঞ্জক কাজ করতে পেরেছে, এটি বলার সুযোগ নেই। ক্রীড়াঙ্গনে উন্নয়নের সুফল পেতে হলে তৃণমূল থেকে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সেদিকে নজর কম। খেলোয়াড় তো জন্মায় না, সৃষ্টি করতে হয়; আর সেটি একেবারে এন্ট্রি লেভেল থেকে। এই যে আমাদের নারী ফুটবলাররা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে দেশের মানুষকে গর্বিত করেছেন, পাশাপাশি ফুটবলে নতুন সম্ভাবনার বড় দরজা খুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন, এর পেছনে আছে একটি ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন মেয়েরা। কিভাবে ফুটবলে তৃণমূল থেকে ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন। দেশজুড়ে প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ের ফুটবল মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গনে এনেছে।
ক্রীড়াঙ্গনে দায় স্বীকার করে নেওয়ার সংস্কৃতির প্রয়োজন। ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিদিনের আলোচনা ও গল্পে স্বস্তি বিরাজ করুক। ক্রীড়াঙ্গনে বাস্তবতার পৃষ্ঠপোষকতা হোক। ক্রীড়াঙ্গন ঘিরে দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার জগৎ বড় হোক।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।

ভূতত্ত্ব শিক্ষায় আরো গুরুত্ব দিতে হবে
- মো. ইউসুফ গাজী

ভূতত্ত্ব শুধু মাটি, পাহাড় বা পাথরের বিজ্ঞান নয়; এটি আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত একটি বিষয়। কৌশলগত ও প্রযুক্তিনির্ভর বিষয় হিসেবে এটি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও শিল্পায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। অথচ বাংলাদেশে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখনো পরিকল্পনার অভাব ও সীমিত কর্মক্ষেত্রের কারণে সম্ভাবনার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। ভূমিকম্প, ভূমিধস, নদীভাঙন, বন্যা ও ভূগর্ভস্থ পানির সংকটের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঠিক পূর্বাভাস, বিশ্লেষণ ও প্রতিকারের জন্য পর্যাপ্ত ভূতাত্ত্বিক জ্ঞান ও দক্ষতা অপরিহার্য।
বর্তমানে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব পড়ানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন নামে ভূতত্ত্ববিষয়ক অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। দুঃখের বিষয়, এত দিন পর্যন্ত দেশের শিক্ষা ও নীতিনির্ধারণে ভূতত্ত্বকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
এ জন্য পেট্রোবাংলা, বাপেক্সসহ অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত তেল ও গ্যাস কম্পানি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে আরো নিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে ভূতত্ত্ববিদদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। বেসরকারি পর্যায়ে জিওটেকনিক্যাল কনসালটেন্সি ফার্ম, খনিজ অনুসন্ধান কম্পানি, নির্মাণ ও পরিবেশ মূল্যায়ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস কম্পানি এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় ভূতত্ত্ববিদদের অন্তর্ভুক্তির জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।
ভূতত্ত্ব বিষয়টিকে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হতে পারে। এই বিষয়ে অগ্রগতি আনতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের শীর্ষ কলেজগুলোতে প্রাথমিকভাবে মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।
তবে সদ্য ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভূতত্ত্ব বিষয়ে অনাগ্রহের একটি প্রধান কারণ হলো এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক ধারণা না থাকা। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ভূতত্ত্ব বিভাগগুলো সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রতিযোগিতা ও ল্যাবরেটরি পরিদর্শনের আয়োজন করতে পারে। এসব কর্মসূচিতে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিলে তাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হবে এবং বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা বাড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ এরই মধ্যে এ ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছে, যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। ভূতত্ত্বের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমে ভূতত্ত্বের বহুমাত্রিক দিকগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার্থীরা ভূতত্ত্বকে শুধু মাটি, পাথর বা শিলার বিজ্ঞান হিসেবে না দেখে এর বহুমুখী গুরুত্ব বুঝতে পারে।
বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বাস্তবতা, দুর্যোগপ্রবণতা ও প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষাপটে ভূতত্ত্ব বিষয়ে দক্ষ জনবল গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যথাযথ পরিকল্পনা, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা গেলে ভূতত্ত্বকে আরো কার্যকর, আকর্ষণীয় ও সময়োপযোগী একটি ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান : প্রাপ্তি প্রত্যাশা ও ইতিহাসের দায়
- শায়রুল কবির খান

২০২৪ সালের ১ জুলাই একটি আপাতদৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। কিন্তু কেউ কি জানত, এই সাধারণ দাবিই মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে রূপ নেবে এক রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানে? যার পরিণতিতে বদলে যাবে দেশের ক্ষমতার চিত্রপট, আর দীর্ঘ ১৬ বছরের একক শাসককে বাধ্য করবে দেশ ছেড়ে পালাতে? হ্যাঁ, ১৫ জুলাই থেকে সেই আন্দোলনে নামল গুলি, ছিটল রক্ত, আর ঢাকঢোল ভেঙে উঠল জনতার স্বর : ‘গণতন্ত্র চাই!’ শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্টে পতন হলো শেখ হাসিনা সরকারের—এক নজিরবিহীন, অনিবার্য পতন।
রক্তাক্ত রাজপথের স্লোগান ও শহীদের আত্মত্যাগ : সেই ৩৬ দিন রাজপথজুড়ে উচ্চারিত হচ্ছিল এমন সব স্লোগান, যা শুধু রাজনীতি নয়, জাতির আত্মাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। রাজপথ যে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল—‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘আমার খায় আমার পরে, আমার বুকে গুলি করে’, ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে’, ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছেড়ে দে’, ‘চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন, এই ফাল্গুনেই হবে দ্বিগুণ’, ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’।
জুলাই ও আগস্টের সেই ৩৬ দিন কোনো সাধারণ রাজনৈতিক মোড় ছিল না; এটা ছিল এক যুগান্তকারী গণ-আন্দোলনের বিস্ফোরণ। শহরের অলিগলি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, গ্রামীণ হাট থেকে দেশের প্রশাসনিক ভবন পর্যন্ত প্রতিটি জায়গা রূপ নিয়েছিল সংগ্রামের মঞ্চে। নির্মম সত্য হলো, এই বিপ্লব শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শুরু থেকে প্রতিদিন গণমাধ্যমে শহীদদের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু সংখ্যাই নয়, বরং প্রতিটি নামের পেছনে আছে এক করুণ গল্প। এই গণ-আন্দোলনে জাতীয় গণমাধ্যমের অসংখ্য শিরোনাম বিশ্ববাসীকে স্পর্শ করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি শিরোনাম ছিল : ‘যা বাবা, ভালো থাকিস বলে গুলিতে শহীদ সাঈদকে চিরবিদায় মায়ের’, ‘মুগ্ধর আন্দোলন তো এখনো শেষ হয়নি’, ‘অটোরিকশায় বসে কোলে করে ছেলের লাশ বাসায় আনি’, ‘কোটা আন্দোলনে শহীদ ফারহান এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে’, ‘আমার ডাক্তার ছেলেকে তারা গুলি করে মারবে কেন?’, ‘মেয়ের জন্য চিপস কিনে বাসায় ফিরতে পারলেন না মোবারক হোসেন’, ‘যাত্রাবাড়ীতে সংঘর্ষ : রোহান আর মাহাদীর স্বপ্ন থেমে গেল গুলিতে’, ‘আমার নিরীহ ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে ওরা’। এসব শিরোনাম শুধু সংবাদ নয়, এগুলো একেকটি ফেটে পড়া হৃদয়ের আর্তনাদ।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসনের আকাঙ্ক্ষা : এই অসংখ্য শহীদ, আহত ও ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত লাশের ওপর দাঁড়িয়েই জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অর্জিত হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা একটাই—গণতন্ত্র, যার সঙ্গে পুরোপুরিভাবে জড়িত ভোটাধিকার, মানবাধিকার ও সুশাসন। এর কোনো বিকল্প নেই, কোনো যুক্তিও নেই।
এই অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে অনেকেই নানা দাবি করছেন। তবে প্রকৃত সত্য হলো, ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামই এই গণ-অভ্যুত্থানের পথ তৈরি করেছে। ধাপে ধাপে কোটাবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে এটি চূড়ান্ত এক দফায় রূপ নেয়, যা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষণা করেছিলেন। ৩ আগস্ট কারাগারে আটক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সহধর্মিণীকে দেখতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার এই আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সফল হবে, তা কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
শুধু বিএনপি নয়, অনেক বামপন্থী, মধ্যপন্থী দল, পেশাজীবী, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ কৃষক-মেহনতি মানুষ—সবার এক দাবিতে মিলেছিল কণ্ঠস্বর : ‘শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসান চাই’।
দমনের চেষ্টা ও জনগণের জাগরণ : ১৮ জুলাই সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিকল হয়ে পড়ায় তথ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার একতরফা ভাষ্য প্রচার করে যায়। সরকারের কথা শুনে মনে হয়েছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সব দাবি পূরণ হয়ে গেছে। ছাত্রদের হৃদয় প্রশান্ত হয়েছে। যেন ক্ষোভ যা চলছে, তা শুধুই বিএনপিসহ বিরোধী গোষ্ঠীর তৎপরতা।
মূলত উচ্চ আদালতের যুক্তিসংগত রায়ের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের কোটা সংস্কার দাবিটি পূরণ হয়েছিল বলা যায়। তবে এই দাবি পূরণের পথ তাদের সহযোদ্ধা ও সহপাঠীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বহু ছাত্রসহ ১৫ দিনে শতাধিক মানুষ জীবন হারিয়েছেন। আরো অনেক বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়েছেন। হাসপাতালে গিয়ে আহত মানুষ পুনরায় আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্রসহ তাদের সমর্থকদের ওপর এই নির্বিচার আক্রমণ করেছে সরকারি দলের অনুগত সংগঠন ও সরকারের বাহিনীগুলো। এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে সরকারি দলের নেতাদের নির্দেশ বা উসকানিতে—এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ গণমাধ্যমে ছিল।
সরকারি স্থাপনায় নাশকতার জন্য তদন্তের আগেই ঢালাওভাবে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাদের দায়ী করে গ্রেপ্তার করে দাম্ভিকতা দেখানো হয়েছিল। এই দাম্ভিকতা তৈরি হয়েছিল ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি করে সমাবেশ পণ্ড করার মধ্য দিয়ে।
শত শত ছাত্র এবং হাজারো মানুষের রক্তে রঞ্জিত এই আন্দোলন আপামর জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কি না, এতে দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, নিপীড়নে অতিষ্ঠ মানুষের ক্ষোভ যুক্ত হয়েছে কি না, সরকার তা নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ না করে রাজনৈতিক হয়রানি করেছিল।
গণ-অভ্যুত্থানের স্লোগান আর ঘটনাগুলোর শিরোনাম কোনোভাবেই বৃথা হতে দেওয়া যাবে না। এর আকাঙ্ক্ষা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন, যা নাগরিকদের মাঝে আরো শক্তিশালী হচ্ছে। কারো কাছ থেকে এই আকাঙ্ক্ষা বিন্দুমাত্র হারিয়ে যায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার ও ভবিষ্যতের দায় : দেশকে গভীর সংকট থেকে উত্তরণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এখন সংস্কারের পথে হাঁটছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, শহীদদের রক্ত কি সত্যিই বৃথা যাবে না? গণ-অভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা—গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে?
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যেভাবে নিরলস চেষ্টা করে চলছে, জনগণ তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সে জন্য দেশের কল্যাণে সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এই অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতন নয়; এটি একটি ব্যবস্থার পরিবর্তনের সূচনা। কিন্তু প্রকৃত পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন এই রক্তাক্ত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারব। শহীদদের স্বপ্ন ছিল একটি সুন্দর বাংলাদেশ, যেখানে কোনো স্বৈরাচার, কোনো নিপীড়ন থাকবে না। গণ-অভ্যুত্থানের এই অর্জন ধরে রাখতে হলে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। কারণ ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, স্বৈরাচারের ফিরে আসার চেষ্টা কখনোই থামে না। কিন্তু জনগণের জাগরণই পারে তাকে রুখে দিতে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংস্কৃতিকর্মী

শহীদের রক্তে ধোয়া রাজপথ
- সাঈদ জুবেরী

বাংলাদেশের রাজপথ রক্ত দিয়ে ধোয়া হয় বারবার। স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জন ও বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা কম নয়, বরং অনেক বেশি রক্তই ঝরেছে এই পোড়া দেশের জমিনে। লক্ষ্য অর্জিত হোক বা না হোক, শহীদের রক্তের দাগ অচিরেই শুকিয়ে যায়। কিন্তু দিবস থেকে যায়।
আমরা যারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চাক্ষুষ করেছি তারা জানি ১৬ জুলাইয়ের আগের আর পরের রূপ আলাদা। দিনটিকে বদলে দিয়েছিলেন একটা নিরীহ তরুণ।
দুই হাত প্রশস্ত করে বুক পেতে ঘাতকের সামনে দাঁড়ানো আবু সাঈদের দুঃসাহসিক মৃত্যুদৃশ্য ইন্টারনেটের যুগে মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় দুনিয়াব্যাপী। তাঁর মৃত্যুই পুরো আন্দোলনের গতি পাল্টে দেয়। কোটা সংস্কার, বৈষম্যবিরোধী ইত্যাদির আড়াল থেকে জনদাবি নির্দিষ্ট হয়ে যায়—স্বৈরাচারের পতন। মানুষের ভয় ভেঙে যায়। মাত্র ২০ দিনের মাথায় দুনিয়ার দীর্ঘতম স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটে।
যুগে যুগে এই পোড়া দেশে গণ-আন্দোলনে নামতে হয়েছে মানুষকে। আর প্রতিটি আন্দোলনে বদলেছে স্লোগান; কিন্তু দাবি সেই একই—গণতান্ত্রিক মুক্তি। স্বাধীনতার আগে গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক ছিলেন শহীদ আসাদ। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক পুরান ঢাকার বনগ্রামের নূর হোসেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের ইতিহাসেই অভূতপূর্ব ও সবচেয়ে শক্তিশালী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান তথা ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের’ প্রতীক রংপুরের আবু সাঈদ।
নিঃসন্দেহে আসাদ, নূর হোসেন আর আবু সাঈদের রাজনৈতিক লড়াই এক ছিল না। কিন্তু তাঁদের আকাঙ্ক্ষার মিল ছিল। আমাদের রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি আসাদ, নূর হোসেনের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। বৈষম্যহীন দিন আসেনি, গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। নূর হোসেনের রক্তের সঙ্গে তাঁর দল আওয়ামী লীগ শুধু প্রতারণাই করেনি, দলটি দেশে কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয় দেড় যুগ। যা থেকে মুক্তি পেতে আবু সাঈদকে দুই বাহু প্রসারিত করে দাঁড়াতে হলো মৃত্যুর মুখে।
একটু শঙ্কার কথা দিয়ে এই ক্ষুদ্র পরিসরের লেখাটি শেষ করি। জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি এখনো তাজা। তাই হাসিনাশাহির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিমসহ প্রত্যেক শহীদ এখনো আমাদের সবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছেন। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে শহীদদের অবমাননা এবং অস্বীকারের একটা ভয়ংকর চর্চা আমাদের রাজনীতিতে রয়ে গেছে। হোক তা মহান মুক্তিযুদ্ধ কিংবা নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা। সবচেয়ে নিকট অতীত নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের প্রতীক নূর হোসেনের কথাই ধরা যাক। তাঁর আত্মাহুতির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতারণা তো আওয়ামী লীগ করেছেই, উপরন্তু নূর হোসেনের হত্যাকারী জাতীয় পার্টি নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের নায়ককে ‘টোকাই-নেশাখোর’ বলারও দুঃসাহস দেখিয়েছে। অন্যদিকে একাত্তরের পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতাকামীদের বলত দুষ্কৃতকারী। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের আমরা রক্ষা করতে পারব তো। শেষ করি জুলাই ২৪-এর রক্ষক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সাম্প্রতিক জনপ্রিয় স্লোগান দিয়ে—‘আবু সাঈদ, মুগ্ধ/শেষ হয়নি যুদ্ধ।’
লেখক : কবি, সাংবাদিক