আমাদের দেশে একটি বড় সমস্যা হলো সব দিক আটঘাট বেঁধে মানসম্পন্ন সব নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই নতুন কোনো কিছু শুরু করে দেওয়া হয়। ফলে পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই বড় ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দেয় এবং শুরু হয়ে যায় হৈচৈ। সেই সঙ্গে নতুনভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।
দেশে ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ
- নিরঞ্জন রায়
অন্যান্য

প্রয়োজনীয় সব নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত না করে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত দেশে ই-কমার্স চালু করা এবং সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইভ্যালি কেলেঙ্কারি হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় অঘটন। সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, এই অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের কাছ থেকে ২১৪ কোটি অগ্রিম গ্রহণ করেছে, কিন্তু এর বিপরীতে পণ্য সরবরাহ করেনি। অর্থাৎ গ্রাহকরা অনলাইনে ২১৪ কোটি টাকার অর্ডার দিয়ে অর্থ পরিশোধ করলেও পণ্যসামগ্রী এখনো বুঝে পায়নি।
ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসার যে দুটি ন্যূনতম শর্ত রয়েছে তা এখানে মেনে চলতে আদৌ বাধ্য করা হয়নি। আর এই দুটি শর্ত হলো পণ্য ফেরত পলিসি এবং অর্থ পরিশোধ পলিসি। ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১-এর ৩.৩.২ অনুযায়ী ক্রেতা-বিক্রেতা একই শহরে অবস্থিত হলে সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অথচ অনলাইন ব্যবসা বা ই-কমার্সের ক্ষেত্রে এই শর্তটি এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রয় করা পণ্যসামগ্রী ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং অর্থ পরিশোধের শর্ত। অনলাইনে কোনো কিছু অর্ডার দেওয়ার সময় উল্লেখ থাকে যে ডেলিভারি কবে নাগাদ হতে পারে। সেই বুঝেই একজন ক্রেতা অর্ডার দেবেন। যেমন—অর্ডার দেওয়া পণ্য যদি ডেলিভারির জন্য মজুদ না থাকে এবং সে ক্ষেত্রে যদি সরবরাহকারীর কাছ থেকে ডেলিভারি দিতে হয়, তাহলে এই পাঁচ দিনের শর্ত মেনে চলা মোটেই সম্ভব নয়। আমি আমাজনে বাংলাদেশের একটি বই অর্ডার দিতে গিয়ে দেখি ডেলিভারি দিতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগবে, তাই আর অর্ডারটি প্লেস করিনি।
ই-কমার্সের বা অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে অর্থ পরিশোধের পদ্ধতিটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কখন ক্রেতার হিসাব থেকে অর্থ নেওয়া হবে সেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেহেতু ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা একটি প্ল্যাটফর্ম মাত্র। এই প্রতিষ্ঠানের বিক্রীত পণ্য যে সব সময় তাদের নিজস্ব গুদাম থেকে যাবে তেমন কোনো কথা নেই। তাদের অনুমোদিত সরবরাহকারীর কাছ থেকেও সরাসরি ক্রেতার কাছে চলে যেতে পারে। ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে ঠিকমতো মূল্য পাওয়া এবং যথাসময়ে পণ্যসামগ্রী বুঝে পাওয়া—এই দুইয়ের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সব সময়ই থাকে। তা ছাড়া এই প্ল্যাটফর্মে কেনাকাটা নগদে করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন হয় ডেবিট অথবা ক্রেডিট কার্ডের। তাই ক্রেতা এবং বিক্রেতার অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে, যেখানে ক্রেতা অনলাইনে অর্ডার দেওয়ার সময় তাঁর ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের নম্বর প্রদান করবেন; কিন্তু সেই কার্ড থেকে তাত্ক্ষণিক অর্থ নেওয়া হবে না। অর্ডার দেওয়া পণ্যসামগ্রী ডেলিভারির উদ্দেশ্যে শিপমেন্ট হওয়ার পরই ক্রেতার দেওয়া ডেবিট অথবা ক্রেডিট কার্ড চার্জ করে পণ্যের মূল্য আদায় করা হয়। এখানে অগ্রিম অর্থ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। উন্নত বিশ্বের ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিজেরাই এই পদ্ধতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলে। যে কারণে ব্যাংক বা তৃতীয় কোনো পক্ষের শিপমেন্ট নোটিফিকেশন ভেরিফাই করে পেমেন্ট প্রসেস করার প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের দেশে যেহেতু ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এই পদ্ধতি মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটাতে পারে, তাই তাদের পেমেন্ট প্রসেস করার দায়িত্বটি ব্যাংক বা তৃতীয় কোনো পক্ষের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে, যারা শুধু শিপমেন্ট নোটিফিকেশন পাওয়ার পরই সেই অর্ডারের পেমেন্ট প্রসেস করবে। আর এটা নিশ্চিত করা গেলে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে মূল্য পরিশোধের পরও পণ্যসামগ্রী না পাওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসবে।
ই-কমার্স বা অনলাইন কেনাকাটার সময় ক্রেতা সশরীরে গিয়ে জিনিসপত্র ক্রয় করে না। অনলাইন পোর্টালে দেওয়া ছবি এবং পণ্যের বর্ণনা দেখেই ক্রয় অর্ডার দিতে হয়। সে কারণে ক্রেতা যদি ডেলিভারি পাওয়ার পর সন্তুষ্ট না হয় সে ক্ষেত্রে বিনা বাক্যে এবং খুব সহজে ক্রয় করা পণ্য ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা অনলাইন কেনাকাটা বা ই-কমার্সের অন্যতম পূর্বশর্ত। ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা জনপ্রিয় করে তুলতে হলে প্রতিটা ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে এই সহজ শর্তের রিটার্ন পলিসি মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। এই ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা উন্নত বিশ্বের যেমন জনপ্রিয়, তেমনই সফল। এবং সেসব উন্নত দেশের ধারণা নিয়েই আমাদের দেশে এই ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা চালু করা হয়েছে। তাই উন্নত দেশে যেসব শর্ত এবং মানদণ্ড মেনে এই ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা জনপ্রিয় এবং সফল হয়েছে, সেগুলো আমাদের দেশেও যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে, অন্যথায় ইভ্যালির মতো অঘটন ঘটতেই থাকবে।
দেশে ই-কমার্স যাত্রা শুরু করতে না করতেই ইভ্যালি কেলেঙ্কারি দেশের ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। অথচ ই-কমার্স বা অনলাইন শপিং এখন এক নতুন বাস্তবতা। আমরা স্বীকার করি বা না করি আগামী দশকের ব্যবসা-বাণিজ্য যে যথেষ্টই অনলাইননির্ভর হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি উন্নত বিশ্বের অনলাইন ব্যবসা সর্বোচ্চ পর্যায় পৌঁছে যাওয়ায় বিশ্বের বিশাল বিশাল অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যেমন আমাজন, ওয়ালমার্ট এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছে। ভারতে তো এসব কম্পানি এরই মধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে বসে আছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং জনসংখ্যার কারণে তাদের দৃষ্টি যে আমাদের দেশের দিকেও আছে তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। এ রকম অবস্থায় ইভ্যালি কেলেঙ্কারি আমাদের দেশের ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসার ভবিষ্যতের জন্য মোটেই ভালো খবর নয়। তাই এ ব্যাপারে এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে দেশের ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাকে কঠোর নিয়ম, তদারকি এবং জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে, যাতে আর কোনো ইভ্যালি কেলেঙ্কারির ঘটনা না ঘটে এবং দেশে সুশৃঙ্খল এবং সুনিয়ন্ত্রিত ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্র অবারিত হয়।
লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com
সম্পর্কিত খবর

প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন নিশ্চিত হোক
- জব্বার আল নাঈম

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের থলে থেকে একের পর এক বল ছোড়া হচ্ছে। সাংবিধানিক ব্যবস্থা, পিআর, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস, সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রসার, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, সংবিধান সংশোধনে গণভোটের বিধান, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে নিরপেক্ষ নিয়োগ, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কারের মতো বিষয়গুলো।
গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আলোচিত-ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ এবং রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য। বিষয়গুলো জটিল সমীকরণে ঘুরপাক খাচ্ছে সত্য।
দ্বিতীয়ত, পিআর (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) বাংলায় ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ নির্বাচন শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার পতনের পর ঠিক বর্তমান সময়ের মতোই জামায়াত রাজনীতির ময়দানে চৌকস ভূমিকায় ছিল।
২০২৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো স্বৈরাচার পতন হলে জামায়াত আবারও উজ্জীবিত, কর্মীরা প্রাণবন্ত, দলটির ধারণা সমর্থকও বেড়েছে ব্যাপক হারে। ধারণা আর ভাবনা মিলে আশা করছে, দলটি সরকার গঠন করবে, কোনো কারণে ব্যর্থ হলে পিআর পদ্ধতিতে অনেকগুলো আসন পাবে। এনসিপি, জামায়াতসহ ছোট অন্য দলগুলো এই ফর্মুলায় এগোতে চাইলেও বিএনপি পড়বে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। ৫০ শতাংশ ভোট পেলেও (সর্বোচ্চ অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৪০.৯৭ শতাংশ পেয়েছে) বিনিময়ে আসন পাবে ১৫০টি, যা প্রত্যাশার চেয়ে কম। ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘সংস্কারের অভিনব শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।’
২.
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে অন্তত ১০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি অসম্মতি প্রকাশ করেছে। এই অসম্মতিই ‘গণতন্ত্র’। গণতন্ত্র না থাকলে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রায় অসম্ভব। বিএনপি সবচেয়ে বড় দল, ফলে সাধারণ মানুষের কথা প্রতিনিয়তই মাথায় রেখে যেকোনো সিদ্ধান্তে সম্মতি দিতে হয়। অথচ আলী রীয়াজ আবারও জোর গলায় বলেন, ‘যেসব প্রস্তাবে একমত হওয়া যাচ্ছে না, আমাদের প্রথম লক্ষ্য হবে দলগুলোর অবস্থানগত দূরত্ব কমিয়ে মধ্যবর্তীভাবে জায়গায় এনে হলেও রাজি করানো।’
পিআর বাস্তবায়িত হলে সত্যিকার জনপ্রিয় প্রার্থীদের সামনে আসাটা কঠিন। দলের মধ্যে তেলবাজদের প্রভাব বাড়বে, অবৈধ লেনদেন বাড়বে। এতে যোগ্যরা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সেবা প্রদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রসঙ্গ সামনে টানেন, ‘এখন ঐকমত্য যেগুলোতে হয়েছে সেগুলো করে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে দেন। আর যেগুলোতে ঐকমত্য হবে না সেগুলো বাংলাদেশের জনগণের বাইরে আর কারো করার ক্ষমতা নেই, আমাদেরও ক্ষমতা নেই।’ অর্থাৎ কমিশন তার কথার গুরুত্ব হারাচ্ছে। সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হচ্ছে, অদৃশ্য শত্রু ও শক্তির প্রভাব বাংলাদেশে বাড়ছে, বাড়ছে আতঙ্কও। এরই মধ্য দিয়ে ২০২৬ সালের নির্বাচনেও কালক্ষেপণ শুরু হয়েছে।
পিআর অবশ্যই ভালো ও গ্রহণযোগ্য একটি সংযোজন হতো, যদি উন্নত দেশের মতো মানুষ শতভাগ শিক্ষিত ও সচেতন হতো। এই পদ্ধতিতে একজন ইউপি মেম্বারের সমান যোগ্য ব্যক্তিও সাংসদ হতে পারে। সাংসদ হতে পারবে বিত্তবান সিরিয়াস কিলার, ডাকাত, ভূমিদস্যু কিংবা কালো টাকার মালিকরা। প্রথম স্বৈরাচার পতনের পর তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে। তখন ভোটের আনুপাতিক হারের দিকে খেয়াল করলে সামনের পিআরে আওয়ামী লীগও ৬০ থেকে ৮০ আসন সন্দেহাতীতভাবে পাবে। অতএব নির্বাচনের ফলাফল ও ভোটের অনুপাত হিসাব করলে অনুমেয় যে এনসিপি, জামায়াত ও সঙ্গীরা রাজনীতির হাতি, ঘোড়া, কিস্তি বুঝতে পারছে না।
তাই সরকারের উচিত প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন নিশ্চিত করা। সাংবিধানিক কাউন্সিল বিষয়ে আরো ভাবনা সংযোজনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের ওপর দিন ও দিবসবিষয়ক ছুরি চালানো বন্ধ করা।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
jabbaralnayeem@gmail.com

মব কালচার উচ্ছেদে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন
- মেজর জিল্লুর রহমান অব.

কিছুদিন ধরে খবরের শিরোনামে মব সন্ত্রাস থাকছেই। আজ ঢাকায় করছে তো কাল অন্য কোনো জেলায় বা প্রত্যন্ত এলাকায়। উঠতি বয়সের ছেলেরা থানা পর্যন্ত আক্রমণের দুঃসাহস দেখাচ্ছে। যারা আইন প্রয়োগ করবে তাদের যদি দুষ্কৃতকারীরা সমীহ না করে ভীত না হয় সে সমাজে আইনের শাসন থাকে না।
মব সন্ত্রাসে আক্রান্ত ব্যক্তিটি আদৌ অপরাধী কি না সেটা তদন্ত করে না দেখে, আদালতে বিচার হওয়ার আগেই তাকে মারধর, অপমান, অপদস্থ তো বটেই, খুন পর্যন্ত করা হচ্ছে। দেশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বদরবারে। মব সন্ত্রাসের সময় উত্সুক লোকের ভিড় থেকে ভিডিও করা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে নিজের প্রোফাইল বা পেজের প্রসার ঘটাচ্ছে; অথচ অপরাধ প্রতিহতের চেষ্টা কেউ করছে না। এ ধরনের ঘটনায় নাগরিকদের আওয়াজ তোলা উচিত।
ছোটবেলায় দেখেছি পাড়া-প্রতিবেশী, মহল্লার সবাই মিলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেত, আর অপরাধী সামাজিক ঐক্য দেখে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেত। সেই সামাজিক ঐক্য এখন বড় বেশি সংকুচিত হয়ে গেছে! আমরা কি অল্প সময়ের ব্যবধানেই ভীরু হয়ে গেলাম! আমরা কেন অন্যায়ের কাছে হেরে যাব? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, খানিকটা মানসিক অসুস্থ লোকদেরও ছাড় দেওয়া হয় না। নানা ধরনের অপরাধ, চুরি, ছিনতাই ইত্যাদি অভিযোগে তাদেরও মারধর করা হয়। এসব কি একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে উঠেছে।
ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে ,ব্যক্তিগত শত্রুতার নামে এ ধরনের অভিযোগ তৈরি করে মানুষের ওপরে অত্যাচার এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। স্বাধীনতার পরপরও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে । কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে আজকের দিনের এই মব সন্ত্রাসের ঘটনা। আগের দিনে এসব ঘটনা ঠেকাতে মানুষ ছুটে আসত। শঙ্কার বিষয় এখন কেউ ঢাল হয়ে দাঁড়ায় না।
আমরা তো এই সমাজমাধ্যমেই নানা ধরনের সমাজমনস্কতার ভিডিও দেখি, সেখানে কেউ বিপদে পড়লে বিপদগ্রস্তকে বাঁচাতে মানুষ নিজের জীবনেরও ঝুঁকি নেয়। নিজে না পারলে পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য নেয়। সেই দেখাটা কি দেখাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে? সব দোষ পুলিশের ওপর চাপিয়ে, প্রশাসনের ওপর চাপিয়ে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি পাওয়ার মানসিকতা অনেকের মধ্যে দেখা যায়, যা কাম্য নয়।
প্রশ্ন হলো নাগরিক সমাজের কি কোনো দায় নেই? নাগরিক সমাজ কেন প্রতিরোধে এগিয়ে আসে না? কোনো ক্ষেত্রে নিজের ওপর ঝুঁকি আসতে পারে। কিন্তু পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষ বাহিনীকে খবরটা পৌঁছে দেওয়া যায় না কি? পুলিশ বিচার করুক অভিযোগের দিকগুলো। তারপর পুলিশ নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে অভিযুক্তকে বিচারে সোপর্দ করুক।
একজন নাগরিক, হলোই বা সে পতিত দলের সমর্থক বা কর্মী । তবু তার প্রতি কি এতটুকু ভালোবাসা, সহানুভূতি আরেকজন নাগরিকের থাকতে পারে না? দায় কি সবটাই শুধু প্রশাসনের? দায়িত্ব সবটাই শুধু পুলিশের? আমাদের সমাজের অংশ হিসেবে, সমাজের কল্যাণে, শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থেও তো চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিবাদী হয়ে জনমত গড়ে তুলতে হবে। নিজের বিবেক জাগ্রত রাখতে হবে।
আসুন, আমরা প্রতিজ্ঞা করি, আর একজন মানুষকেও আমরা এভাবে এমন নিষ্ঠুরতার শিকার হতে দেব না, খুন হতে দেব না। সেই মানুষটি যে দলের বা যে মতেরই হোক না কেন? দেশকে মবের মুল্লুক বানাতে দিতে পারি না। আমাদের পুলিশ প্রশাসনের পাশে দাঁড়াতে হবে। গড়তে হবে সভ্য দেশ ।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
zillu65@hotmail.com

গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কি আদৌ সম্ভব
- ড. ফরিদুল আলম

ডোনাল্ড ট্রাম্প এক ধরনের মেকি শান্তি প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সারা বিশ্বকে তিনি বোঝাতে চাইছেন যে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি কতটা আন্তরিক। একদিকে মানুষের লাশের সারি, বাদ নেই কেউ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ, এমনকি ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর মানুষগুলো যখন ত্রাণের জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে, ইসরায়েলের বর্বরতার নির্মম বলি হচ্ছে তারাও। আর এখানেই যেন থমকে গেছে বিশ্বমানবতা আর আন্তর্জাতিক আইন! মানুষের মৃত্যু নিয়ে এত তামাশা কি কেউ দেখেছে এর আগে! গত দুই সপ্তাহে আট শতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে শুধু ত্রাণ আনতে গিয়ে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউসে গেলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সবার ধারণা ছিল, কিছুদিন ধরে কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যে যুদ্ধবিরতির আলোচনা চলছে, তার সফল বাস্তবায়ন হবে, গণহত্যা থেমে যাবে।
এখানে ট্রাম্পের ভূমিকা অনেকের কাছেই হাস্যকর মনে হবে। তিনি যতই নিজেকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক বলে প্রমাণ করতে চান না কেন, এটা কারো বুঝতে বাকি নেই যে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে ইসরায়েলের কথাই শেষ কথা। তিনি কি এ কথা বুঝতে পারছেন না যে ইসরায়েল কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে যাচ্ছে? এইতো কদিন আগে নেতানিয়াহু হোয়াইট হাউসে এসেছিলেন। ট্রাম্প ভেবেছিলেন যে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে সম্মত এবং এই সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে তিনি নেতানিয়াহুর কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে শুধু একটি ঘোষণা দেবেন।
গাজা নিয়ে ইসরায়েল আসলে কি ভাবছে, একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার আগে এই বিষয়টা জেনে নেওয়া খুব জরুরি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এই যুদ্ধের শুরু থেকেই যে কথাগুলো বলে যাচ্ছেন, সেগুলো যদি তিনি সত্যিই মন থেকে বলে থাকেন, তাহলে হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় না। তিনি ইসরায়েলের নিরাপত্তার স্বার্থে হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল করাকেই সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন। গত জানুয়ারিতে যখন ছয় সপ্তাহের জন্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তখনো অনেকেই ভেবেছিলেন এর মধ্য দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি অর্জন করা সম্ভব। হামাস যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করেছে, এমন কোনো অভিযোগ কোনো পর্যায় থেকে না উঠলেও ইসরায়েল একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে। গাজায় হামলা করে বসে। বিষয়টা এমন যে আন্তর্জাতিক প্রবল চাপের কাছে সাময়িক নতি স্বীকার করে যুদ্ধবিরতিতে গিয়ে পরবর্তীতে আবারও নিজেদের নিরাপত্তার ইস্যুকে সামনে এনে যুদ্ধ শুরু করে গাজা খালি করার বিষয়ে তার পরিকল্পনা পেশ করেন। আর এটা পেশ করতে না করতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন একধাপ এগিয়ে তাঁর ব্যাবসায়িক চরিত্রের প্রকাশ ঘটালেন গাজাকে মধ্যপ্রাচ্যের ‘রিভেরা’ (বিলাসবহুল পর্যটনকেন্দ্র) বানাতে তাঁর পরিকল্পনার কথা বলে। সুতরাং যদি একটি যুদ্ধবিরতি হয়ও, তা হবে সাময়িক, অন্তত নিকট অতীতের ঘটনাগুলো এবং ইসরেয়েলের উদ্দেশ্যগুলো সেটাই বলছে।
এখানে আরেকটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে, আর তা হচ্ছে ইসরায়েল যে যুক্তিতে এই যুদ্ধকে চালিয়ে নিচ্ছে তা কি আসলেই ইসরায়েলের নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে এই যুদ্ধে নেতানিয়াহুর যতটা ব্যক্তিগত ইচ্ছা, সেটা কিন্তু ইসরায়েলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটায় না। এই যুদ্ধের শুরু থেকেই আমরা দেশটির অভ্যন্তরে যুদ্ধবিরোধী যে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখছি, এসব দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায় ডানপন্থী একটি জোট সরকারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নেতানিয়াহুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। আর নেতানিয়াহুও নিজের প্রধানমন্ত্রিত্ব টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর সখ্যকে কাজে লাগাচ্ছেন। যুদ্ধবিরতির আলোচনায় হামাসের পক্ষ থেকে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারের দাবির বিপরীতে যুক্ত হয়েছে ইসরায়েলের নতুন মানচিত্র, যেখানে গাজার অধিকাংশ এলাকাকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে দেখিয়ে নিরাপত্তার অজুহাতে সেখানে আরো অধিকসংখ্যক সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে, যা যুদ্ধবিরতিকে কার্যকরের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে নতুন একটি বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এ মাসের ২৭ জুলাই থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটের অধিবেশন রয়েছে, যেখানে যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকারের জোট সঙ্গীদের দিক থেকে প্রবল বাধার মুখে ফেলবে। এ ধরনের চুক্তি যদি নেতানিয়াহু করার পরিকল্পনা করেন, তাহলে স্পষ্টতই সরকারের ওপর থেকে শরিকদের সমর্থন প্রত্যাহারের সম্ভাবনা রয়েছে, যা নেতানিয়াহুর পতন ডেকে আনবে। সুতরাং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই অধিবেশন চলাকালে অন্তত এই যুদ্ধবিরতি কার্যকরের কোনো ইচ্ছা ইসরায়েল সরকারের দিক থেকে দেখানোর সম্ভাবনা নেই। আর এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের ভেতর থেকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের গাজা গণহত্যার চলমান বিষয়টি আরো গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতি চুক্তি কি সম্ভব? সেটি সম্ভব, তবে এর জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে ইসরায়েলের ভেতর সরকার পরিবর্তন। যদি আন্তর্জাতিক চাপ, বিশেষ করে যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রবল হয়, তাহলে নেতানিয়াহু একটি চুক্তি করতে বাধ্য হবেন, সে ক্ষেত্রেও শরিকদের সমর্থন প্রত্যাহারজনিত কারণে তাঁর সরকারের পতন ঘটবে এবং পরবর্তীতে সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদি নতুন কোনো সরকার দায়িত্ব নেয়, তবে এটির ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকতে পারে। তবে যে যুক্তিতে নেতানিয়াহু এই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন এবং এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রও কোনো চাপ দেবে বলে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে একটা সম্ভাবনার জন্যই অপেক্ষা করতে হবে, আর তা হচ্ছে ইসরায়েলের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন, যেখানে নেতানিয়াহুবিরোধী ব্যাপক একটা জনমত দেখা দিতে পারে। তবে পরিস্থিতিকে তিনি এতটাই জটিল করে তুলেছেন যে ভবিষ্যতে যুদ্ধবিরতি হলেও থেমে থেমে সংঘাত চলতেই থাকবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mfulka@yahoo.com

ক্রীড়াঙ্গনে কতটুকু প্রাপ্তি চেতনে ও অবচেতনে
- ইকরামউজ্জমান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে কতটুকু প্রাপ্তি চেতনে ও অবচেতনে? গত এক বছরের সংস্কার একটি বহুল শ্রুত শব্দে পরিণত হয়েছে। মানুষ এই রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কিভাবে দেখতে চেয়েছে। চব্বিশের মূল দর্শন ক্রীড়াঙ্গনের ক্ষেত্রে হলো নারী-পুরুষে বৈষম্যের অবসান, গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে সংগঠকদের মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার। আর এটি অগ্রাধিকার নির্ণয় করে; কেননা সংস্কার তো একটি চলমান বিষয়, এটি ছাড়া তো ক্রীড়াঙ্গন অচল ও অকার্যকর হতে বাধ্য।
মানুষ তো কেবল তার স্বপ্নের সমান। সে আশা করে, অপেক্ষা করে। বাস্তবতার জমিনে দাঁড়িয়ে যদি আমরা সঠিকভাবে ক্রীড়াঙ্গনকে আত্মস্থ করতে পারতাম, তাহলে আগামী দিনে আমরা অনেক বেশি স্বপ্ন দেখতে পারতাম। তবে ক্রীড়াঙ্গনে একটি ঝাঁকুনি দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠকরা যদি খেলাকে ভালোবেসে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে সবাই মিলে লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে বিভিন্ন খেলা দারুণভাবে ‘সাফার’ করবে। ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে কাজ করানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান তো নেই।
বর্তমানে পুরো দেশে সার্বিক ক্রীড়াঙ্গনের অবস্থা মোটেই ক্রীড়াবান্ধব নয়। অপ্রিয় শোনালেও এটাই বাস্তবতা। ব্যক্তিস্বার্থ থেকে ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থকে বড় করে দেখতে না পারলে ক্রীড়াঙ্গনে পরিবর্তনের সুফল পাওয়া যাবে না। জোড়াতালি আর ধামাচাপা দিয়ে ক্রীড়াঙ্গন চলবে না। এ ক্ষেত্রে মৌলিক বিষয়গুলো আমলে রাখতেই হবে। ক্রীড়াচেতনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্রীড়াঙ্গনে আস্থা ও বিশ্বাসের বিকল্প নেই। মানুষ এখন ক্রীড়াঙ্গনকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করেছে। তারা ক্রীড়াঙ্গনের মধ্যে দেশকে দেখতে চায়। দেখতে চায় জাতিচরিত্রের প্রতিফলন। ক্রীড়াঙ্গনের সবকিছু স্পষ্ট হওয়া উচিত। আমরা অনেক বেশি আশা করেছি—ভাবা হয়েছে, আমরা একবারে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলব। এটি কিন্তু সম্ভব নয়। সমস্যার পরিধি তো ব্যাপক। সবাই লক্ষণ নিয়ে ভাবছেন, মূলের দিকে তাকাচ্ছেন না। ক্রীড়াঙ্গন বোঝাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ক্রীড়াঙ্গনে যেমন অতীতকে আঁকড়ে ধরে রাখার সুযোগ নেই, তেমনি সুযোগ নেই অতীতকে অস্বীকার করার। খেলার চর্চা একটি লম্বা সফর। এই সফরে আছে টিমের নিরলস চেষ্টা। আছে সফলতা, ব্যর্থতা আর সীমাবদ্ধতা। খেলার চর্চাকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে, এটি দরকারি বিষয়। প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন এবং সাফল্যের স্বাদ পেতে পারেন, যদি তিনি যা করছেন তার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ও সত্যিকারের আন্তরিক হন।
একসময়ের ‘ঢাকা স্টেডিয়াম’-এর নাম বদল করে ১৯৯৬ সালে নতুন নামকরণ হয়েছে। এরপর আবার চলতি বছর (২০২৫) সেই স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়েছে ‘জাতীয় স্টেডিয়াম’। এটি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে এই স্টেডিয়াম সুস্থভাবে ক্রীড়াচর্চার মাধ্যমে প্রাণচঞ্চল হচ্ছে কি না এটি গুরুত্বপূর্ণ। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো স্টেডিয়ামের সঠিক ব্যবহার, এর রক্ষণাবেক্ষণ। ‘মেইন সাবজেক্ট’ থেকে ‘ঐচ্ছিক সাবজেক্ট’ তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবেগের প্রয়োজন আছে, কিন্তু শুধু আবেগ দিয়ে ক্রীড়াঙ্গন চলে না।
ক্রীড়াঙ্গনকে ঘিরে শূন্যে বুলি আর আশ্বাসের বাণী শোনানোর দিন এখন আর নেই। সচেতনতা বেড়েছে। বেড়েছে সাদা-কালো বোঝার ক্ষমতা। এরই মধ্যে অনেক বেলা হয়ে গেছে। মানুষ এখন দেখতে চায় কল্যাণমুখী ক্রীড়াঙ্গন। দেখতে চায় ন্যায়ভিত্তিক সমতার ক্রীড়াঙ্গন। দেখতে চায় উপেক্ষা আর অবহেলার অবসান। ক্রীড়াঙ্গনে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের খেলা বন্ধ হওয়া দরকার। দরকার সুবিধাভোগীদের খপ্পর থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে মুক্ত করা।
ক্রীড়াঙ্গনে সমস্যা হলো নীতিতে সমন্বয়হীনতা ও নেতৃত্বের অভাব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিন্তার জগৎ সেই পুরনো দিকেই থেকে গেছে। জীবন কিংবা খেলাধুলা তো রূপকথার গল্পের মতো নয়। অনেক সময় কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যেতে হবে। মেনে নিতে হবে। একে অপরকে দোষারোপ করে, একে অপরকে হিংসা করে বিরুদ্ধাচরণ ও অভিযোগ উত্থাপন করে তো সমস্যার সমাধান হয় না। প্রয়োজন যে খেলাই হোক না কেন, সেই খেলার স্বার্থে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ ও ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে কাজ করা।
আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে হওয়া উচিত একটি উদ্দেশ্য নিয়ে টেকসই মডেল, যা কাঠামোগত সমস্যার সমাধান করে এবং সবার জন্য ক্রীড়াঙ্গন নিশ্চিত করবে। পদে পদে ক্রীড়াঙ্গনে সব সময় বড় বেশি অজুহাত। ক্রীড়াঙ্গনের ভালো চাইলে, ক্রীড়াঙ্গনকে যুগোপযোগী করতে হলে প্রয়োজন জিরো অজুহাত নীতিতে কাজ করা। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে উদ্ভাবনী শক্তিটা সত্যি দুর্বল। একটি ধারণা আরেকটি ধারণার জন্ম দেয়। উদ্দেশ্য নিয়ে যখন উদ্ভাবন হয়, তখন তাতে আসে স্থায়ী পরিবর্তন। ক্রীড়াঙ্গনে সাময়িক আত্মতৃপ্তি বলতে কিছু নেই।
খেলাধুলায় নেতৃত্ব বিকাশে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা আছে। সার্চ কমিটি কাজ করতে গিয়ে সেটি লক্ষ করেছে। তবে সমস্যার সমাধানে তারা আশাব্যঞ্জক কাজ করতে পেরেছে, এটি বলার সুযোগ নেই। ক্রীড়াঙ্গনে উন্নয়নের সুফল পেতে হলে তৃণমূল থেকে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সেদিকে নজর কম। খেলোয়াড় তো জন্মায় না, সৃষ্টি করতে হয়; আর সেটি একেবারে এন্ট্রি লেভেল থেকে। এই যে আমাদের নারী ফুটবলাররা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে দেশের মানুষকে গর্বিত করেছেন, পাশাপাশি ফুটবলে নতুন সম্ভাবনার বড় দরজা খুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন, এর পেছনে আছে একটি ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন মেয়েরা। কিভাবে ফুটবলে তৃণমূল থেকে ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন। দেশজুড়ে প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ের ফুটবল মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গনে এনেছে।
ক্রীড়াঙ্গনে দায় স্বীকার করে নেওয়ার সংস্কৃতির প্রয়োজন। ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিদিনের আলোচনা ও গল্পে স্বস্তি বিরাজ করুক। ক্রীড়াঙ্গনে বাস্তবতার পৃষ্ঠপোষকতা হোক। ক্রীড়াঙ্গন ঘিরে দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার জগৎ বড় হোক।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।