ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫
১ শ্রাবণ ১৪৩২, ২১ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫
১ শ্রাবণ ১৪৩২, ২১ মহররম ১৪৪৭

মনোযোগ দরকার পিছিয়ে পড়া মানুষ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে

  • ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
মনোযোগ দরকার পিছিয়ে পড়া মানুষ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে

সম্প্রতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটির বেশি টাকার বাজেট পেশ করা হয়েছে। এটাকে এক অর্থে বিশাল বাজেট বলব না। বাজেটে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বড় ঘাটতি রয়েছে, যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। এই ঘাটতি কোনো সমস্যা নয়; যদি ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থাগুলো ঠিকঠাকভাবে করা হয়।

এবারের বাজেটের ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষণ দেখা গেছে। বিশ্লেষকরা কেউ কেউ বাজেটকে খুব আশা-জাগানিয়া, কেউ খুব বাস্তবভিত্তিক বলেছেন। এমনকি অর্থমন্ত্রীও বলছেন, বাজেট ব্যবসা ও জনবান্ধব। আবার অনেক অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ রয়েছেন, যাঁদের কাছে প্রস্তাবিত বাজেটটি গ্রহণযোগ্য নয়।
তাঁদের বক্তব্য হলো, এই বাজেটে জীবন ও জীবিকার সমন্বয় নেই, জনবান্ধব ও দরিদ্রবান্ধব নয়। তাঁদের কারো কারো বক্তব্য, বাজেটে দরিদ্ররা আড়ালে চলে গেছে। দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে আমলে নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ বাজেট সম্পর্কে একেবারে বিপরীতধর্মী বক্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে।
এক ধরনের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে বাজেটের সম্ভাবনার জায়গা বা সমস্যার জায়গাগুলো চিহ্নিত করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। অনেকেই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য অনেক সুপারিশ করেছেন।

অর্থমন্ত্রী এবার ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে কিছুটা অন্তত গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। বাজেটে তাঁর এই প্রচেষ্টা বা পদক্ষেপটা লক্ষণীয়। আবার এটাও মনে রাখা দরকার, বাজেট একটা সরকারের বার্ষিক আর্থিক বিবরণীয়ও বটে।

ফলে রুটিনমাফিক কিছু গতানুতিক হিসাব এখানে থাকবেই। তবে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থাৎ কভিড-১৯ মহামারির কারণে যেভাবে পুরো অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেই বিবেচনায় এবারের বাজেট আরেকটু ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ হওয়া দরকার ছিল।

একটি দেশের জাতীয় বাজেট কিন্তু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বাজেটের মতো নয়। সরকারি বাজেটে সরকারি নীতি, কৌশল ও বাস্তবায়নের বিষয়গুলো থাকতে হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এবারের বাজেটে নীতি, কৌশল ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে খুব বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাজেটে অনেক কথাবার্তা বলা আছে। পূর্ব ইতিহাস ও অর্জন—এসব আছে। কিন্তু একেবারে আসল যে তিনটা জিনিস থাকা দরকার সেদিকে খুব বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ নীতি, কৌশল ও বাস্তবায়ন, তা আরো স্পষ্ট করা দরকার ছিল। এ ছাড়া বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক হওয়া উচিত ছিল। লোকজনের মতামত নিতে গিয়ে সরকার গুটিকয়েক গোষ্ঠীর সঙ্গে বসেছে। কিন্তু ব্যাপকভাবে তেমন আলোচনা হয়নি। যেটুকুই আলোচনা হয়েছে, তার প্রতিফলন বাজেটে দেখা যাচ্ছে না। এমনকি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ভেতরেও সম্ভাব্য বাজেট নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা হতে এখনো শোনা যায়নি।

বাজেটে ইস্যুভিত্তিক গুরুত্ব যেমন দিতে হয়, তেমনি অঞ্চলভিত্তিক চাহিদার গুরুত্বটাও বিবেচনা করা উচিত। ঢাকায় সুউচ্চ টাওয়ারে বসে বাজেট প্রণয়ন করলেই হয়ে যায় না। জনগণ এবং তাদের অঞ্চলভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন চাহিদার প্রতিও মনোযোগ দিতে হয়। এই মুহূর্তে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর যে চাহিদা, দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর চাহিদা ভিন্ন। কোনো অঞ্চলে স্কুল বেশি দরকার, কোথাও কর্মসংস্থান বেশি দরকার, শিল্পায়ন বেশি দরকার, কোনো এলাকায় স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট—এ ধরনের অঞ্চলভিত্তিক চাহিদার প্রতিফলনগুলো বাজেটে অতীতে দেখা যায়নি, এবারও দেখা গেল না। দুঃখজনক বিষয় হলো, বাজেট প্রস্তাবের পর আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে যে পরিমাণ পরিমার্জন বা সংশোধন আনা দরকার, সেটাও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয় না। তাই আমি মনে করি, বাজেট প্রণয়ন, বাজেট পেশ ও চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়াগুলোতে অনেক দুর্বলতা আছে। বাংলাদেশের মতো দেশে এটা হওয়া ঠিক নয়।

জাতীয় বাজেট সমতাভিত্তিক হতে হয়, জনবান্ধব হতে হয়, বিদ্যমান উন্নয়ননীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হয়। বাজেট অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নেরও একটা হাতিয়ার। এই আঙ্গিকে বিচার করলে এবারের বাজেট সমতাভিত্তিক হয়েছে কি না, অর্থনৈতিক ঝুঁকি দূর করা বা স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য কিছু করা হয়েছে কি না তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে।

বাজেটকে জাতীয় অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে বিবেচনা করলে এটা মনে রাখতে হবে, এক বছরেই সব কিছু সম্ভব নয়। বাজেটে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন থাকবে, ভিশন-২০৪১, ডেল্টা পরিকল্পনা—এসব পরিকল্পনার প্রতিফলন বাজেটে থাকতে হয়। সংকলিত গ্রন্থে যেমন একটি প্রবন্ধের সঙ্গে আরেকটা প্রবন্ধের গভীর যোগসূত্র থাকতে হবে—বাজেটে এমনটা হলে চলে না। এক বছরে যেহেতু সব কিছু করা যায় না, তাই মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোর প্রতিফলন বাজেটে থাকতে হয়। এ জন্য বাজেটের নীতি ও কৌশলগুলো তথ্য-উপাত্তভিত্তিক ও বিশ্লেষণভিত্তিক হতে হবে। এবারের বাজেটে চলমান বিশেষ পরিস্থিতির তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে করা একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল, যেটা পূর্ণাঙ্গভাবে করা হয়নি।

আরেকটি বিষয় এবারের বাজেটে নেই। খাতওয়ারি যে বরাদ্দগুলো দেওয়া হয়েছে সেটা দক্ষতা ও পারফরম্যান্সভিত্তিক হয়েছে সেটাও বলার সুযোগ নেই। যেমন স্বাস্থ্য খাতের বিষয়টি দেখুন। এখানে ৩২ হাজার কোটি টাকার মতো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ বিদায়ি অর্থবছরেও স্বাস্থ্য খাত তার বরাদ্দের অর্থ পুরোপুরি খরচ করতে পারেনি। এবারও ১০০ কোটি টাকা স্বাস্থ্য গবেষণার জন্য দেওয়া হয়েছে। বিদায়ি অর্থবছরেও তারা এই টাকা খরচ করতে পারেনি। শিক্ষা ও কৃষিতেও একই উদাহরণ দেওয়া যায়। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো দক্ষতা ও সক্ষমতাটা বৃদ্ধি। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সক্ষমতা বলতে আমি সরকারি আমলা ও প্রতিষ্ঠান, আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান, এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতার কথা বলছি। এই সক্ষমতা বাড়াতে হবে। না হলে কিন্তু বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

এবারের বাজেটকে বিচার করা উচিত কভিড-১৯ উত্তরণের ব্যাপারে এতে সুনির্দিষ্টভাবে কী বলা আছে। স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে আছে, ছোট শিল্প ও ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান—এসবের জন্য কী করা হলো সেসব দেখা দরকার। এসব খুবই বাস্তবভিত্তিক ইস্যু এবং এগুলো মানুষকে খুব স্পর্শ করে। স্বাস্থ্য খাতকে কিভাবে উন্নত করব, স্বাস্থ্য খাতকে বিকেন্দ্রীকরণ করে আরো কিভাবে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা যায়—এগুলো নিয়ে দিকনির্দেশনা থাকা দরকার ছিল।

দেশে দুই কোটির বেশি লোক দরিদ্র হয়ে গেছে। সম্প্রতি দেখলাম কিছু ব্যক্তি বলছেন, ‘এই দারিদ্র্যের হার এমনিতেই কমে যাবে, তাদের নিয়ে অত চিন্তা করার কিছু নেই, তারা জানে কিভাবে বেঁচে থাকতে হয়, ওরা নিজেরা খুবই কর্মঠ। অন্তত আরো দুই দশক অপেক্ষা করুন, প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি হলে দারিদ্র্য আস্তে আস্তে চলে যাবে।’ এসব কথা বলে অদ্ভুত সব যুক্তি খাড়া করেন কিছু ব্যক্তি। এটা কী রকম দর্শন? আমি অবাক কয়েকজনের এ রকম যুক্তি দেখে। তাঁরা প্রবৃদ্ধির প্রসঙ্গে বলেন, এখনই প্রবৃদ্ধির সুফল সুষম বণ্টনের সময় আসেনি। অর্থাৎ সেই পুরনো ‘চুইয়ে পড়া তত্ত্ব (ট্রিকেল ডাউন ফর্মুলা)’ নিয়েই তাঁরা থাকতে চান। এই তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, এবারের বাজেট গ্রোথ ওরিয়েন্টেড (প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক) হয়েছে। এতে বড় শিল্পের প্রবৃদ্ধি ঘটবে। মানে সব কিছুই হবে গ্রোথ ওরিয়েন্টেড। অর্থাৎ সুষম বণ্টন বা ইকোয়ালিটি আনার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হলেই হলো, সুষম বণ্টনের সময় এখন না।

এবারের বাজেটে কর্মসংস্থানের জন্য কী করা হলো? কর্মসংস্থানের জন্য বড় শিল্পের দিকেই ঝোঁকটা দেখা গেল। কিন্তু এর ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। এসব শিল্পকে একেবারে শ্রমঘন বলা যাবে না। আমাদের শ্রমনিবিড় শিল্প হলো ছোট শিল্প, কুটির শিল্প, মাঝারি শিল্প বা কৃষি। এগুলোর একটি বড় অংশই হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাত। এ খাত নিয়ে কিছুই বলা হয়নি বাজেটে। ফুটপাতে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে ছোট ছোট ওয়ার্কশপ—এসব অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের ৮০-৮৫ শতাংশ লোক জড়িত। এসব খাতের জন্য বাজেটে কোনো বিশেষ নজর দেওয়া হয়নি। এটা অদ্ভুত ব্যাপার মনে হয়েছে আমার কাছে। কারণ অর্থনীতিতে তাদেরও বিরাট অবদান রয়েছে।

পরিশেষে একটা প্রশ্ন রাখব, অর্থনৈতিক উন্নয়নই কি সব? অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক উন্নয়ন, মানবিক উন্নয়ন, সুশাসন, স্বাধীনতা—এসব ব্যাপারেও যথেষ্ট প্রয়াস দরকার। এগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ ক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণ, তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ ও উদ্যোগের ক্ষেত্রে এটা উপলব্ধি করতে হবে। আমরা একই সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছি কি না সেটা প্রশ্ন। কভিড যখন চূড়ায় ওঠে, তখন ‘ট্রাইয়েজ ফর্মুলা’র কথা বেশ বলা হয়েছিল—যাতে খুব সিরিয়াস রোগীদের বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসা দেওয়া যায়। এই ফর্মুলা ধার করে আমরা যদি পিছিয়ে পড়া মানুষ, ব্যবসা-বাণিজ্য মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখি, তাহলে ভালো কিছু পাব না। আর শেষ কথা হলো, বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও আমলাদের কর্মদক্ষতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি করতে হবে। জীবন ও জীবিকার সমন্বয়কে আরো সুসংহত করতে হবে। এ জন্য জনবান্ধব ও সমতাভিত্তিক বাজেট উন্নয়নের শর্ত।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

অনুলিখন : আফছার আহমেদ

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ক্রীড়াঙ্গনে কতটুকু প্রাপ্তি চেতনে ও অবচেতনে

    ইকরামউজ্জমান
শেয়ার
ক্রীড়াঙ্গনে কতটুকু প্রাপ্তি চেতনে ও অবচেতনে

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে কতটুকু প্রাপ্তি চেতনে ও অবচেতনে? গত এক বছরের সংস্কার একটি বহুল শ্রুত শব্দে পরিণত হয়েছে। মানুষ এই রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কিভাবে দেখতে চেয়েছে। চব্বিশের মূল দর্শন ক্রীড়াঙ্গনের ক্ষেত্রে হলো নারী-পুরুষে বৈষম্যের অবসান, গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে সংগঠকদের মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার। আর এটি অগ্রাধিকার নির্ণয় করে; কেননা সংস্কার তো একটি চলমান বিষয়, এটি ছাড়া তো ক্রীড়াঙ্গন অচল ও অকার্যকর হতে বাধ্য।

ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থান সুযোগ করে দিয়েছে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও স্বেচ্ছাচারিতা ও দমনমূলক ঐতিহ্য ভাঙার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্রেফ একটি রেজিম চেঞ্জ নয়; এর দর্শন অন্য রকম। এর চেতনার পরিধি অনেক বড়। আমরা বারবার বলেছি, ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিবেকের সংস্কার।

মানুষ তো কেবল তার স্বপ্নের সমান। সে আশা করে, অপেক্ষা করে। বাস্তবতার জমিনে দাঁড়িয়ে যদি আমরা সঠিকভাবে ক্রীড়াঙ্গনকে আত্মস্থ করতে পারতাম, তাহলে আগামী দিনে আমরা অনেক বেশি স্বপ্ন দেখতে পারতাম। তবে ক্রীড়াঙ্গনে একটি ঝাঁকুনি দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

ট্র্যাডিশনের বিপক্ষে দাঁড়ানো হয়েছে, এটি কম বিষয় নয়। ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাডহক বডি গঠন করা হয়েছে। ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা আগের তুলনায় কমানো হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছেযাঁদের নিয়ে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাডহক বডি গঠন করা হয়েছে, তাঁরা আসলে কারা? কী তাঁদের ব্যাকগ্রাউন্ড? তাঁরা কি নিজ থেকে প্রো-অ্যাকটিভ হওয়ার মতো মানসিকতাসম্পন্ন?

ক্রীড়াঙ্গনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠকরা যদি খেলাকে ভালোবেসে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে সবাই মিলে লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে বিভিন্ন খেলা দারুণভাবে সাফার করবে। ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে কাজ করানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান তো নেই।

সবাই তো প্রবল উৎসাহ নিয়ে, সবকিছু বুঝেশুনেই দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছেন। অ্যাডহক কমিটি হয়েছে। এবার ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্রে সংস্কার সাধনের জন্য নতুন কমিটি করা হয়েছে। কাগজে দেখেছি, এই কমিটিতে স্থান হয়েছে এমন একজন অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে চলে গেছেন। সেখানে বৈধভাবে তাঁর থাকার ব্যবস্থা আছে। আমরা চাচ্ছি ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কারের নামে খেলাধুলা যাতে স্থবির না হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সময়ের জন্য বাধাগ্রস্ত না হয়।

বর্তমানে পুরো দেশে সার্বিক ক্রীড়াঙ্গনের অবস্থা মোটেই ক্রীড়াবান্ধব নয়। অপ্রিয় শোনালেও এটাই বাস্তবতা। ব্যক্তিস্বার্থ থেকে ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থকে বড় করে দেখতে না পারলে ক্রীড়াঙ্গনে পরিবর্তনের সুফল পাওয়া যাবে না। জোড়াতালি আর ধামাচাপা দিয়ে ক্রীড়াঙ্গন চলবে না। এ ক্ষেত্রে মৌলিক বিষয়গুলো আমলে রাখতেই হবে। ক্রীড়াচেতনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্রীড়াঙ্গনে আস্থা ও বিশ্বাসের বিকল্প নেই। মানুষ এখন ক্রীড়াঙ্গনকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করেছে। তারা ক্রীড়াঙ্গনের মধ্যে দেশকে দেখতে চায়। দেখতে চায় জাতিচরিত্রের প্রতিফলন। ক্রীড়াঙ্গনের সবকিছু স্পষ্ট হওয়া উচিত। আমরা অনেক বেশি আশা করেছিভাবা হয়েছে, আমরা একবারে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলব। এটি কিন্তু সম্ভব নয়। সমস্যার পরিধি তো ব্যাপক। সবাই লক্ষণ নিয়ে ভাবছেন, মূলের দিকে তাকাচ্ছেন না। ক্রীড়াঙ্গন বোঝাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ক্রীড়াঙ্গনে যেমন অতীতকে আঁকড়ে ধরে রাখার সুযোগ নেই, তেমনি সুযোগ নেই অতীতকে অস্বীকার করার। খেলার চর্চা একটি লম্বা সফর। এই সফরে আছে টিমের নিরলস চেষ্টা। আছে সফলতা, ব্যর্থতা আর সীমাবদ্ধতা। খেলার চর্চাকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে, এটি দরকারি বিষয়। প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন এবং সাফল্যের স্বাদ পেতে পারেন, যদি তিনি যা করছেন তার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ও সত্যিকারের আন্তরিক হন।

একসময়ের ঢাকা স্টেডিয়াম-এর নাম বদল করে ১৯৯৬ সালে নতুন নামকরণ হয়েছে। এরপর আবার চলতি বছর (২০২৫) সেই স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়েছে জাতীয় স্টেডিয়াম। এটি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে এই স্টেডিয়াম সুস্থভাবে ক্রীড়াচর্চার মাধ্যমে প্রাণচঞ্চল হচ্ছে কি না এটি গুরুত্বপূর্ণ। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো স্টেডিয়ামের সঠিক ব্যবহার, এর রক্ষণাবেক্ষণ। মেইন সাবজেক্ট থেকে ঐচ্ছিক সাবজেক্ট তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবেগের প্রয়োজন আছে, কিন্তু শুধু আবেগ দিয়ে ক্রীড়াঙ্গন চলে না।

ক্রীড়াঙ্গনকে ঘিরে শূন্যে বুলি আর আশ্বাসের বাণী শোনানোর দিন এখন আর নেই। সচেতনতা বেড়েছে। বেড়েছে সাদা-কালো বোঝার ক্ষমতা। এরই মধ্যে অনেক বেলা হয়ে গেছে। মানুষ এখন দেখতে চায় কল্যাণমুখী ক্রীড়াঙ্গন। দেখতে চায় ন্যায়ভিত্তিক সমতার ক্রীড়াঙ্গন। দেখতে চায় উপেক্ষা আর অবহেলার অবসান। ক্রীড়াঙ্গনে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের খেলা বন্ধ হওয়া দরকার। দরকার সুবিধাভোগীদের খপ্পর থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে মুক্ত করা।

ক্রীড়াঙ্গনে সমস্যা হলো নীতিতে সমন্বয়হীনতা ও নেতৃত্বের অভাব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিন্তার জগৎ সেই পুরনো দিকেই থেকে গেছে। জীবন কিংবা খেলাধুলা তো রূপকথার গল্পের মতো নয়। অনেক সময় কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যেতে হবে। মেনে নিতে হবে। একে অপরকে দোষারোপ করে, একে অপরকে হিংসা করে বিরুদ্ধাচরণ ও অভিযোগ উত্থাপন করে তো সমস্যার সমাধান হয় না। প্রয়োজন যে খেলাই হোক না কেন, সেই খেলার স্বার্থে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ ও ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে কাজ করা।

আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে হওয়া উচিত একটি উদ্দেশ্য নিয়ে টেকসই মডেল, যা কাঠামোগত সমস্যার সমাধান করে এবং সবার জন্য ক্রীড়াঙ্গন নিশ্চিত করবে। পদে পদে ক্রীড়াঙ্গনে সব সময় বড় বেশি অজুহাত। ক্রীড়াঙ্গনের ভালো চাইলে, ক্রীড়াঙ্গনকে যুগোপযোগী করতে হলে প্রয়োজন জিরো অজুহাত নীতিতে কাজ করা। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে উদ্ভাবনী শক্তিটা সত্যি দুর্বল। একটি ধারণা আরেকটি ধারণার জন্ম দেয়। উদ্দেশ্য নিয়ে যখন উদ্ভাবন হয়, তখন তাতে আসে স্থায়ী পরিবর্তন। ক্রীড়াঙ্গনে সাময়িক আত্মতৃপ্তি বলতে কিছু নেই।

খেলাধুলায় নেতৃত্ব বিকাশে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা আছে। সার্চ কমিটি কাজ করতে গিয়ে সেটি লক্ষ করেছে। তবে সমস্যার সমাধানে তারা আশাব্যঞ্জক কাজ করতে পেরেছে, এটি বলার সুযোগ নেই। ক্রীড়াঙ্গনে উন্নয়নের সুফল পেতে হলে তৃণমূল থেকে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সেদিকে নজর কম। খেলোয়াড় তো জন্মায় না, সৃষ্টি করতে হয়; আর সেটি একেবারে এন্ট্রি লেভেল থেকে। এই যে আমাদের নারী ফুটবলাররা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে দেশের মানুষকে গর্বিত করেছেন, পাশাপাশি ফুটবলে নতুন সম্ভাবনার বড় দরজা খুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন, এর পেছনে আছে একটি ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন মেয়েরা। কিভাবে ফুটবলে তৃণমূল থেকে ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন। দেশজুড়ে প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ের ফুটবল মেয়েদের ক্রীড়াঙ্গনে এনেছে।

ক্রীড়াঙ্গনে দায় স্বীকার করে নেওয়ার সংস্কৃতির প্রয়োজন। ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিদিনের আলোচনা ও গল্পে স্বস্তি বিরাজ করুক। ক্রীড়াঙ্গনে বাস্তবতার পৃষ্ঠপোষকতা হোক। ক্রীড়াঙ্গন ঘিরে দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার জগৎ বড় হোক।

 

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।

 

মন্তব্য

ভূতত্ত্ব শিক্ষায় আরো গুরুত্ব দিতে হবে

    মো. ইউসুফ গাজী
শেয়ার
ভূতত্ত্ব শিক্ষায় আরো গুরুত্ব দিতে হবে

ভূতত্ত্ব শুধু মাটি, পাহাড় বা পাথরের বিজ্ঞান নয়; এটি আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত একটি বিষয়। কৌশলগত ও প্রযুক্তিনির্ভর বিষয় হিসেবে এটি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও শিল্পায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। অথচ বাংলাদেশে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখনো পরিকল্পনার অভাব ও সীমিত কর্মক্ষেত্রের কারণে সম্ভাবনার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। ভূমিকম্প, ভূমিধস, নদীভাঙন, বন্যা ও ভূগর্ভস্থ পানির সংকটের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঠিক পূর্বাভাস, বিশ্লেষণ ও প্রতিকারের জন্য পর্যাপ্ত ভূতাত্ত্বিক জ্ঞান ও দক্ষতা অপরিহার্য।

দেশের অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য তেল, গ্যাস, খনিজ, জিওথার্মাল শক্তিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ভূতত্ত্ববিদ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।

বর্তমানে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব পড়ানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন নামে ভূতত্ত্ববিষয়ক অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। দুঃখের বিষয়, এত দিন পর্যন্ত দেশের শিক্ষা ও নীতিনির্ধারণে ভূতত্ত্বকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।

এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ভূতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যয়নের আগ্রহ তুলনামূলকভাবে কম লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শুধু গবেষণাভিত্তিক গুরুত্ব তুলে ধরাই যথেষ্ট নয়, কারণ দেশের বাস্তবতায় কর্মসংস্থানই শিক্ষার্থীদের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে হলে একদিকে যেমন ভূতত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষার পরিসর ও মান বাড়াতে হবে, তেমনি অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি খাতে ভূতত্ত্ববিদদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাও জরুরি। অবাক করার বিষয় হলো, ভূমিকম্প, ভূমিধস, নদীভাঙন, ভূগর্ভস্থ পানির সংকট এবং ভূ-প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভূতাত্ত্বিকদের সম্পৃক্ততা খুবই সীমিত।

এ জন্য পেট্রোবাংলা, বাপেক্সসহ অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত তেল ও গ্যাস কম্পানি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে আরো নিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে ভূতত্ত্ববিদদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। বেসরকারি পর্যায়ে জিওটেকনিক্যাল কনসালটেন্সি ফার্ম, খনিজ অনুসন্ধান কম্পানি, নির্মাণ ও পরিবেশ মূল্যায়ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস কম্পানি এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় ভূতত্ত্ববিদদের অন্তর্ভুক্তির জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। 

ভূতত্ত্ব বিষয়টিকে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি  সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হতে পারে। এই বিষয়ে অগ্রগতি আনতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের শীর্ষ কলেজগুলোতে প্রাথমিকভাবে মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।

তবে এই প্রোগ্রামগুলো যেন শুধু প্রথাগত তাত্ত্বিক শিক্ষায় সীমাবদ্ধ না থাকে; বরং পরিবেশ, ভূতত্ত্ব, ভূতথ্য-প্রযুক্তি, দূর অনুধাবন, পানিসম্পদ  ব্যবস্থাপনা, খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো আধুনিক ও প্রযুক্তিভিত্তিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা উঠে এলেও এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। সম্প্রতি সক্রিয় হওয়া বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতি চাইলে নতুন করে উদ্যোগ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে বিষয়টি আবারও উত্থাপন করতে পারে। এর মাধ্যমে দেশের শিক্ষানীতিতে একটি নতুন ধারা তৈরি হবে।

তবে সদ্য ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভূতত্ত্ব বিষয়ে অনাগ্রহের একটি প্রধান কারণ হলো এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক ধারণা না থাকা। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ভূতত্ত্ব বিভাগগুলো সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রতিযোগিতা ও ল্যাবরেটরি পরিদর্শনের আয়োজন করতে পারে। এসব কর্মসূচিতে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিলে তাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হবে এবং বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা বাড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ এরই মধ্যে এ ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছে, যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। ভূতত্ত্বের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমে ভূতত্ত্বের বহুমাত্রিক দিকগুলো সংক্ষিপ্ত হলেও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার্থীরা ভূতত্ত্বকে শুধু মাটি, পাথর বা শিলার বিজ্ঞান হিসেবে না দেখে এর বহুমুখী গুরুত্ব বুঝতে পারে।

বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বাস্তবতা, দুর্যোগপ্রবণতা ও প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষাপটে ভূতত্ত্ব বিষয়ে দক্ষ জনবল গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যথাযথ পরিকল্পনা, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা গেলে ভূতত্ত্বকে আরো কার্যকর, আকর্ষণীয় ও সময়োপযোগী একটি ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান : প্রাপ্তি প্রত্যাশা ও ইতিহাসের দায়

    শায়রুল কবির খান
শেয়ার
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান : প্রাপ্তি প্রত্যাশা ও ইতিহাসের দায়

২০২৪ সালের ১ জুলাই একটি আপাতদৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। কিন্তু কেউ কি জানত, এই সাধারণ দাবিই মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে রূপ নেবে এক রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানে? যার পরিণতিতে বদলে যাবে দেশের ক্ষমতার চিত্রপট, আর দীর্ঘ ১৬ বছরের একক শাসককে বাধ্য করবে দেশ ছেড়ে পালাতে? হ্যাঁ, ১৫ জুলাই থেকে সেই আন্দোলনে নামল গুলি, ছিটল রক্ত, আর ঢাকঢোল ভেঙে উঠল জনতার স্বর : গণতন্ত্র চাই! শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্টে পতন হলো শেখ হাসিনা সরকারেরএক নজিরবিহীন, অনিবার্য পতন।

রক্তাক্ত রাজপথের স্লোগান ও শহীদের আত্মত্যাগ : সেই ৩৬ দিন রাজপথজুড়ে উচ্চারিত হচ্ছিল এমন সব স্লোগান, যা শুধু রাজনীতি নয়, জাতির আত্মাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। রাজপথ যে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল—‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর, আমার খায় আমার পরে, আমার বুকে গুলি করে, তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে, লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছেড়ে দে, চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন, এই ফাল্গুনেই হবে দ্বিগুণ, আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার

জুলাই ও আগস্টের সেই ৩৬ দিন কোনো সাধারণ রাজনৈতিক মোড় ছিল না; এটা ছিল এক যুগান্তকারী গণ-আন্দোলনের বিস্ফোরণ। শহরের অলিগলি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, গ্রামীণ হাট থেকে দেশের প্রশাসনিক ভবন পর্যন্ত প্রতিটি জায়গা রূপ নিয়েছিল সংগ্রামের মঞ্চে। নির্মম সত্য হলো, এই বিপ্লব শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শুরু থেকে প্রতিদিন গণমাধ্যমে শহীদদের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশের হাসপাতাল থেকে বিএনপির উদ্যোগে একটি তালিকা তৈরি করা হয়। পরে অন্তর্বর্তী সরকারও শহীদদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৭ মে পর্যন্ত খসড়া তালিকা অনুযায়ী শহীদের সংখ্যা ৮৩৪। অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ১৫ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভসংশ্লিষ্ট মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ৪০০ জন পর্যন্ত হতে পারে।
এর মধ্যে কতশত মা-বাবা তাঁদের সন্তানের লাশ কোলে-পিঠে করে বাড়ি ফিরেছেন, কত পরিবার আজও শোকে কুঁকড়ে আছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।

শুধু সংখ্যাই নয়, বরং প্রতিটি নামের পেছনে আছে এক করুণ গল্প। এই গণ-আন্দোলনে জাতীয় গণমাধ্যমের অসংখ্য শিরোনাম বিশ্ববাসীকে স্পর্শ করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি শিরোনাম ছিল : যা বাবা, ভালো থাকিস বলে গুলিতে শহীদ সাঈদকে চিরবিদায় মায়ের, মুগ্ধর আন্দোলন তো এখনো শেষ হয়নি, অটোরিকশায় বসে কোলে করে ছেলের লাশ বাসায় আনি, কোটা আন্দোলনে শহীদ ফারহান এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে, আমার ডাক্তার ছেলেকে তারা গুলি করে মারবে কেন?, মেয়ের জন্য চিপস কিনে বাসায় ফিরতে পারলেন না মোবারক হোসেন, যাত্রাবাড়ীতে সংঘর্ষ : রোহান আর মাহাদীর স্বপ্ন থেমে গেল গুলিতে, আমার নিরীহ ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে ওরা। এসব শিরোনাম শুধু সংবাদ নয়, এগুলো একেকটি ফেটে পড়া হৃদয়ের আর্তনাদ।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসনের আকাঙ্ক্ষা : এই অসংখ্য শহীদ, আহত ও ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত লাশের ওপর দাঁড়িয়েই জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অর্জিত হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা একটাইগণতন্ত্র, যার সঙ্গে পুরোপুরিভাবে জড়িত ভোটাধিকার, মানবাধিকার ও সুশাসন। এর কোনো বিকল্প নেই, কোনো যুক্তিও নেই।

এই অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে অনেকেই নানা দাবি করছেন। তবে প্রকৃত সত্য হলো, ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামই এই গণ-অভ্যুত্থানের পথ তৈরি করেছে। ধাপে ধাপে কোটাবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে এটি চূড়ান্ত এক দফায় রূপ নেয়, যা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষণা করেছিলেন। ৩ আগস্ট কারাগারে আটক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সহধর্মিণীকে দেখতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার এই আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সফল হবে, তা কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

শুধু বিএনপি নয়, অনেক বামপন্থী, মধ্যপন্থী দল, পেশাজীবী, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ কৃষক-মেহনতি মানুষসবার এক দাবিতে মিলেছিল কণ্ঠস্বর : শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসান চাই

দমনের চেষ্টা ও জনগণের জাগরণ : ১৮ জুলাই সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিকল হয়ে পড়ায় তথ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার একতরফা ভাষ্য প্রচার করে যায়। সরকারের কথা শুনে মনে হয়েছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সব দাবি পূরণ হয়ে গেছে। ছাত্রদের হৃদয় প্রশান্ত হয়েছে। যেন ক্ষোভ যা চলছে, তা শুধুই বিএনপিসহ বিরোধী গোষ্ঠীর তৎপরতা।

মূলত উচ্চ আদালতের যুক্তিসংগত রায়ের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের কোটা সংস্কার দাবিটি পূরণ হয়েছিল বলা যায়। তবে এই দাবি পূরণের পথ তাদের সহযোদ্ধা ও সহপাঠীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বহু ছাত্রসহ ১৫ দিনে শতাধিক মানুষ জীবন হারিয়েছেন। আরো অনেক বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়েছেন। হাসপাতালে গিয়ে আহত মানুষ পুনরায় আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্রসহ তাদের সমর্থকদের ওপর এই নির্বিচার আক্রমণ করেছে সরকারি দলের অনুগত সংগঠন ও সরকারের বাহিনীগুলো। এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে সরকারি দলের নেতাদের নির্দেশ বা উসকানিতেএমন সাক্ষ্য-প্রমাণ গণমাধ্যমে ছিল।

সরকারি স্থাপনায় নাশকতার জন্য তদন্তের আগেই ঢালাওভাবে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাদের দায়ী করে গ্রেপ্তার করে দাম্ভিকতা দেখানো হয়েছিল। এই দাম্ভিকতা তৈরি হয়েছিল ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি করে সমাবেশ পণ্ড করার মধ্য দিয়ে।

শত শত ছাত্র এবং হাজারো মানুষের রক্তে রঞ্জিত এই আন্দোলন আপামর জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কি না, এতে দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, নিপীড়নে অতিষ্ঠ মানুষের ক্ষোভ যুক্ত হয়েছে কি না, সরকার তা নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ না করে রাজনৈতিক হয়রানি করেছিল।

গণ-অভ্যুত্থানের স্লোগান আর ঘটনাগুলোর শিরোনাম কোনোভাবেই বৃথা হতে দেওয়া যাবে না। এর আকাঙ্ক্ষা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন, যা নাগরিকদের মাঝে আরো শক্তিশালী হচ্ছে। কারো কাছ থেকে এই আকাঙ্ক্ষা বিন্দুমাত্র হারিয়ে যায়নি।

অন্তর্বর্তী সরকার ও ভবিষ্যতের দায় : দেশকে গভীর সংকট থেকে উত্তরণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এখন সংস্কারের পথে হাঁটছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, শহীদদের রক্ত কি সত্যিই বৃথা যাবে না? গণ-অভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষাগণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যেভাবে নিরলস চেষ্টা করে চলছে, জনগণ তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সে জন্য দেশের কল্যাণে সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এই অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতন নয়; এটি একটি ব্যবস্থার পরিবর্তনের সূচনা। কিন্তু প্রকৃত পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন এই রক্তাক্ত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারব। শহীদদের স্বপ্ন ছিল একটি সুন্দর বাংলাদেশ, যেখানে কোনো স্বৈরাচার, কোনো নিপীড়ন থাকবে না। গণ-অভ্যুত্থানের এই অর্জন ধরে রাখতে হলে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। কারণ ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, স্বৈরাচারের ফিরে আসার চেষ্টা কখনোই থামে না। কিন্তু জনগণের জাগরণই পারে তাকে রুখে দিতে।

 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংস্কৃতিকর্মী

মন্তব্য

শহীদের রক্তে ধোয়া রাজপথ

    সাঈদ জুবেরী
শেয়ার
শহীদের রক্তে ধোয়া রাজপথ
শহীদ আবু সাঈদ

বাংলাদেশের রাজপথ রক্ত দিয়ে ধোয়া হয় বারবার। স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জন ও বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা কম নয়, বরং অনেক বেশি রক্তই ঝরেছে এই পোড়া দেশের জমিনে। লক্ষ্য অর্জিত হোক বা না হোক, শহীদের রক্তের দাগ অচিরেই শুকিয়ে যায়। কিন্তু দিবস থেকে যায়।

ছবি থেকে যায়। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক স্মৃতি থেকে যায়।

আমরা যারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চাক্ষুষ করেছি তারা জানি ১৬ জুলাইয়ের আগের আর পরের রূপ আলাদা। দিনটিকে বদলে দিয়েছিলেন একটা নিরীহ তরুণ।

লাঠি হাতে দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের বিপরীতে অনড় দাঁড়িয়ে যাওয়া তরুণ আবু সাঈদ। এই দৃশ্য আমাদের মননে গেঁথে গেছে। লড়াইয়ে সাঈদের মতো প্রাণ দিয়েছেন আরো হাজারো মানুষ। রংপুরে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের নিহত হওয়ার দিনটিকে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই শহীদ দিবস ঘোষণা করেছে।

দুই হাত প্রশস্ত করে বুক পেতে ঘাতকের সামনে দাঁড়ানো আবু সাঈদের দুঃসাহসিক মৃত্যুদৃশ্য ইন্টারনেটের যুগে মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় দুনিয়াব্যাপী। তাঁর মৃত্যুই পুরো আন্দোলনের গতি পাল্টে দেয়। কোটা সংস্কার, বৈষম্যবিরোধী ইত্যাদির আড়াল থেকে জনদাবি নির্দিষ্ট হয়ে যায়স্বৈরাচারের পতন। মানুষের ভয় ভেঙে যায়। মাত্র ২০ দিনের মাথায় দুনিয়ার দীর্ঘতম স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটে।

আবু সাঈদের দুঃসাহসিক মৃত্যুদৃশ্যটি বিশ্বের গণ-আন্দোলনের আইকনিক ছবি হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে তুলনা চলতে পারে ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিশাল এক বিক্ষোভ দমনকালীন একটি ছবি। ওই বিক্ষোভের সময়কার একটি ছবি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রতীকী ছবিগুলোর একটি হয়ে উঠেছিল, যাতে দেখা যাচ্ছিল সেনা ট্যাংকের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছেন একজন আন্দোলনকারী।

যুগে যুগে এই পোড়া দেশে গণ-আন্দোলনে নামতে হয়েছে মানুষকে। আর প্রতিটি আন্দোলনে বদলেছে স্লোগান; কিন্তু দাবি সেই একইগণতান্ত্রিক মুক্তি। স্বাধীনতার আগে গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক ছিলেন শহীদ আসাদ। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক পুরান ঢাকার বনগ্রামের নূর হোসেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের ইতিহাসেই অভূতপূর্ব ও সবচেয়ে শক্তিশালী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান তথা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক রংপুরের আবু সাঈদ।

নিঃসন্দেহে আসাদ, নূর হোসেন আর আবু সাঈদের রাজনৈতিক লড়াই এক ছিল না। কিন্তু তাঁদের আকাঙ্ক্ষার মিল ছিল। আমাদের রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি আসাদ, নূর হোসেনের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। বৈষম্যহীন দিন আসেনি, গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। নূর হোসেনের রক্তের সঙ্গে তাঁর দল আওয়ামী লীগ শুধু প্রতারণাই করেনি, দলটি দেশে কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয় দেড় যুগ। যা থেকে মুক্তি পেতে আবু সাঈদকে দুই বাহু প্রসারিত করে দাঁড়াতে হলো মৃত্যুর মুখে। 

একটু শঙ্কার কথা দিয়ে এই ক্ষুদ্র পরিসরের লেখাটি শেষ করি। জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি এখনো তাজা। তাই হাসিনাশাহির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিমসহ প্রত্যেক শহীদ এখনো আমাদের সবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছেন। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে শহীদদের অবমাননা এবং অস্বীকারের একটা ভয়ংকর চর্চা আমাদের রাজনীতিতে রয়ে গেছে। হোক তা মহান মুক্তিযুদ্ধ কিংবা নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা। সবচেয়ে নিকট অতীত নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের প্রতীক নূর হোসেনের কথাই ধরা যাক। তাঁর আত্মাহুতির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতারণা তো আওয়ামী লীগ করেছেই, উপরন্তু নূর হোসেনের হত্যাকারী জাতীয় পার্টি নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের নায়ককে টোকাই-নেশাখোর বলারও দুঃসাহস দেখিয়েছে। অন্যদিকে একাত্তরের পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতাকামীদের বলত দুষ্কৃতকারী। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের আমরা রক্ষা করতে পারব তো। শেষ করি জুলাই ২৪-এর রক্ষক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সাম্প্রতিক জনপ্রিয় স্লোগান দিয়ে—‘আবু সাঈদ, মুগ্ধ/শেষ হয়নি যুদ্ধ।

লেখক : কবি, সাংবাদিক

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ