বাঙালি ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী, ৫৬ শতাংশ; কিন্তু দেশটির তথাকথিত ধর্মবাদী, সামরিক সামন্তবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর কাছে বিষয়টি কখনোই গুরুত্ব লাভ করেনি। ব্রিটিশ ভারতের উপনিবেশমুক্তির পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়া থেকেই সে কারণে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হতে থাকে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালি হয়ে ওঠে পাকিস্তনের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। যে বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তারাই হয়ে ওঠে নতুন উপনিবেশের মানুষ, যারা তাদের সম্মান-সম্পদ লুণ্ঠিত হতে দেখে, বাংলা ভাষার হরণচেষ্টা দেখে, লুণ্ঠন হতে দেখে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি।
মত ও মন্তব্য
বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে সুচিন্তিত প্রাথমিক যাত্রা
হারুন হাবীব

এই প্রেক্ষাপটেই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় এবং সামান্য সময়ের ব্যবধানে উত্থান ঘটে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের, যে উত্থান ইতিহাসের আশীর্বাদ হয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেনতার স্ফুরণ ঘটায়। এই প্রেক্ষাপটেই লড়াকু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন সাহসী নেতৃত্ব সামনে এগিয়ে আসে, নতুন কর্মপরিকল্পনায় দলটি জাতীয় মঞ্চের শক্তিশালী দলে পরিণত হয়। তরুণ শেখ মুজিব নির্বাচিত হন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ সভাপতি।
পাকিস্তানের ধর্ম ও সামরিক আধিপত্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়ে এদিকে ধারাবাহিকভাবে নির্যাতিত হতে থাকেন শেখ মুজিব।
প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের ছয় দফা প্রস্তাবটি ছিল পাকিস্তানি রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট বা মোড় ঘোরানো পদক্ষেপ। এর দফাগুলোতে সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের, যেখানে পাকিস্তানকে ফেডারেল রাষ্ট্র করার কথা বলা আছে। কিন্তু পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রে সেই প্রস্তাব উপেক্ষিত হয়েছে।
নতুন প্রজন্মের মানুষের জন্য পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর্যায়ক্রমিক ইতিহাসের পঠন জরুরি। জরুরি সবিশেষ গুরুত্ব বহন করায় ৭ জুনের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের স্মরণ।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ডাকা হয় পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোর একটি সর্বদলীয় বৈঠক। বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছয় দফা পেশ করতে চাইলে খোদ বিরোধী দলগুলো থেকেই বিরোধিতার সম্মুখীন হন; কিন্তু শেখ মুজিব দমে যান না। সম্মেলন থেকে বেরিয়ে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি তাঁর প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর অস্তিত্ববিনাশী তত্ত্বটি তিনি সেদিনকার পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতেই প্রথম তুলে ধরেছিলেন, যা ছিল বিস্ময়কর এই রাজনীতিপুরুষের অসম সাহসী পদক্ষেপ।
শেখ মুজিব, পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের জাতির জনক; একদিকে ছিলেন দূরদর্শী, অন্যদিকে দুঃসাহসী জননেতা, যিনি বাঙালির মরমি ও বিপ্লবী ধারার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তিনি হেরে যাওয়ার মানুষ ছিলেন না। অতএব সুদূরপ্রসারী লড়াই পরিকল্পনায় নামতে হয়েছে তাঁকে। ছয় দফা পেশের মাত্র এক মাসের মাথায় ১ মার্চ ১৯৬৬ তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সাধারণ সম্পাদক হন তাঁরই যোগ্য অনুসারী তাজউদ্দীন আহমদ। স্বৈরতান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোকে আঘাত করার লক্ষ্যে এরপর ছয় দফার প্রচারে নামেন তিনি। এই প্রচারাভিযানে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বারবার। নানা মিথ্যা মামলায়, এমনকি পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁকে। ৭ জুন শেখ মুজিব ও অন্যান্য সহকর্মীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। ট্রেন থামানো হয়, যানবাহন বন্ধ থাকে। গণমানুষের সম্পৃক্ততা ঘটে অভাবিত। এই হরতাল চলাকালে পুলিশ ও ইপিআর গুলি চালায় টঙ্গী, তেজগাঁও, সদরঘাট ও নারায়ণগঞ্জে। শহীদ হন মনু মিয়া, সফিক, শামসুল হকসহ ১০ জন।
কিন্তু ছয় দফার আন্দোলনকে রোখা যায়নি। কারণ শেখ মুজিব ছিলেন অবিচল। কোনো হুমকি বা ভয় তাঁকে এক চুলও নড়াতে পারেনি। ছয় দফার সমর্থনে বঙ্গবন্ধু আরো যুক্তি দেখান : ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ১৭ দিনের যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানবাসীর কাছে স্পষ্ট করে যে দেশের পূর্ব অংশের প্রতিরক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানের করুণা বা সৌজন্যে চলতে পারে না। আরো বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা এক হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করতে পারে না। বলা বাহুল্য, সাধারণ মানুষ এই দফাগুলোকে স্বল্পতম সময়ে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে।
ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু শুধু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্যই ছয় দফা উত্থাপন করেননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি আন্দোলন, যা বাঙালি জনজীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করবে। তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ এবং পদক্ষেপ ছিল সুচিন্তিত। ফলে একের পর এক তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছে। সইতে হয়েছে অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন। কিন্তু যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে তিনি ছয় দফার শুরু করেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন লাভ করেছে তাঁর প্রস্তাব। এই আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছে ছাত্র ও শ্রমিক সমাজ। আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে গেছেন। পুলিশি নিপীড়নের মাত্রা সীমা ছাড়িয়েছে। এর পরও পূর্ব বাংলার শহর-নগরে গণবিপ্লব সাধিত হয়েছে।
১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ১৯৬৮-৬৯-৭০ হয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলার মাটিকে প্লাবিত করেছে। আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার কারণে জনপ্রিয় পত্রিকা ইত্তেফাক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্পাদক মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর পরও আন্দোলনের তীব্রতা কমানো যায়নি। আন্দোলন বাঙালি জনজীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। এক পর্যায়ে ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সশস্ত্র পথে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। মূল আসামি শেখ মুজিব; যদিও তিনি তখন জেলে বন্দি।
কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্রতত্ত্বই কাজে আসেনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গোটা পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। ফলে পাকিস্তানের লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটেছে। শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হয়েছে। দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
এরপর আসে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের কেন্দ্র ও পূর্ব পাকিস্তানে সরকার গঠনের বৈধ ও পরিপূর্ণ ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের ইতিহাস সেখানেই থেমে থাকেনি। সেই গণম্যান্ডেটকে অস্বীকার করে, ক্ষমতা হস্তান্তর না করে, দেশের সেনাবাহিনী বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। এই ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। শুরু হয় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের সশস্ত্র আন্দোলন, ঘটে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। কার্যত এটি ছিল এক দফার আন্দোলনের সুচিন্তিত প্রাথমিক যাত্রা। এই আন্দোলন বাঙালি গণমানুষকে আত্মসচেতন করেছে, স্বাধীনতা অর্জনের পথে জাতিকে রণাঙ্গনে নিয়ে গেছে। এই আন্দোলন আইয়ুব খানের একনায়কত্বের পতন ঘটিয়েছে, কুখ্যাত মোনেম খাঁকে অপসারণ করেছে, এমনকি ২৩ বছরের পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি নির্বাচন সম্পাদন করতে বাধ্য করেছে। ফলে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পত্তন ঘটেছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। আর এই প্রক্রিয়ার মূল কারিগর, মূল নেতা ছিলেন অসামান্য রাজনীতিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
সম্পর্কিত খবর

ট্রাম্পের ইউক্রেসি বয়ান
- জিয়াউদ্দিন সাইমুম

২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচন অনেক আমেরিকানের সামগ্রিক মানসিকতায় এক রূপান্তরমূলক পরিবর্তন তুলে ধরতে পেরেছে। কারণ ঐতিহ্যগতভাবে প্রচারণা সমাবেশে রিপাবলিকান প্রার্থীর নামই উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প মঞ্চে উপস্থিত হতেন, তখন জনতার স্লোগানটি ছিল : ‘যুক্তরাষ্ট্র! যুক্তরাষ্ট্র! যুক্তরাষ্ট্র!’
এই স্লোগানটির অর্থ কী? এর তাৎপর্য কী? গভীর হতাশা এবং আবেগপ্রবণ আশার শেষহীন দোলাচলে মানসিক উত্তেজনা থেকে স্লোগানটির জন্ম। ট্রাম্পপন্থীদের মতে, ‘আমেরিকাকে আবার মহান করুন’ (MAGA) ধারণাটি কিছু লোকের কাছে রীতিমতো অভিশাপ, কিন্তু দেশপ্রেমিক আমেরিকানদের কাছে স্লোগানটি একটি জাতিকেন্দ্রিক সরকারের জন্য তাঁদের আকুলতার প্রতীক।
ট্রাম্প ও তাঁর আন্দোলন আমেরিকান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সমাপ্তির পাশাপাশি একটি নতুন ধরনের সরকার ব্যবস্থা সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাঁদের মতে, এই রূপান্তর কৌশলকে যথাযথভাবে দেশপ্রেমিক ইউক্রেসি হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে, যা সমসাময়িক আমেরিকান শাসনব্যবস্থায় প্রাচীন গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়ের একটি আধুনিক অনুবাদ।
তাঁদের মতে, এই নতুন ধারণাটির ভিত্তি হচ্ছে নিপাট দেশপ্রেম। তাত্ত্বিক দিক থেকে এটিই ইউক্রেটিক (গ্রিক বঁ থেকে উদ্ভূত, যার আভিধানিক অর্থ ‘ভালো’)।
এই ইউক্রেটিক মূল্যবোধের সম্ভাব্য পরিণতি আঁচ করতে পেরেই মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের মতো স্বৈরচারী দেশগুলো ট্রাম্প ও তাঁর চৌকস টিমকে নজিরবিহীন আগ্রহে স্বাগত জানাতে বাধ্য হয়েছে। মাথা ঘোরানো অঙ্কের অর্থনৈতিক ও সামরিক চুক্তি আর কল্পনাতীত দামি উপহার এই দেশগুলো ট্রাম্পের চরণে নিবেদন করতে বাধ্য হয়েছে। এই সফর ট্রাম্পের বহুল আকাঙ্ক্ষিত এমন একটি ইউক্রেটিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করেছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিকরা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার এবং একটি আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার দিকে মনোনিবেশ করতে পারে। চতুর ট্রাম্প সম্ভবত এটি আগেভাগেই স্থির করে ফেলতে পেরেছেন, তাঁর ইউক্রেটিক বিশ্ব গঠনের অর্থনৈতিক দিকটি তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবের দেশগুলো থেকে আদায় করে নিতে পারবেন।
ট্রাম্প উদ্ভাবিত ইউক্রেসি তত্ত্বের ভবিষ্যৎ আসলে কেমন হবে, তা এই গ্রহবাসী জানে না।
তাহলে ট্রাম্প কি গণতন্ত্রের অবসান টেনে আনছেন? হ্যাঁ, যদি প্রশ্নটি আমেরিকান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি ত্রুটিপূর্ণ সংস্করণের পতনের কথা উল্লেখ করে, তাহলে উত্তরটি ইতিবাচক হতে বাধ্য। কারণ মার্কিন সমাজব্যবস্থা এখন সীমাহীন উদাসীনতা, দৃষ্টিকটু পক্ষপাত এবং আদর্শিক চরমপন্থায় জর্জরিত, যা প্রগতিবাদের ছদ্মবেশে নিজেই নিজের ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যু করে দিচ্ছে, যা প্রায়ই সমাজের সবচেয়ে দুর্বলদের নিয়মিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ পন্থায় শোষণ করে যাচ্ছে।
কিন্তু ট্রাম্পের ইউক্রেটিক ভক্তরা পাল্টা বয়ান দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের দাবি ট্রাম্পের ইউক্রেটিক দর্শন আমেরিকাকে আবার মহান করে তোলার জন্য জনগণের ইচ্ছা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষয়কে নির্দেশ করছে। এটি মোটেও গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিপন্ন করছে না, বরং MAGA (Make America Great Again) এবং MAHA (Make America Honest Again) উদ্যোগের মাধ্যমে ট্রাম্প ও তাঁর মিত্ররা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছেন না, বরং রূপান্তর করছেন। তাঁরা শাসনের একটি নতুন রূপের সূচনা করছেন, যা কেতাবি নাম ‘ইউক্রেসি’। এটি জনগণের ভালোর জন্য, ভালো মানুষের দ্বারা পরিচালিত একটি সরকার।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক

অমানুষের রাজনীতিতে কোনো স্থান নেই
- সাঈদ খান

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আজ এমন এক জটিল অবস্থায়, যেখানে নৈতিকতা ও মানুষের জন্য রাজনীতির জায়গা ক্রমেই সংকীর্ণ হচ্ছে। খুনি, ধর্ষক, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ আর দুর্নীতিবাজরা শুধু আইন-শৃঙ্খলা নয়, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও ধ্বংস করছে। নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, খুন, গুম, চাঁদাবাজি এবং নিরীহ মানুষের ওপর সন্ত্রাস—এসব শুধু বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, এগুলো আমাদের সমাজকাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে ভেতর থেকে।
অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত শাস্তির নামে ‘মব ভায়োলেন্স’ বা গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে চলেছে, যা ন্যায়বিচারের বদলে প্রতিশোধের সংস্কৃতি তৈরি করছে।
রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভেতরে শুদ্ধি, জবাবদিহি ও নৈতিক নেতৃত্ব তৈরির প্রয়োজনীয়তা অবহেলা করলে এ দেশের রাজনীতি আরো নষ্ট হবে।
আমরা অনেক সময় দেখি, অপরাধীদের ‘আমাদের’ বা ‘আপনাদের’ বলে ভাগ করে নেওয়া হয়। এতে নিরীহ মানুষ বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, অপরাধীরা পায় প্রশ্রয়। রাজনীতি কখনো পক্ষপাতের জায়গা হতে পারে না। অপরাধ ও অপরাধীকে দল-মতের ঊর্ধ্বে রেখে বিচার করতে না পারলে আমরা একটি বিভাজিত সমাজের দিকে ধেয়ে যাব। রাজনৈতিক দলগুলো যদি অপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের দল থেকে চিরতরে বহিষ্কারে ব্যর্থ হয়, তবে তারা জনগণের আস্থা হারাবে।
দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, ডাকাত, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের আর কোনোভাবে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। যারা দলের নাম ব্যবহার করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে, জনস্বার্থ ত্যাগ করে নিজের আখের গুছিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে অতি দ্রুত দল থেকে চিরতরে বহিষ্কার করতে হবে। কারণ এসব চরিত্রই জনগণের আস্থা নষ্ট করে, রাজনীতিকে কলুষিত করে এবং রাষ্ট্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে। শুদ্ধি অভিযান হতে হবে সাহসিকতা ও নৈতিকতার সঙ্গে। কারণ রাজনৈতিক শুদ্ধি ছাড়া সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আমাদের উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে হবে, অমানুষের রাজনীতিতে কোনো স্থান নেই। যারা মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা ও গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাস করে না, তারা রাজনীতির নামে শুধু ক্ষমতা ও সন্ত্রাসের ব্যবসা করে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের মতো আচরণ করলে বিএনপিরও একই পরিণতি হবে।’ এটি কেবল বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়, এটি নিজের দলের প্রতি কঠোর আত্মসমালোচনা এবং নৈতিক শুদ্ধির আহবান। আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতা যে দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, দলীয়করণ আর অরাজকতা তৈরির ইতিহাস বিএনপি দেখেছে, সেটির পুনরাবৃত্তি হলে ফলাফল হবে একই—জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন, রাজনৈতিক সংকট গভীরতর। এই সতর্কতা অপরিহার্য। কারণ রাজনৈতিক শুদ্ধি ছাড়া একটি দল টিকে থাকতে পারে না।
রাজনীতিতে ভুল করেননি এমন কোনো রাজনৈতিক নেতা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে যাঁর ভুলের পরিমাণ যত কম, তিনি তত বেশি সফল। তাঁকে জনগণ তত বেশি ভালোবেসে মনে রেখেছে। আবার যে নেতা যত বেশি ভুল করেছেন, তিনি তত বেশি নিন্দিত হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশি নিন্দিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। তারেক রহমান পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘এখন কিন্তু মানুষ অনেক সচেতন। মানুষ আমাদের ওপর আস্থা রাখতে চাইছে, আমাদের ওপর অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ওপর। এই আস্থা যদি নষ্ট করার জন্য কেউ কোনো কাজ করে, তাহলে ভাই তাকে তো আমার পক্ষে টানা সম্ভব না। তাকে আমি টানব না। তাকে শেলটার আমি দেব না।’
বিএনপির অর্জন ও অবদান ধুলায় মেশানোর অধিকার কারো নেই—এ কথা স্পষ্ট। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়, অর্থনৈতিক সংস্কারে, নারীর ক্ষমতায়নে, মত প্রকাশের স্বাধীনতায়, গ্রামীণ উন্নয়নে বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। এই ইতিহাসকে ভুলে গেলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভিত্তি দুর্বল হবে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বকে দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে শুদ্ধি ও জবাবদিহির সংস্কৃতি প্র্রতিষ্ঠিত হয়।
শিক্ষাব্যবস্থা যখন মূল্যবোধহীন, সংস্কৃতি যখন ভোগবাদী আর সমাজ যখন লোভের পূজারি, তখন অপরাধীরা শুধু অপরাধ করে না—নিয়ন্ত্রকও হয়ে ওঠে। তারা হয়ে ওঠে নেতা, ঠিকাদার, মালিক আর সাধারণ গরিব মানুষ হয় নির্যাতিত ও বঞ্চিত। বর্তমানে বাংলাদেশে অপরাধ বেড়েই চলেছে : ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাং, সিন্ডিকেট, মাদক—সবই চলে রাষ্ট্রের ছায়ায়। সরকার নীরব, আইনি ব্যবস্থা ঘুমন্ত, জনগণ আতঙ্কে। এসব সংকটের প্রতিকার শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতায় সম্ভব নয়, প্রয়োজন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর গভীর সংস্কার।
সমাধান একটাই—অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। ধনী-গরিবের ব্যবধান কমানো, সবার জন্য শিক্ষা, কাজ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হলো মূল চাবিকাঠি। রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তি আনতে হবে, যাতে মানবিকতা, নারীর মর্যাদা ও যুবসমাজের নৈতিকতা গড়ে ওঠে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো দেখিয়েছে—সুশাসন থাকলে অপরাধ থাকে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা-ই প্রযোজ্য। তবে এর জন্য সবার আগে দরকার একটি নির্বাচিত সরকার।
বাংলাদেশে এক সুন্দর, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের। আমাদের একান্ত প্রত্যাশা হলো বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভেতর থেকে শুদ্ধ হবে, অপরাধীদের নির্মূল করবে এবং দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত নেতৃত্ব গড়ে তুলবে। অন্যথায় ইতিহাস তাদের কঠোর বিচার করবে।
রাজনীতি মানুষের জন্য মানবিকতা, ন্যায়বিচার, সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। এখানে খুনি, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, সন্ত্রাসী, অপরাধীদের ঠাঁই নেই। সময় এসেছে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করার—অমানুষের রাজনীতিতে কোনো স্থান নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে

সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার একটি ভিন্ন বিষয়
- নিরঞ্জন রায়

সরকার সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার হ্রাস করেছে। ঋণের ওপর যে সুদের হার নির্ধারণ করা হয়, তার সঙ্গে ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হারের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের ওপর যে সুদের হার, তার সঙ্গে ব্যাংকঋণের ওপর সুদের হারের কোনো রকম প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। অনেকে বলে থাকেন যে সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও পরোক্ষ সম্পর্ক আছে।
আমরা সবাই জানি যে ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে যে আমানত সংগ্রহ করে, তার একটি অংশ তারল্য রেখে বাকিটা ব্যবসায়ীদের মাঝে ঋণ হিসেবে বিতরণ করে। ব্যাংক আমানতকারীদের যে হারে সুদ দেয়, তার সঙ্গে পরিচালনা ব্যয়, ঝুঁকি গ্রহণের মূল্য এবং লভ্যাংশ বাবদ কিছু অংশ যোগ করে ঋণের ওপর সুদের হার নির্ধারণ করে।
দেশের মুদ্রাবাজারের এই সমীকরণের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হারের কোনো রকম ভূমিকা নেই। এ কথা ঠিক যে দেশে সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদ বহাল থাকলে গ্রাহক কম সুদের হারে ব্যাংকে অর্থ জমা না রেখে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন। ফলে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ করতে বেশ সমস্যা হয় এবং তখন ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। এটি একটি ধারণা এবং খুবই অল্পসংখ্যক আমানতকারী এমনটি করতে পারেন।
সঞ্চয়পত্র এক বিশেষ ধরনের বিনিয়োগব্যবস্থা, যা বিক্রি করে সরকার অর্থ সংগ্রহ করে বাজেট ঘাটতি মেটানো এবং দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। আমাদের দেশে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে সরকারকে সব সময়ই জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। সঞ্চয়পত্র হচ্ছে খুব সহজে এই অর্থ সংগ্রহের একটি মাধ্যম। অপরপক্ষে আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেভাবে নেই। বেকারত্বের সংখ্যাও মাত্রাতিরিক্ত। এমনকি সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য চাকরিজীবীদের সে রকম অবসর ভাতার ব্যবস্থাও নেই। সমাজের এই শ্রেণির জনগোষ্ঠী মূলত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেই জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। ফলে সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার হ্রাস পেলে সাধারণ মানুষ, যাদের জীবনযাত্রা এই বিনিয়োগ থেকে অর্জিত সুদের ওপর নির্ভরশীল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অবশ্য এ কথাও ঠিক যে সঞ্চয়পত্র যতই বিশেষায়িত বিনিয়োগব্যবস্থা হোক না কেন, সরকারকে অনেক উচ্চ হারে সুদ প্রদান করতে হয়, যা সরকারের রাজস্ব ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়। আপাতত এই বাড়তি সুদের বোঝা মেনে নিলেও ভবিষ্যতে কোনো এক সময় এই সুদের হার হ্রাস করতেই হবে। তবে সেই কাজটি করার আগে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রথমেই হরেক রকমের এবং বিভিন্ন ধাপের সঞ্চয়পত্র বাতিল করে খুবই সাধারণভাবে তিন ধরনের সঞ্চয়পত্রের প্রচলন করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সঞ্চয়পত্র এবং বিভিন্ন মেয়াদের বন্ড বিক্রি করে সরকারের অর্থ সংগ্রহের জন্য দেশে পৃথক সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট চালু করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, কোন ধরনের সঞ্চয়পত্র সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে লেনদেন করা যাবে আর কোন ধরনের সঞ্চয়পত্র যাবে না, তা নির্ধারণ করা থাকবে, যাতে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল সাধারণ জনগোষ্ঠী সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে লেনদেনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
বিষয়টি একটু জটিল মনে হতে পারে বিধায় একটি কাল্পনিক উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে তিন ধরনের সঞ্চয়পত্র চালু করা হলো, সেগুলো হতে পারে এ, বি ও সি সিরিজের সঞ্চয়পত্র। এ সিরিজের সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ ক্রয়সীমা হবে ২৫ লাখ টাকা, যার ওপর সর্বাধিক হারে সুদ অর্থাৎ ১৩ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করা যেতে পারে। এই ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হবে তাঁদের কাছে, যাঁদের নিয়মিত উপার্জন নেই বা উপার্জনের পরিমাণ খুবই নগণ্য। এ সিরিজের সঞ্চয়পত্র কোনো অবস্থায়ই সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে লেনদেন করা যাবে না। বর্তমান ব্যবস্থার মতোই মেয়াদপূর্তির আগে ভাঙানোর সুযোগ থাকবে।
বি সিরিজের সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার তুলনামূলক কম হবে, যা হতে পারে ১০ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। যাঁরা এ সিরিজের সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার উপযুক্ত হবেন না, কিন্তু তাঁদেরও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে, তাঁরাই এই বি সিরিজের সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন। এই সঞ্চয়পত্র সেকেন্ডারি মার্কেটে শর্তযুক্ত লেনদেনের সুযোগ থাকবে।
সি সিরিজের সঞ্চয়পত্র হবে খুবই সাধারণ মানের বিনিয়োগব্যাবস্থা, যেখানে সুদের হার হবে অনেক কম, যা ৬ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এই সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো রকম সীমারেখা থাকবে না। যে কেউ চাইলে যেকোনো পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবেন এই ধরনের সঞ্চয়পত্রে। সি সিরিজের সঞ্চয়পত্র স্বাভাবিকভাবে লেনদেন করা যাবে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে। যেহেতু সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে নিয়মিত লেনদেনের কারণে এই ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের কিছু অতিরিক্ত লাভের সুযোগ থাকবে, তাই সুদের হার কম হওয়া সত্ত্বেও মানুষ এখানে বিনিয়োগ করবে।
এভাবে পুরো সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন এই বিনিয়োগ সুবিধাকে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে টেকসই রূপ দিতে পারবে, অন্যদিকে তেমনি সঞ্চয়পত্রে গড় সুদের হার উল্লেখযোগ্য কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে। তবে এই ব্যবস্থা সফল করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দেশে একটি সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট চালু করা। উল্লেখ্য, দেশে কার্যকর মুদ্রাবাজারের স্বার্থে অনেক আগেই একটি সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট চালু করা উচিত ছিল, কিন্তু সেটি হয়নি। তাই আর দেরি না করে অনতিবিলম্বে স্বতন্ত্র একটি সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। আর বন্ড মার্কেট প্রতিষ্ঠাসহ পুরো সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কাজটি যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পন্ন না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রকে একটি বিশেষ বিনিয়োগব্যবস্থা হিসেবে রাখা প্রয়োজন। যেহেতু সঞ্চয়পত্র সামাজিক নিরাপত্তার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে, তাই এই খাতে সুদের হার হ্রাস করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com

বিদেশে বাংলাদেশিদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া
- আবু তাহের খান

সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে মালয়েশীয় পুলিশ ৩৬ জন বাংলাদেশিকে আটক করেছে। মালয়েশিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ এর আগেও উঠেছে এবং সেসব কারণে অতীতে বহু বাংলাদেশিকে দেশে ফেরতও পাঠানো হয়েছে। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর তো মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়াই প্রায় বন্ধ রেখেছিল।
বাংলাদেশি লোকজন শুধু যে মালয়েশিয়ায় গিয়েই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে তা-ই নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার অপরাপর দেশে গিয়েও তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে বা সে ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
এসব অপরাধ সাম্প্রতিক সময়ে এতটাই বেড়ে গেছে যে অনেক দেশ বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে কিংবা তা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।
প্রায় একই অবস্থা এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রেও। সেসব দেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের ভিসা পাওয়া আগে এতটাই সহজ ছিল যে পর্যটন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেসব দেশে পর্যটক পাঠানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হন্যে হয়ে বিজ্ঞাপন দিত। কিন্তু উজবেকিস্তান, কাজাখস্তানসহ সেই দেশগুলোও এখন বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে চায় না। বাংলাদেশিদের প্রতি মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু যে পর্যটকদের জন্যই দুঃসংবাদ তা-ই নয়, বরং এর সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে যাচ্ছে ওই সব দেশে বাংলাদেশি পণ্যের যে বিপুল বাজার-সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তার ওপর। আগে দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় কোনো দেশেই বাংলাদেশিরা তেমন একটা যেতে চাইতেন না।
অন্যদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা পাওয়া অনেক আগে থেকেই কঠিন। গত ৪ জুন ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানের বিষয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা শুধু আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরই পরপন্থী নয়, জাতিগত অপমানেরও এক লিখিত ভাষ্য। সেখানে তারা বাংলাদেশি ভিসাপ্রার্থী নাগরিকদের উদ্দেশে লিখেছে, ‘যদি কর্মকর্তাদের মনে হয়, কারো যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য সেখানে সন্তান জন্ম দিয়ে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা, তবে তার পর্যটন ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে।’ কী আশ্চর্য বাক্যাচার!
বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের এই যে ক্রমবর্ধমান হারে নানা জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং অন্য নানাবিধ অপরাধ ও আইন ভঙ্গের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, এর প্রতিকার কী? এর প্রতিকার আইন করে বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মানসিকভাবে প্রণোদিত করে সাধন করা সম্ভব নয়। আসলে এটি একটি জাতিগোষ্ঠী ও সমাজের নানা আচার-আচরণ ও মূল্যবোধের দীর্ঘকালীন চর্চারই ক্রমরূপান্তরজনিত ফলাফল। দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষের মধ্যে যে সুউচ্চ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের পরিচালকরা সেটি ধরে রাখতে তো পারেনইনি, বরং দিনে দিনে তার আরো অধঃপতন ঘটিয়েছেন। ফলে এ সময়ের মধ্যে এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দেশের ভেতরে বা বাইরে যখন যেখানেই গেছে, সেখানেই তারা নিজেদের মর্যাদাপূর্ণভাবে তুলে ধরার পরিবর্তে আরো নানাবিধ অপরাধী আচরণ ও চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছে, যা বস্তুত একাত্তরের মূল্যবোধ ও ভাবমূর্তিকে ধরে রাখতে না পারারই ফল।
অন্যদিকে দেশ, রাষ্ট্র ও সমাজ বর্তমানে যে ধারায় এগোচ্ছে, তাতে দেশ-বিদেশের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এ দেশের নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান হারে জড়িয়ে পড়া থেকে শিগগির পরিত্রাণ মিলবে বলে তো মনে হচ্ছে না। তার পরও একটি ছোট্ট সাময়িক প্রস্তাব : বিদেশের বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো যদি কাগুজে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে মমতা ও আন্তরিক দায়বোধ নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে তাঁদের ওই ক্ষুদ্র অপরাধী অংশের অধঃপতনশীল আচরণ বহুলাংশেই সীমিত হয়ে আসবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)
শিল্প মন্ত্রণালয়