ঢাকা, সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫
৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৮ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫
৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৮ মহররম ১৪৪৭

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ভবিষ্যৎ

  • লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান (এলপিআর)
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ভবিষ্যৎ

গত কয়েক দিন থেকে লক্ষ করছি ইসরায়েল গাজাসহ জেরুজালেমে ফিলিস্তিন জনগণের ওপর পাশবিক তাণ্ডব চালাচ্ছে। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করাই মানবতার ধর্ম; কিন্তু ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী পবিত্র রমজান মাসে আল আকসা মসজিদে ঢুকে ধর্ম পালনকারী নিরীহ নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর যে অত্যাচার করেছে এবং করেই চলছে সেই অনুভূতি থেকে লেখা।

আমার মনে আছে, সেটা ২০০২ সালের কথা, জার্মানির স্কুলে গোলাগুলির একটি দুর্ঘটনা ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় প্রায় ১৬ জন ছাত্র-শিক্ষক নিহত হন।

একসঙ্গে এত নিষ্পাপ প্রাণের এভাবে অকালমৃত্যু সারা বিশ্বকে নাড়া দেয় এবং ব্যথিত করে। জার্মান সরকার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। পাশাপাশি পৃথিবীর অনেক দেশ জার্মান সরকার ও জনগণের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে শোক পালনসহ জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার মতো কার্যক্রম হাতে নেয়। কারণ মানবতা নিষ্পাপ শিশুসহ নিরপরাধ মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি।

২০০২ থেকে ২০২১ সালের চলতি মাস পর্যন্ত অন্তত কয়েক হাজার নিষ্পাপ ফিলিস্তিন শিশু ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। কয়েকটি দেশ শোক দিবস পালন করেছে বা পতাকা অর্ধনমিত করেছে? করেনি, এর কারণ হলো তিনটি : ১. Demonization : গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সংস্থা ফিলিস্তিনিদের এমনভাবে  Demonize করেছে যে কোনো নিষ্পাপ নিরপরাধ শিশু বা কিশোর ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মারা গেলে বিশ্ববিবেকের বড় অংশের কাছে খারাপ লাগে না। ব্যাপারটা এমন যে এই শিশুরা  Budding Terrorist (ভবিষ্যতের সন্ত্রাসী)। তারা মারা গেলে ততটা খারাপ লাগার কিছু নেই, যেমনটা জার্মান শিশুদের বেলায় ছিল।

২.  Deep State : চোখ-সওয়া/গা-সওয়া হয়ে গেছে। ব্যাপারটা তো এমনই হয়, হচ্ছে, হওয়ারই কথা, হয়ে আসছে, এ আবার নতুন কী। এটা

 Internal Conflict (অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব), এটা ইসরায়েলের নিজস্ব ব্যাপার। ৩. Fear of Anti-Semitism Labelled nIqv : Internationally Politically Incorrect (আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক ভুল) হওয়ার ভয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, দেশ, জাতি, সংস্থা কথা বলে না। এটা কতটা প্রভাবিত করে তার দুটি উদাহরণ দিচ্ছি : ক. সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত জার্মান স্বনামধন্য লেখক গুন্টার গ্রাস ২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ‘নিউক্লিয়ার ইহুদি রাষ্ট্র’ ইসরায়েল নিরাপত্তার জন্য হুমকি ও ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যে অন্যায় করছে এ নিয়ে কবিতা এবং তাঁর মতামত প্রকাশ করলে ইসরায়েল ফুঁসে ওঠে।

ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাপ সৃষ্টি করে। ইসরায়েল তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। ‘ইহুদিত্ব লবি’ মোটামুটি তাঁকে কোণঠাসা করে ফেলে। বিশ্বে একজন বিতর্কিত বুদ্ধিজীবী-সাহিত্যিকের কাতারে ফেলে দেয়। খ. ২০১৭ সালের নির্বাচনে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী লিপেন “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে ইহুদিদের অ্যারেস্টের সঙ্গে ‘রাষ্ট্র ফ্রান্স’ দায়ী ছিল না, বরং তখন যাঁরা সরকারে বা প্রশাসনে ছিলেন তাঁরাই দায়ী ছিলেন”—এই উক্তি করায় এবং অতীতে তাঁর রাজনীতিবিদ পিতা ‘হলোকাস্ট’ নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন সব মিলিয়ে ইসরায়েলও ‘ইহুদিত্ব লবি’ ভীষণ খেপে যায়। সত্যিকার অর্থে মারি লে পেন ‘পলিটিক্যাল কফিনে’ ‘ইহুদিত্ব লবি’ শেষ পেরেক মেরে দেয়। অবশ্য মারি লে পেন অন্য প্রতিদ্বন্দ্ব্বী ইমানুয়েল ম্যাখোঁ দ্রুত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিহতদের (হলোকাস্টের শিকারসহ) মেমোরিয়ালে সম্মান জানাতে ছুটে যান। ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। মোদ্দাকথা ইহুদিত্ববাদীরা  (Zionist) সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে অনেক প্রভাবশালী। তাদের বিপক্ষে দাঁড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।

তাহলে এভাবেই চলবে? হ্যাঁ। যত দিন বাইরের (পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেকে) ইহুদিরা বসতি স্থাপন করতে ইসরায়েলে আসবে, তত দিন এমনই চলবে। এই মাইগ্রেশন প্রধানত হচ্ছে Zionism Ideology (ইহুদিত্ব/ইহুদিবাদী মতবাদ : নিজস্ব ইসরায়েল রাষ্ট্র ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মতাদর্শ, যা ইহুদি ধর্ম থেকে ভিন্ন ধারণার ওপর দণ্ডায়মান)-এর কারণে। অর্থনৈতিক বা অন্যান্য কারণ কিন্তু গৌণ। যারা বসতি স্থাপন করতে আসছে তারা  Perceived/Real Deprivation of minority psyche in a majority society— এই ট্রমা সঙ্গে নিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার স্বাধীনতা ও সুখবোধ এবং এই আধিপত্য ধরে রাখতে না পারলে আবার সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে একটা অস্বাভাবিক আক্রমণাত্মক মানসিকতা তৈরি করে। এরপর প্রতিনিয়ত আগমনকারী এসব বসতি স্থাপনকারীকে দখলি এলাকায় বা ফিলিস্তিনে বসবাসকারী আরবদের সঙ্গে একই নিকটবর্তিতায় বসবাস করলেও সহানুভূতি বিকাশ হয় না। তা ছাড়া  Zionism Ideology ফিলিস্তিন তাদের জন্মভূমি এবং ফিলিস্তিনরা বা আরবরা (ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘আরব’ বলে) তিন হাজার বছর ধরে তাদের আবাসস্থল দখল করে আছে এই বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করে দেয়। সুতরাং ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অত্যাচার করতে গিয়ে কোনো নৈতিক দ্বিধায় ভোগে না। আমার ইসরায়েলি সহপাঠী ‘অ্যারন’কে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এমন অমানবিক আচরণ কেন করো? অ্যারনের উত্তর : আরবদের বেলায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অমানবিক  (Disproportionate and Brutal) আচরণ ছাড়া অন্য পন্থা কাজে দেয় না। পরে অ্যারন ইসরায়েলের ন্যাশনাল রিজার্ভ ফোর্স কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

আমার এক ভারতীয় সহপাঠী বলেছিল, তুমি ইসরায়েলে ঘুরে আসার পর তাদের বর্ণনায়  (Narrative) তোমার মনে হবে যে তাদেরও একটি বক্তব্য রয়েছে। আমার ৯-১০ দিনের শিক্ষাসফরে রামাল্লা, জেরিকো, হেবরন, জেরুজালেম ঘুরে ফিলিস্তিনিদের অসহায়ত্ব ও প্রতিনিয়ত যে অপমানকর পরিস্থিতির মাঝ দিয়ে যায়, তাদের যে মানবিক মর্যাদা ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে—এসব দেখে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। হেবরনে এক ফিলিস্তিনি আমার কাছে সাহায্য চাইল, সঙ্গে দুই-তিনটা বাচ্চা। সে জানাল, তার সাতটি বাচ্চা। আমি বললাম, তোমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই, এমন অবস্থায় সাতটি বাচ্চা কেন? সে যে উত্তর দিল তা মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টের। আর যা ছিল, ‘এরা সবাই থাকবে না।’ এদের ভেতর কেউ কেউ ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের মোবাইল টার্গেটে পরিণত হবে।

তার পরও কোথায় যেন মনে হয়েছে ইসরায়েলিদের একটি বক্তব্য রয়েছে। আর আপনি যদি ইহুদি যুবক হন, যাঁদের অ্যারনের মতো মাথায় ঢুকে গেছে যে আরবরা অমানবিক আচরণ আর বর্বরতা ছাড়া সাড়া দেয় না, তাহলে এই নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি কিভাবে হবে? আমরা হয়তো অনেকে জানি, ইসরায়েলি যুবক-যুবতিদের দুই-তিন বছর বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে হয়; কিন্তু আমরা কয়জন জানি যে যদি আপনি বিশ্বের যেকোনো জায়গায় ইহুদি হন, তবে আপনার জন্য ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে দুই-তিন বছর দায়িত্ব পালন করা নৈতিকভাবে বাধ্যতামূলক। এটা একজন ইহুদি হয়ে ইহুদি রাষ্ট্র-জাতিকে রক্ষা করার ব্রত। আর প্রতিনিয়ত এভাবে ফিলিস্তিনিদের অত্যাচারের মাধ্যমে ইসরাইয়েলি বাহিনীর সদস্যরা সে ব্রত পালন করে চলেছে। ইসরায়েল ভ্রমণে আমাদের দলের সঙ্গে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স থেকে দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে সমন্বয়কারী হিসেবে ছিল। যাদের একজন ছিল ভেনিজুয়েলার, দুজন যুক্তরাজ্য থেকে আর একজন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এদের কারো পরিবার কোনো দিন ইসরায়েলে ছিল না। এরা ইহুদিত্ব মতাদর্শের জন্য কাজ করবে। অত্যাচারের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ঘরছাড়া করবে এবং কেউ ইচ্ছা হলে ইসরায়েলে থেকে যাবে বা কেউ পবিত্র দায়িত্ব পালন শেষে নিজের দেশে ফিরে যাবে। এরা কিন্তু বিদেশি-ভাড়াটে যোদ্ধা  (Foreign Fighter) না।

Foreign Fighter হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হবে না, কোনো নিষেধাজ্ঞার বাধায় পড়বে না।

Foreign Fighter অপবাদের জন্য প্রাথমিকভাবে মুসলিম যুবক-যুবতি হয়ে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান বা পশ্চিম আফ্রিকার সংঘাতপূর্ণ এলাকায় ইহুদি যুবক-যুবতিদের মতো একইভাবে দীক্ষিত হয়ে হাজির হলেই আপনি Foreign Fighterহিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যাবেন, বিচিত্র এই পৃথিবী।

তবে আমার সব সময় মনে হতো, ইসরায়েল ক্ষুদ্র একটি দেশ, যার জনসংখ্যাও ক্ষুদ্র, তারা কিভাবে মধ্যপ্রাচ্যের এত সম্পদশালী এবং জনবহুল দেশগুলোর ওপর ছড়ি ঘোরায়। সৌদি আরবের সামরিক বাজেট প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার, ইরানের প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার আর ইসরায়েলের সামরিক বাজেট ২০ বিলিয়ন ডলার। কেউ হয়তো বলবেন, আমেরিকা তাদের সঙ্গে আছে। মনে রাখবেন, গাড়ি ধাক্কা দিয়ে চালু করা যায়; কিন্তু ধাক্কিয়ে গন্তব্যে নেওয়া যায় না। গাড়ি চালু হওয়ার পর নিজে চলার সক্ষমতা থাকতে হয়। সেটা কী? ২০১৪ সালে দুটি ঘটনায় বিষয়টি আমার কাছে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায়। যার একটি এখানে তুলে ধরছি। যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব ডিফেন্স স্টাডিজে শিক্ষানবিশ অফিসার হিসেবে প্রশিক্ষণকালে মধ্যপ্রাচ্যে শিক্ষাসফরের অংশ হিসেবে আমরা ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্স সদর দপ্তর পরিদর্শন করি।

আমাদের ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স সদর দপ্তরে চিফ অব জেনারেল স্টাফের সঙ্গে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে মিটিং ছিল। লন্ডন থেকে আমাদের বলা হচ্ছিল,  ‘When you are in Israel, maintain time’ (তোমরা যখন ইসরায়েলে অবস্থান করবে তখন সময়ের দিকে খেয়াল রাখবে)। যখন ব্রিটিশরা এটা বলছে, মানে সময় নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আমরা যথাসময় ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স সদর দপ্তরে (বেশ উঁচু বিল্ডিং) প্রবেশ করে দেখলাম আমাদের জন্য লিফট নির্দিষ্ট করা আছে। আমরা যথাসময় ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলাম। ৯টা ৩০ মিনিটে চিফ অব জেনারেল স্টাফের দেখা নেই। ৯টা ৩৬ মিনিটে ভদ্রলোক হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলেন। দম নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এটা শুধু ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সে সম্ভব। যেহেতু একটি লিফট নির্দিষ্ট করা ছিল, অন্য তিন-চারটি লিফটের ওপর বাড়তি চাপ, লম্বা লাইন। চিফ অব জেনারেল স্টাফ লাইনে। তিনি যখন দেখলেন ৯টা ২৫ মিনিটে তখন লাইন ভেঙে বের হলেন। একজন সৈনিক বলে উঠলেন, ‘স্যার, আমরা লাইনে আছি’। যখন প্রায় ৯টা ৩০ মিনিট আবার লাইন থেকে বের হয়ে বললেন,  ‘I have a commitment’। অন্য একজন সৈনিক মন্তব্য করলেন,  ‘At each our level we are committed Sir।’ এটাকে সম্ভবত বলা হয়,  Speaking Truth to the Power। ওই দিন আমার সন্দেহ পরিষ্কার হয়ে গেল কেন ইসরায়েল ছড়ি ঘোরাচ্ছে? আপনি এখন বলুন, মধ্যপ্রাচ্যে কোনো সৈনিক কেন, কোনো অফিসার তাঁর চিফ অব জেনারেল স্টাফকে এভাবে বলতে পারবেন? কোনো আমলা বা কোনো জেনারেল কোনো রাজা-যুবরাজ-আমিরকে এভাবে ‘সত্যিটা’ বলতে পারবে? যেদিন পারবে, মনে রাখবেন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলিদের ছড়ি ঘোরানো সেদিন শেষ হয়ে যাবে। উপরন্তু ইসরায়েল একটি জ্ঞানভিত্তিক ও মেধাভিত্তিক দেশ। তারা মেধাকে ওপরে তুলে আনতে ভুল করে না।     

ইহুদিত্ব-ইহুদি মতবাদের জন্য হুমকি কি? পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের আগমন বা বসতি স্থাপন বন্ধ হয়ে যাওয়া বা ইসরায়েলে বসবাসকারী ইহুদি নাগরিকরা যদি ইসরায়েলে বা ওই অঞ্চলকে অনিরাপদ মনে করে দেশান্তরিত হয়ে চলে যেতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্য বা ওই অঞ্চলের দেশগুলো যেন কোনোভাবেই এই হুমকির কারণ না হয় সে চেষ্টা ইহুদিত্ব মতবাদীদের বা তাদের ‘লবি’র সব সময় ছিল (বর্তমানে এ বিষয়ে তারা অনেকাংশে সফল)। ইরানের নিউক্লিয়ার বোমা বানানো নিয়ে ইসরায়েলের এত বিরোধিতা কেন? যদি ইরান নিউক্লিয়ার বোমা বানায়, তাহলে পরদিন ইসরায়েলে ব্যবহার করবে? না, তেমন হবে না। সেটা ইসরায়েলও জানে, তবে একটা ভয় কাজ করবে। ইসরায়েল একটি ধনী দেশ, তাদের জনগণের বড় একটা অংশ পশ্চিমা দেশ থেকে আসা ও সচ্ছল নাগরিক। যাদের এমন পারিপার্শ্বিক অবস্থা  (Back Ground), তারা তাদের সন্তানদের আতঙ্কের পরিবেশে মানুষ করতে চাইবে না। ফলে তারা মাইগ্রেশন করবে সেটা ইহুদিবাদী-ইহুদিত্ব আন্দোলনের জন্য বড় ভয়-চ্যালেঞ্জ।

ভবিষ্যৎ কী? বাস্তবতা কোনো কোনো সময় কল্পকাহিনিকে হার মানায়। আমার কথাগুলো তেমন শোনাতে পারে। মনে রাখতে হবে, ইসরায়েলে জনসংখ্যার গতিশীলতা (চড়ঢ়ঁষধঃরড়হ উুহধসরপং) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে ‘হারেডিম’ ইহুদি ১২ শতাংশ (১৯৪৮/৪৯ সালে ২% ছিল) যারা ইহুদি রাষ্ট্রে বিশ্বাস করে না, জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করে না (পরিবারে ছয়-সাতটি সন্তান), ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেয় না। তারা ইসরায়েল রাষ্ট্র বা ইহুদিদের নিজস্ব ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে মনে করে ধর্মবিরোধী। ২১ শতাংশ (বেসরকারিভাবে ২৪-২৫%) আরব (যারা ইসরায়েলের নাগরিক, অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলের অধিবাসী না)। এই দুই গোষ্ঠীর জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার অন্যান্য ইহুদির তুলনায় অনেক বেশি। প্রায় ২৭ শতাংশ ইহুদি পরিবার (হারেডিম ব্যতীত) সন্তানহীন। হারেডিমসহ ইহুদিদের পরিবারের গড় সংখ্যা ৩.৫৪ জন। গত ১০ বছরে মোটামুটি একই অবস্থায় আছে। সত্যি বলতে, নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের এনে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে (যা মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় ইরানের নিউক্লিয়ার বোমা এসে গেলে ভীতি সঞ্চারের ফলে বাধাগ্রস্ত হতে পারে)। এসব নানা জটিলতায়  Zionist decision making cycle over stressed হয়ে আছে। সঙ্গেই ক্ষমতা, লোভ, ঘরোয়া রাজনীতি, ভয়—এর সংমিশ্রণে ইসরায়েল সরকার ফিলিস্তিন অধিকৃত অঞ্চলে, পশ্চিম তীরে নতুন করে বসতি স্থাপন করে চলেছে। এর ফলে ‘দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব’  (Two State Theory)-‰র সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।

সত্যি বলতে, বর্তমানে পশ্চিম তীরের ম্যাপ দেখলে অনুমান করা যাবে ‘দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব’তে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব না। ইসরায়েল কি এটা বোঝে না? বোঝে, তবে ঘরোয়া রাজনীতিতে যত বেশি জায়গা দখল করে বসতি স্থাপন করা হবে, তত বেশি রাজনৈতিক ফায়দা  (Mileage) পাওয়া যাবে। এভাবে নেতানিয়াহু টিকে আছেন।

Short term gain হচ্ছে At the cost of long term uncertainty। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যা ৯ মিলিয়ন, এর মাঝে হারেডিম ইহুদি ১২ শতাংশ, আরব ২৪ শতাংশ, মোট ৩.২৫ মিলিয়ন। আর অধিকৃত এলাকায় ছয় মিলিয়ন ফিলিস্তিন (দুই রাষ্ট্রতত্ত্ব ব্যর্থ করার কারণে) অর্থাৎ ৯.২৫ মিলিয়নকে শাসন করবে ৫.৭৫ মিলিয়ন ইহুদিত্ববাদে বিশ্বাসী জনগণ। যেখানে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের শাসন করবে। এটা বর্ণবাদী শাসন। পৃথিবীতে একটা বিষয়ে মানবসভ্যতা মোটামুটি একমত হয়েছে সেটা বর্ণবাদী শাসনের ক্ষেত্রে। দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল আধুনিক বিশ্বে বর্ণবাদসংক্রান্ত সর্বশেষ দেশ। বাকিটা আপনাদের কল্পনা-অনুসন্ধানের ওপর ছেড়ে দিলাম।

আর কি কোনো বিকল্প আছে? আছে। সেটা হলো, ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সুধীসমাজ, সাধারণ জনগণ যখন এই ইহুদিবাদ-ইহুদিত্ববাদের বর্বরতা, ভূমি দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, যা ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, তখন ফিলিস্তিনিদের প্রতি নির্মম আচরণ হ্রাস পাবে। এবার আমরা স্বল্পসংখ্যক হলেও ইসরায়েলের সাধারণ জনগণকে চলমান নির্মমতার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে দেখেছি। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই

‘Breaking the Silence’ নামে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের দ্বারা ‘একটি আন্দোলন’ চলে আসছে, যার মাধ্যমে তারা চাকরিতে থাকাকালীন ফিলিস্তিনিদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন করেছে তার স্বীকারোক্তি দিচ্ছে এবং এই অত্যাচার বন্ধের জন্য জনমত গড়ে তুলছে। গড়পড়তা ইসরায়েলকে অথবা ইহুদিদের  Demonize করলে সেটাও চরম ভুল হবে। সব দেশের সাধারণ মানুষ একই রকম। তারা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তি-সমৃদ্ধিতে থাকতে চায়। কোনো দিন শান্তি ফিরে এলেও সমাজের শক্তিগুলো এ অঞ্চলের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে। ভবিষ্যতে এসবের একটি সম্মিলিত প্রভাব দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষকে সব সময়ই ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এটিকে শুধু ইহুদি-মুসলিম দাঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে সংঘাতের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই সংঘাতকে যদি ধর্মীয় আবরণমুক্ত করে মানবতার চরম বিপর্যয় বা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে উপস্থাপন করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এর অবস্থান পরিবর্তন হতে পারে।

আমাদের কি কিছু করার আছে? হ্যাঁ, আছে। যখন পৃথিবীর বেশির ভাগ মূলধারার গণমাধ্যম চলমান অন্যায়কে না দেখার ভান করছে, তখন নাগরিক গণমাধ্যম, নাগরিক সাংবাদিকদের এই বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা এবং অন্যায়কে তুলে ধরতে হবে, সোচ্চার হতে হবে। কারণ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ভাষায়, ‘এক জায়গায় অবিচার সর্বত্র ন্যায়বিচারের জন্য হুমকিস্বরূপ’  (Injustice anywhere is a threat to justice every where)|

পরিশেষে চলমান সংঘাত যদি নেতানিয়াহুর দুর্নীতি ইস্যু, তাঁর রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা থেকে বেরিয়ে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করার কৌশল হয়, তাহলে মন্দের ভালো। তবে যদি এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স লেবাননে ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহদের কাছে অপদস্থ হয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যে গৌরব হারিয়েছিল তা পুনরুদ্ধার করার জন্য গাজাতে হামাস নির্মূল অভিযানে নামে, তবে ফিলিস্তিনিদের জন্য অবর্ণনীয় দুর্দশা অপেক্ষা করছে।

লেখক : সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও)

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ট্রাম্পের ইউক্রেসি বয়ান

    জিয়াউদ্দিন সাইমুম
শেয়ার
ট্রাম্পের ইউক্রেসি বয়ান

২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচন অনেক আমেরিকানের সামগ্রিক মানসিকতায় এক রূপান্তরমূলক পরিবর্তন তুলে ধরতে পেরেছে। কারণ ঐতিহ্যগতভাবে প্রচারণা সমাবেশে রিপাবলিকান প্রার্থীর নামই উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প মঞ্চে উপস্থিত হতেন, তখন জনতার স্লোগানটি ছিল : যুক্তরাষ্ট্র! যুক্তরাষ্ট্র! যুক্তরাষ্ট্র!

এই স্লোগানটির অর্থ কী? এর তাৎপর্য কী? গভীর হতাশা এবং আবেগপ্রবণ আশার শেষহীন দোলাচলে মানসিক উত্তেজনা থেকে স্লোগানটির জন্ম। ট্রাম্পপন্থীদের মতে, আমেরিকাকে আবার মহান করুন (MAGA) ধারণাটি কিছু লোকের কাছে রীতিমতো অভিশাপ, কিন্তু দেশপ্রেমিক আমেরিকানদের কাছে স্লোগানটি একটি জাতিকেন্দ্রিক সরকারের জন্য তাঁদের আকুলতার প্রতীক।

ট্রাম্প ও তাঁর আন্দোলন আমেরিকান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সমাপ্তির পাশাপাশি একটি নতুন ধরনের সরকার ব্যবস্থা সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাঁদের মতে, এই রূপান্তর কৌশলকে যথাযথভাবে দেশপ্রেমিক ইউক্রেসি হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে, যা সমসাময়িক আমেরিকান শাসনব্যবস্থায় প্রাচীন গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়ের একটি আধুনিক অনুবাদ।

তাঁদের মতে, এই নতুন ধারণাটির ভিত্তি হচ্ছে নিপাট দেশপ্রেম। তাত্ত্বিক দিক থেকে এটিই ইউক্রেটিক (গ্রিক বঁ থেকে উদ্ভূত, যার আভিধানিক অর্থ ভালো)।

কারণ এটি জনসাধারণের কল্যাণের ওপর কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার পক্ষে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, সত্যিকার অর্থে আমেরিকাকে আবার মহান করে তোলার সৃষ্টিশীল সমন্বিত প্রচেষ্টা। এই জাতিকেন্দ্রিক ইউক্রেসি একটি নতুন ধরনের কূটনীতির ভিত্তিও স্থাপন করে, যা ইউক্রেটিক কূটনীতি নামে পরিচিত। এই ধরনের কূটনীতির মূল সুর হচ্ছে জাতীয় স্বার্থকে মিত্রদের মধ্যে পারস্পরিক উপকারী সম্পর্কের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলার বৈশ্বিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথ রচনা করা।

এই ইউক্রেটিক মূল্যবোধের সম্ভাব্য পরিণতি আঁচ করতে পেরেই মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের মতো স্বৈরচারী দেশগুলো ট্রাম্প ও তাঁর চৌকস টিমকে নজিরবিহীন আগ্রহে স্বাগত জানাতে বাধ্য হয়েছে। মাথা ঘোরানো অঙ্কের অর্থনৈতিক ও সামরিক চুক্তি আর কল্পনাতীত দামি উপহার এই দেশগুলো ট্রাম্পের চরণে নিবেদন করতে বাধ্য হয়েছে। এই সফর ট্রাম্পের বহুল আকাঙ্ক্ষিত এমন একটি ইউক্রেটিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করেছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিকরা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার এবং একটি আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার দিকে মনোনিবেশ করতে পারে। চতুর ট্রাম্প সম্ভবত এটি আগেভাগেই স্থির করে ফেলতে পেরেছেন, তাঁর ইউক্রেটিক বিশ্ব গঠনের অর্থনৈতিক দিকটি তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবের দেশগুলো থেকে আদায় করে নিতে পারবেন।

ট্রাম্প উদ্ভাবিত ইউক্রেসি তত্ত্বের ভবিষ্যৎ আসলে কেমন হবে, তা এই গ্রহবাসী জানে না।

এর ভিত্তি তিনটি স্তম্ভের ওপর স্থাপিত১. দেশপ্রেম মানে জাতিকেন্দ্রিক শাসনএটি একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার, যা জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং তার নাগরিকদের মঙ্গলকে অগ্রাধিকার দেয়। ২. শক্তিশালী সুশাসন মানে যোগ্য ও নীতিগত নেতৃত্ব : ট্রাম্প ও তাঁর মিত্ররা এটিই আকাঙ্ক্ষা করেন। বিশ্লেষকদের মতে, এটি সিঙ্গাপুর ও ব্রুনেইয়ের মতো দেশগুলোর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদেরও একটি সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য। যদিও এসব দেশকে প্রায়ই কর্তৃত্ববাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তার পরও এই সরকারগুলোকে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক বা বর্তমান মায়ানমারের মতো নিপীড়ক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। পার্থক্যটি হলো উদ্দেশ্যএকটি জনসাধারণের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতা ব্যবহার করে; অন্যটি নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করার জন্য ক্ষমতা ব্যবহার করে। ৩. দূরদর্শী নেতৃত্ব মানে অগ্রগামী-চিন্তাশীল শাসনব্যবস্থা : একটি স্থবির সরকার অনিবার্যভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বিপরীতে, একটি দূরদর্শী সরকার পুনরুজ্জীবিত এবং বিকশিত হয়।

তাহলে ট্রাম্প কি গণতন্ত্রের অবসান টেনে আনছেন? হ্যাঁ, যদি প্রশ্নটি আমেরিকান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি ত্রুটিপূর্ণ সংস্করণের পতনের কথা উল্লেখ করে, তাহলে উত্তরটি ইতিবাচক হতে বাধ্য। কারণ মার্কিন সমাজব্যবস্থা এখন সীমাহীন উদাসীনতা, দৃষ্টিকটু পক্ষপাত এবং আদর্শিক চরমপন্থায় জর্জরিত, যা প্রগতিবাদের ছদ্মবেশে নিজেই নিজের ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যু করে দিচ্ছে, যা প্রায়ই সমাজের সবচেয়ে দুর্বলদের নিয়মিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ পন্থায় শোষণ করে যাচ্ছে।

কিন্তু ট্রাম্পের ইউক্রেটিক ভক্তরা পাল্টা বয়ান দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের দাবি ট্রাম্পের ইউক্রেটিক দর্শন আমেরিকাকে আবার মহান করে তোলার জন্য জনগণের ইচ্ছা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষয়কে নির্দেশ করছে। এটি মোটেও গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিপন্ন করছে না, বরং MAGA (Make America Great Again) এবং MAHA (Make America Honest Again) উদ্যোগের মাধ্যমে ট্রাম্প ও তাঁর মিত্ররা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছেন না, বরং রূপান্তর করছেন। তাঁরা শাসনের একটি নতুন রূপের সূচনা করছেন, যা কেতাবি নাম ইউক্রেসি। এটি জনগণের ভালোর জন্য, ভালো মানুষের দ্বারা পরিচালিত একটি সরকার।

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক

মন্তব্য

অমানুষের রাজনীতিতে কোনো স্থান নেই

    সাঈদ খান
শেয়ার
অমানুষের রাজনীতিতে কোনো স্থান নেই

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আজ এমন এক জটিল অবস্থায়, যেখানে নৈতিকতা ও মানুষের জন্য রাজনীতির জায়গা ক্রমেই সংকীর্ণ হচ্ছে। খুনি, ধর্ষক, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ আর দুর্নীতিবাজরা শুধু আইন-শৃঙ্খলা নয়, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও ধ্বংস করছে। নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, খুন, গুম, চাঁদাবাজি এবং নিরীহ মানুষের ওপর সন্ত্রাসএসব শুধু বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, এগুলো আমাদের সমাজকাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে ভেতর থেকে।

অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত শাস্তির নামে মব ভায়োলেন্স বা গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে চলেছে, যা ন্যায়বিচারের বদলে প্রতিশোধের সংস্কৃতি তৈরি করছে।

একটি সভ্য, মানবিক ও নিরাপদ সমাজ নির্মাণে এসব অপরাধ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আইন হাতে তুলে নেওয়া নয়, বরং আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সামাজিক সচেতনতাই হতে পারে টেকসই সমাধান। যে সমাজে দুর্বলরা নিরাপদ নয়, সেই সমাজ টিকে থাকতে পারে না।

রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভেতরে শুদ্ধি, জবাবদিহি ও নৈতিক নেতৃত্ব তৈরির প্রয়োজনীয়তা অবহেলা করলে এ দেশের রাজনীতি আরো নষ্ট হবে।

এই যে রাজনীতির ময়দানে অমানুষরা রাজত্ব করছে, সেটি রোধ করার জন্য আমাদের সতর্ক হতে হবে। খুনি কখনো কোনো দলের হতে পারে না। তার একমাত্র পরিচয় সে খুনি। রাজনীতির নামে যদি খুনকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তবে সেটি গণতন্ত্র নয়, ত্রাসের রাজত্ব।

আমরা অনেক সময় দেখি, অপরাধীদের আমাদের বা আপনাদের বলে ভাগ করে নেওয়া হয়। এতে নিরীহ মানুষ বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, অপরাধীরা পায় প্রশ্রয়। রাজনীতি কখনো পক্ষপাতের জায়গা হতে পারে না। অপরাধ ও অপরাধীকে দল-মতের ঊর্ধ্বে রেখে বিচার করতে না পারলে আমরা একটি বিভাজিত সমাজের দিকে ধেয়ে যাব। রাজনৈতিক দলগুলো যদি অপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের দল থেকে চিরতরে বহিষ্কারে ব্যর্থ হয়, তবে তারা জনগণের আস্থা হারাবে।

রাজনীতির দূষণ রোধ করা যাবে না। দলগুলো যদি নিজেদের ভেতর থেকে শুদ্ধ না হয়, তাহলে তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে নাঅর্থাৎ গণতন্ত্রের ভিত্তিই দুর্বল হবে।

দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, ডাকাত, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের আর কোনোভাবে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। যারা দলের নাম ব্যবহার করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে, জনস্বার্থ ত্যাগ করে নিজের আখের গুছিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে অতি দ্রুত দল থেকে চিরতরে বহিষ্কার করতে হবে। কারণ এসব চরিত্রই জনগণের আস্থা নষ্ট করে, রাজনীতিকে কলুষিত করে এবং রাষ্ট্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে। শুদ্ধি অভিযান হতে হবে সাহসিকতা ও নৈতিকতার সঙ্গে। কারণ রাজনৈতিক শুদ্ধি ছাড়া সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আমাদের উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে হবে, অমানুষের রাজনীতিতে কোনো স্থান নেই। যারা মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা ও গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাস করে না, তারা রাজনীতির নামে শুধু ক্ষমতা ও সন্ত্রাসের ব্যবসা করে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলেছেন, আওয়ামী লীগের মতো আচরণ করলে বিএনপিরও একই পরিণতি হবে। এটি কেবল বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়, এটি নিজের দলের প্রতি কঠোর আত্মসমালোচনা এবং নৈতিক শুদ্ধির আহবান। আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতা যে দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, দলীয়করণ আর অরাজকতা তৈরির ইতিহাস বিএনপি দেখেছে, সেটির পুনরাবৃত্তি হলে ফলাফল হবে একইজনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন, রাজনৈতিক সংকট গভীরতর। এই সতর্কতা অপরিহার্য। কারণ রাজনৈতিক শুদ্ধি ছাড়া একটি দল টিকে থাকতে পারে না।

রাজনীতিতে ভুল করেননি এমন কোনো রাজনৈতিক নেতা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে যাঁর ভুলের পরিমাণ যত কম, তিনি তত বেশি সফল। তাঁকে জনগণ তত বেশি ভালোবেসে মনে রেখেছে। আবার যে নেতা যত বেশি ভুল করেছেন, তিনি তত বেশি নিন্দিত হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশি নিন্দিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। তারেক রহমান পরিষ্কার করে বলেছেন, এখন কিন্তু মানুষ অনেক সচেতন। মানুষ আমাদের ওপর আস্থা রাখতে চাইছে, আমাদের ওপর অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ওপর। এই আস্থা যদি নষ্ট করার জন্য কেউ কোনো কাজ করে, তাহলে ভাই তাকে তো আমার পক্ষে টানা সম্ভব না। তাকে আমি টানব না। তাকে শেলটার আমি দেব না।

বিএনপির অর্জন ও অবদান ধুলায় মেশানোর অধিকার কারো নেইএ কথা স্পষ্ট। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়, অর্থনৈতিক সংস্কারে, নারীর ক্ষমতায়নে, মত প্রকাশের স্বাধীনতায়, গ্রামীণ উন্নয়নে বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। এই ইতিহাসকে ভুলে গেলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভিত্তি দুর্বল হবে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বকে দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে শুদ্ধি ও জবাবদিহির সংস্কৃতি প্র্রতিষ্ঠিত হয়।

শিক্ষাব্যবস্থা যখন মূল্যবোধহীন, সংস্কৃতি যখন ভোগবাদী আর সমাজ যখন লোভের পূজারি, তখন অপরাধীরা শুধু অপরাধ করে নানিয়ন্ত্রকও হয়ে ওঠে। তারা হয়ে ওঠে নেতা, ঠিকাদার, মালিক আর সাধারণ গরিব মানুষ হয় নির্যাতিত ও বঞ্চিত। বর্তমানে বাংলাদেশে অপরাধ বেড়েই চলেছে : ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাং, সিন্ডিকেট, মাদকসবই চলে রাষ্ট্রের ছায়ায়। সরকার নীরব, আইনি ব্যবস্থা ঘুমন্ত, জনগণ আতঙ্কে। এসব সংকটের প্রতিকার শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতায় সম্ভব নয়, প্রয়োজন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর গভীর সংস্কার।

সমাধান একটাইঅন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। ধনী-গরিবের ব্যবধান কমানো, সবার জন্য শিক্ষা, কাজ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হলো মূল চাবিকাঠি। রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তি আনতে হবে, যাতে মানবিকতা, নারীর মর্যাদা ও যুবসমাজের নৈতিকতা গড়ে ওঠে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো দেখিয়েছেসুশাসন থাকলে অপরাধ থাকে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা-ই প্রযোজ্য। তবে এর জন্য সবার আগে দরকার একটি নির্বাচিত সরকার।

বাংলাদেশে এক সুন্দর, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের। আমাদের একান্ত প্রত্যাশা হলো বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভেতর থেকে শুদ্ধ হবে, অপরাধীদের নির্মূল করবে এবং দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত নেতৃত্ব গড়ে তুলবে। অন্যথায় ইতিহাস তাদের কঠোর বিচার করবে।

রাজনীতি মানুষের জন্য মানবিকতা, ন্যায়বিচার, সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। এখানে খুনি, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, সন্ত্রাসী, অপরাধীদের ঠাঁই নেই। সময় এসেছে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করারঅমানুষের রাজনীতিতে কোনো স্থান নেই।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার একটি ভিন্ন বিষয়

    নিরঞ্জন রায়
শেয়ার
সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার একটি ভিন্ন বিষয়

সরকার সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার হ্রাস করেছে। ঋণের ওপর যে সুদের হার নির্ধারণ করা হয়, তার সঙ্গে ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হারের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের ওপর যে সুদের হার, তার সঙ্গে ব্যাংকঋণের ওপর সুদের হারের কোনো রকম প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। অনেকে বলে থাকেন যে সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও পরোক্ষ সম্পর্ক আছে।

অনেকে এমনও বলে থাকেন যে ব্যাংকে সুদের হার নির্ধারণে সঞ্চয়পত্রের সুদ একটি নির্ণয়ক হিসেবে কাজ করে। কথাটির মধ্যে আংশিক সত্যতা থাকলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানি মার্কেটে বিষয়টি সেভাবে কাজ করে না।

আমরা সবাই জানি যে ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে যে আমানত সংগ্রহ করে, তার একটি অংশ তারল্য রেখে বাকিটা ব্যবসায়ীদের মাঝে ঋণ হিসেবে বিতরণ করে। ব্যাংক আমানতকারীদের যে হারে সুদ দেয়, তার সঙ্গে পরিচালনা ব্যয়, ঝুঁকি গ্রহণের মূল্য এবং লভ্যাংশ বাবদ কিছু অংশ যোগ করে ঋণের ওপর সুদের হার নির্ধারণ করে।

এ কারণেই ব্যাংকে আমানতের ওপর সুদের হার বৃদ্ধি পেলে ঋণের ওপর সুদের হারও বেড়ে যায়। এর বিপরীতে ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস পেলে আমানতের ওপর সুদের হার কমে যায়। আবার ব্যাংকঋণ ও আমানত উভয়ের ওপর প্রদত্ত সুদের হার নির্ভর করে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ব্যাংক রেট বা নীতি সুদ হারের ওপর। এ কারণেই দেখা যায় যে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করে, তখন ব্যাংকের আমানত ও ঋণের ওপর সুদের হার হ্রাস পায়।
এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন তাদের নীতি সুদ হার বৃদ্ধি করে, তখন ব্যাংকের আমানত ও ঋণের ওপর সুদের হার বৃদ্ধি পায়।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/14-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgদেশের মুদ্রাবাজারের এই সমীকরণের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হারের কোনো রকম ভূমিকা নেই। এ কথা ঠিক যে দেশে সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদ বহাল থাকলে গ্রাহক কম সুদের হারে ব্যাংকে অর্থ জমা না রেখে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন। ফলে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ করতে বেশ সমস্যা হয় এবং তখন ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। এটি একটি ধারণা এবং খুবই অল্পসংখ্যক আমানতকারী এমনটি করতে পারেন।

বাস্তবতা হচ্ছে, সঞ্চয়পত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এবং স্বতন্ত্র একটি বিনিয়োগব্যবস্থা। যে অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয়, সেই অর্থ ব্যাংক আমানতে জমা হয় না। আবার ব্যাংক আমানত হিসেবে যে অর্থ জমা থাকবে, তা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ খুবই সীমিত। যে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম আছে, তার পরিমাণ এতটাই নগণ্য যে তা আর সমগ্র মুদ্রাবাজারে সুদের হার নির্ধারণে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।

সঞ্চয়পত্র এক বিশেষ ধরনের বিনিয়োগব্যবস্থা, যা বিক্রি করে সরকার অর্থ সংগ্রহ করে বাজেট ঘাটতি মেটানো এবং দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। আমাদের দেশে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে সরকারকে সব সময়ই জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। সঞ্চয়পত্র হচ্ছে খুব সহজে এই অর্থ সংগ্রহের একটি মাধ্যম। অপরপক্ষে আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেভাবে নেই। বেকারত্বের সংখ্যাও মাত্রাতিরিক্ত। এমনকি সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য চাকরিজীবীদের সে রকম অবসর ভাতার ব্যবস্থাও নেই। সমাজের এই শ্রেণির জনগোষ্ঠী মূলত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেই জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। ফলে সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার হ্রাস পেলে সাধারণ মানুষ, যাদের জীবনযাত্রা এই বিনিয়োগ থেকে অর্জিত সুদের ওপর নির্ভরশীল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

অবশ্য এ কথাও ঠিক যে সঞ্চয়পত্র যতই বিশেষায়িত বিনিয়োগব্যবস্থা হোক না কেন, সরকারকে অনেক উচ্চ হারে সুদ প্রদান করতে হয়, যা সরকারের রাজস্ব ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়। আপাতত এই বাড়তি সুদের বোঝা মেনে নিলেও ভবিষ্যতে কোনো এক সময় এই সুদের হার হ্রাস করতেই হবে। তবে সেই কাজটি করার আগে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রথমেই হরেক রকমের এবং বিভিন্ন ধাপের সঞ্চয়পত্র বাতিল করে খুবই সাধারণভাবে তিন ধরনের সঞ্চয়পত্রের প্রচলন করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সঞ্চয়পত্র এবং বিভিন্ন মেয়াদের বন্ড বিক্রি করে সরকারের অর্থ সংগ্রহের জন্য দেশে পৃথক সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট চালু করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, কোন ধরনের সঞ্চয়পত্র সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে লেনদেন করা যাবে আর কোন ধরনের সঞ্চয়পত্র যাবে না, তা নির্ধারণ করা থাকবে, যাতে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল সাধারণ জনগোষ্ঠী সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে লেনদেনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

বিষয়টি একটু জটিল মনে হতে পারে বিধায় একটি কাল্পনিক উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে তিন ধরনের সঞ্চয়পত্র চালু করা হলো, সেগুলো হতে পারে এ, বি ও সি সিরিজের সঞ্চয়পত্র। এ সিরিজের সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ ক্রয়সীমা হবে ২৫ লাখ টাকা, যার ওপর সর্বাধিক হারে সুদ অর্থাৎ ১৩ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করা যেতে পারে। এই ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হবে তাঁদের কাছে, যাঁদের নিয়মিত উপার্জন নেই বা উপার্জনের পরিমাণ খুবই নগণ্য। এ সিরিজের সঞ্চয়পত্র কোনো অবস্থায়ই সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে লেনদেন করা যাবে না। বর্তমান ব্যবস্থার মতোই মেয়াদপূর্তির আগে ভাঙানোর সুযোগ থাকবে। 

বি সিরিজের সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার তুলনামূলক কম হবে, যা হতে পারে ১০ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। যাঁরা এ সিরিজের সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার উপযুক্ত হবেন না, কিন্তু তাঁদেরও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে, তাঁরাই এই বি সিরিজের সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন। এই সঞ্চয়পত্র সেকেন্ডারি মার্কেটে শর্তযুক্ত লেনদেনের সুযোগ থাকবে।

সি সিরিজের সঞ্চয়পত্র হবে খুবই সাধারণ মানের বিনিয়োগব্যাবস্থা, যেখানে সুদের হার হবে অনেক কম, যা ৬ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এই সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো রকম সীমারেখা থাকবে না। যে কেউ চাইলে যেকোনো পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবেন এই ধরনের সঞ্চয়পত্রে। সি সিরিজের সঞ্চয়পত্র স্বাভাবিকভাবে লেনদেন করা যাবে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে। যেহেতু সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটে নিয়মিত লেনদেনের কারণে এই ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের কিছু অতিরিক্ত লাভের সুযোগ থাকবে, তাই সুদের হার কম হওয়া সত্ত্বেও মানুষ এখানে বিনিয়োগ করবে।

এভাবে পুরো সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন এই বিনিয়োগ সুবিধাকে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে টেকসই রূপ দিতে পারবে, অন্যদিকে তেমনি সঞ্চয়পত্রে গড় সুদের হার উল্লেখযোগ্য কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে। তবে এই ব্যবস্থা সফল করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দেশে একটি সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট চালু করা। উল্লেখ্য, দেশে কার্যকর মুদ্রাবাজারের স্বার্থে অনেক আগেই একটি সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট চালু করা উচিত ছিল, কিন্তু সেটি হয়নি। তাই আর দেরি না করে অনতিবিলম্বে স্বতন্ত্র একটি সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। আর বন্ড মার্কেট প্রতিষ্ঠাসহ পুরো সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কাজটি যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পন্ন না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রকে একটি বিশেষ বিনিয়োগব্যবস্থা হিসেবে রাখা প্রয়োজন। যেহেতু সঞ্চয়পত্র সামাজিক নিরাপত্তার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে, তাই এই খাতে সুদের হার হ্রাস করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

Nironjankumar_roy@yahoo.com

মন্তব্য

বিদেশে বাংলাদেশিদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া

    আবু তাহের খান
শেয়ার
বিদেশে বাংলাদেশিদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া

সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে মালয়েশীয় পুলিশ ৩৬ জন বাংলাদেশিকে আটক করেছে। মালয়েশিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ এর আগেও উঠেছে এবং সেসব কারণে অতীতে বহু বাংলাদেশিকে দেশে ফেরতও পাঠানো হয়েছে। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর তো মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়াই প্রায় বন্ধ রেখেছিল।

বাংলাদেশি লোকজন শুধু যে মালয়েশিয়ায় গিয়েই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে তা-ই নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার অপরাপর দেশে গিয়েও তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে বা সে ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।

তবে অন্যান্য দেশে গিয়ে ঘটানো অপরাধ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হুবহু মালয়েশিয়ার অনুরূপ নয়। অন্যান্য দেশে গিয়ে তারা হয় ভিসার মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও সেখানে অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করে অথবা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য দেশেও তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এসব অপরাধ সাম্প্রতিক সময়ে এতটাই বেড়ে গেছে যে অনেক দেশ বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে কিংবা তা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।

চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশিরা আগে খুব সহজেই ভিসা পেয়ে যেতেন। কিন্তু তা এখন এতটাই কড়াকড়ি করা হয়েছে যে বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশির ভিসা আবেদন এখন নিয়মিতই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস এখন বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদান অনেকটা বন্ধই করে দিয়েছে এই অভিযোগে যে ভিসার মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও বহু বাংলাদেশি ওই সব দেশ ছাড়ছেন না কিংবা সেসব দেশে থেকেই অন্যবিধ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। ফলে পর্যটক ভিসায় সেসব দেশে যাওয়া এখন প্রায় বন্ধ।

প্রায় একই অবস্থা এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রেও। সেসব দেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের ভিসা পাওয়া আগে এতটাই সহজ ছিল যে পর্যটন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেসব দেশে পর্যটক পাঠানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হন্যে হয়ে বিজ্ঞাপন দিত। কিন্তু উজবেকিস্তান, কাজাখস্তানসহ সেই দেশগুলোও এখন বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে চায় না। বাংলাদেশিদের প্রতি মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু যে পর্যটকদের জন্যই দুঃসংবাদ তা-ই নয়, বরং এর সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে যাচ্ছে ওই সব দেশে বাংলাদেশি পণ্যের যে বিপুল বাজার-সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তার ওপর। আগে দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় কোনো দেশেই বাংলাদেশিরা তেমন একটা যেতে চাইতেন না।

এখন আফ্রিকার দেশগুলোও বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের ছয় দেশ তো এরই মধ্যে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ভিসা প্রদান পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। সেটি আবার কবে চালু হবে, কেউ তা জানে না, এমনকি যারা ভিসা দেবে, তারাও না।

অন্যদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা পাওয়া অনেক আগে থেকেই কঠিন। গত ৪ জুন ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানের বিষয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা শুধু আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরই পরপন্থী নয়, জাতিগত অপমানেরও এক লিখিত ভাষ্য। সেখানে তারা বাংলাদেশি ভিসাপ্রার্থী নাগরিকদের উদ্দেশে লিখেছে, যদি কর্মকর্তাদের মনে হয়, কারো যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য সেখানে সন্তান জন্ম দিয়ে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা, তবে তার পর্যটন ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে। কী আশ্চর্য বাক্যাচার!

বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের এই যে ক্রমবর্ধমান হারে নানা জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং অন্য নানাবিধ অপরাধ ও আইন ভঙ্গের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, এর প্রতিকার কী? এর প্রতিকার আইন করে বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মানসিকভাবে প্রণোদিত করে সাধন করা সম্ভব নয়। আসলে এটি একটি জাতিগোষ্ঠী ও সমাজের নানা আচার-আচরণ ও মূল্যবোধের দীর্ঘকালীন চর্চারই ক্রমরূপান্তরজনিত ফলাফল। দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষের মধ্যে যে সুউচ্চ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের পরিচালকরা সেটি ধরে রাখতে তো পারেনইনি, বরং দিনে দিনে তার আরো অধঃপতন ঘটিয়েছেন। ফলে এ সময়ের মধ্যে এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দেশের ভেতরে বা বাইরে যখন যেখানেই গেছে, সেখানেই তারা নিজেদের মর্যাদাপূর্ণভাবে তুলে ধরার পরিবর্তে আরো নানাবিধ অপরাধী আচরণ ও চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছে, যা বস্তুত একাত্তরের মূল্যবোধ ও ভাবমূর্তিকে ধরে রাখতে না পারারই ফল।

অন্যদিকে দেশ, রাষ্ট্র ও সমাজ বর্তমানে যে ধারায় এগোচ্ছে, তাতে দেশ-বিদেশের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এ দেশের নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান হারে জড়িয়ে পড়া থেকে শিগগির পরিত্রাণ মিলবে বলে তো মনে হচ্ছে না। তার পরও একটি ছোট্ট সাময়িক প্রস্তাব : বিদেশের বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো যদি কাগুজে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে মমতা ও আন্তরিক দায়বোধ নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে তাঁদের ওই ক্ষুদ্র অপরাধী অংশের অধঃপতনশীল আচরণ বহুলাংশেই সীমিত হয়ে আসবে বলে আশা করা যায়।

 

লেখক : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)

শিল্প মন্ত্রণালয়

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ