ঢাকা, বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫
৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫
৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ মহররম ১৪৪৭

ছাত্র আন্দোলন, মধ্য ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ : কারাগারে কিছুদিন

  • সাইফুল হাসান চৌধুরী
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
ছাত্র আন্দোলন, মধ্য ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ : কারাগারে কিছুদিন

সবার হয়তো স্মরণে আছে, ৩৯ বছর আগে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর ওই বছরের শেষ দিকে ১৪টি প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন একত্র হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করলে স্তিমিত হয়ে পড়া ছাত্ররাজনীতি আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এ সময় সংগ্রাম পরিষদ তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. আব্দুল মজিদ খান প্রণীত শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করে এটি বাতিলসহ বন্দি ছাত্রদের মুক্তি, দমননীতি বন্ধ এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে।

১৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হতে থাকে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র।

কলেজজীবনে ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলাম। উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নকালে আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলাম। ফলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঘেরাও কর্মসূচিতে শিকড়ের টানে যুক্ত হয়ে গেলাম। সকাল ১১টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাত্রসমুদ্রে পরিণত হয়।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় সচিবালয়ের দিকে। কার্জন হল পার হয়ে শিক্ষা ভবনের কাছাকাছি যেতেই মিছিলটি পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়। ছাত্ররা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই শুরু হয় লাঠিপেটা। ছাত্ররাও পুলিশের দিকে পাল্টা ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করলে কিছুক্ষণের মধ্যে সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করে।
লাঠিপেটা করে যখন ছাত্রদের ঠেকানো যাচ্ছিল না, তখন পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়তে শুরু করে। এতেও ছাত্ররা দমে না গিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ আরো মারমুখী হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এরই মধ্যে প্রচুর ছাত্রের হতাহত হওয়ার খবর ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করে। দুপুর নাগাদ ছাত্ররা ঢাকা মেডিক্যাল থেকে পুলিশের গুলিতে নিহত একজন ছাত্রের লাশ (জাফর অথবা জয়নালের) ক্যাম্পাসে নিয়ে আসে। বিকেলে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দাঁড়িয়ে ডাকসুর তৎকালীন সহসভাপতি আক্তারুজ্জামান তাঁর বক্তৃতায় ‘আমরা এ লাশ নিয়ে মিছিল করে বায়তুল মোকাররমে যাব, পথে যদি কোনো বাধা আসে, তবে আমরা তার দাঁতভাঙা জবাব দেব’ বলার পরপরই একটি গুঞ্জন শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি পুলিশের এক বিরাট গাড়িবহর কলা ভবনের দিকে এগিয়ে আসছে।
তখন সেখানে অবস্থান অনিরাপদ মনে করে দ্রুত কলা ভবনে ঢুকলাম। ভাবলাম, আমার ডিপার্টমেন্টে যেতে পারলে মোটামুটি নিরাপদ। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে কলাপসিবল গেটটি বন্ধ পেলাম। নিরুপায় হয়ে বাইরে বেরোতে গিয়ে দেখি কলা ভবন এলাকা পুলিশে ছেয়ে গেছে। বিকল্প চিন্তায় কলা ভবনের সামনের অংশে অবস্থিত কলা অনুষদের ডিন অফিসের একটি কক্ষে ঢুকে পড়লাম। এর মধ্যে পুলিশও ওই কক্ষে ঢুকে সেখানে বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে। লাঠির আঘাতে নিমিষে কয়েকজন ছাত্রকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম। উপায়ান্তর না দেখে আমি কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এলাম; কিন্তু ততক্ষণে পিঠে, মুখে এবং পায়ে কয়েক ঘা পড়ে গিয়েছে। পার্শ্ববর্তী ‘মলে’ যাওয়ার গেটও ততক্ষণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশে পরিপূর্ণ কলা ভবন এলাকায় কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করে এক পর্যায়ে ‘মল’ সংলগ্ন প্রায় চার-পাঁচ ফুট উঁচু দেয়ালের ওপর উঠে গেলাম। ভেবেছিলাম দেয়ালের ওপারে যেতে পারলে অনায়াসে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া যাবে। কিন্তু দেয়ালের ওপর উঠে মনে হলো, ঢাকার সব পুলিশ ওপারে যেন সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। খামাখা দৌড়াদৌড়ি করে শক্তি অপচয় না করাই বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনা করে দেয়াল থেকে নেমে পড়লাম। একজন পুলিশ কর্মকর্তা দৌড়ে এসে আমাকে পাকড়াও করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে উঠিয়ে দিল।

বাসের ভেতরে থাকা একজন প্রবীণ কনস্টেবল আমাকে একনজর দেখে হাত ঘড়িটি খুলে পকেটে রাখতে বললেন। এই অপ্রত্যাশিত নির্দেশে ভ্যাবাচেকা খেয়ে ঘড়িটি খুলে পকেটে রাখলাম। খানিক বাদে বাস থেকে নামিয়ে পাশে থাকা একটি পিকআপে তোলা হলো। পিকআপে বসে দেখলাম আমার পাশেই বসে আছেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক খ ম জাহাঙ্গীর (পরবর্তী সময়ে প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন)। একজন বড় ছাত্রনেতাকে পাশে পেয়ে মনে একটু জোর পেলাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো রমনা থানায়। সন্ধ্যার পর থানায় যারা আসছিল তাদের বেশির ভাগই রক্তাক্ত অবস্থায় ছিল। জানতে পারলাম গ্রেপ্তারকৃতদের অনেকেরই মানিব্যাগ, হাতঘড়ি খোয়া গেছে। তখন আমি বুঝতে পারলাম কেন আমাকে ওই প্রবীণ পুলিশ সদস্য ঘড়ি পকেটে ঢোকাতে বলেছিলেন। রাতে থানা থেকে ভাত-ডাল দেওয়া হলো। মাঝরাতে খ ম জাহাঙ্গীরকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। এ সময় বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। রমনা থানার দুটি কক্ষে গাদাগাদি করে শখানেক ছাত্রকে রাখা হয়েছিল। রাতে শোয়া দূরের কথা, পা মেলে বসার মতো জায়গাও ছিল না।

পরদিন দুপুরে থানা থেকে খাবার দেওয়া হলে কক্ষসংলগ্ন টয়লেটের দুরবস্থা দেখে সেটি না খাওয়াই সমীচীন বিবেচনা করলাম। এভাবে থানায় দুটি দিন কেটে যায়। ১৭ তারিখ সকালে আমাদের নেওয়া হয় কোর্টে। সেখান থেকে কমবেশি ৭০ জন ছাত্রকে দুপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নাজিমউদ্দিন রোডস্থ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ছাত্রদের বেশির ভাগই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। বুয়েটের একজনসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও কিছু ছাত্র ছিল। কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার পর অন্তত সেখানকার ‘খোলামেলা’ পরিবেশ আমাদের কিছুটা ভালো লাগল। দুপুরে ডাল-রুটি খেতে দেওয়া হলো। বিকেলে কারাগারের ‘৫ খাতার’ নিচের তলার পাশাপাশি দুটি ওয়ার্ডে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। শুনেছি, জেলখানার প্রতিটি বিল্ডিংয়ের জন্য একটি করে খাতা (রেজিস্টার) মেইনটেন করা হয়। বিল্ডিংগুলোর নামও খাতার নামানুসারে নির্ধারিত হয়। তাই ৫ নম্বর বিল্ডিংয়ের নাম ‘৫ খাতা’। জনপ্রতি তিনটি করে কম্বল, একটি অ্যালুমিনিয়ামের থালা এবং একটি বাটি দেওয়া হলো। তিনটি কম্বলের একটি ফ্লোরে বিছানোর জন্য, একটি ভাঁজ করে বালিশের মতো ব্যবহারের জন্য এবং অপরটি গায়ে দেওয়ার জন্য। কারাগারে একটি কথা চালু আছে, ‘থালা বাটি কম্বল—জেলখানার সম্বল।’ সন্ধ্যায় জেল হাসপাতালের ডাক্তার এলেন। গ্রেপ্তারকৃত সব ছাত্রই কমবেশি আহত ছিল। হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি দেখিয়ে ওয়ার্ডেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হলো এবং এই ব্যবস্থা এক সপ্তাহ কার্যকর থাকবে বলে জানানো হলো। আমাদের জন্য মেডিক্যাল ডায়েট হিসেবে সকালে দুধ-পাউরুটি, দুপুরে সবজি-ভাত-ডাল, বিকেল ৩টায় ডিম-চা এবং ৫টায় ভাতের সঙ্গে মাছ অথবা মাংস বরাদ্দ ছিল। সন্ধ্যার আগে বন্দিদের লকআপে যাওয়ার নিয়ম থাকায় রাতের খাবার বিকেলেই পরিবেশন করা হতো।

কারাগারে প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সামনে প্রশস্ত আঙিনা ছিল, যেখানে বন্দিরা সন্ধ্যায় লকআপে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে পারত। আঙিনার এক প্রান্তে ছিল গোসল করার জায়গা। সেটি অদ্ভুত ধরনের। আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ ফুট লম্বা একটি প্ল্যাটফর্মের দুই পাশে থাকা চ্যানেলের এক প্রান্ত থেকে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে পানি ছাড়া হতো। কারাবাসীরা চ্যানেলের পাশে লাইন ধরে বসে এই পানিতে গোসল করত। এখন কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত কেন্দ্রীয় কারাগারে নিশ্চয় উন্নততর ব্যবস্থার সংযোজন হয়েছে।

কারাগারে আমরা সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো দিকে কলম দিয়ে এঁকে কার্ড বানিয়ে ‘স্পেড ট্রাম্প’ খেলতাম। বিকেলে প্যান্ট-শার্ট পরে আঙিনায় হাঁটতাম। এ সময় কারাগারসংলগ্ন ব্যস্ত নাজিমউদ্দিন রোডের গাড়ির হর্ন, রিকশার ঘণ্টা, মানুষের কোলাহল শুনে এবং আশপাশের ভবনের ছাদে নারী-পুরুষের বৈকালিক পদচারণ দেখে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। কারারক্ষীরা কারাবন্দিদের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার জন্য দিনে একাধিকবার বন্দিদের আঙিনায় এনে লাইনে বসিয়ে গুনে দেখত। এটিকে বলা হতো ‘গুনতি’। সকাল ৬টায় যে গণনা হতো তাকে বলা হতো ৬-এর গুনতি। এভাবে ৯-এর গুনতি, ১২-এর গুনতি এবং অন্যান্য সময়ের গুনতি হতো। আমাদের অবশ্য কারারক্ষীরা ওয়ার্ডে গিয়ে গুনে আসত। ১৯৮৩ সালের এই গুনতি পদ্ধতি এখনো বহাল আছে কি না, জানি না। ওয়ার্ডে আমাদের দেখাশোনা করার জন্য কয়েকজন পুরনো কয়েদি নিয়োজিত ছিল, যাদের ‘মেট’ বলে ডাকা হতো। মেটদের কাছ থেকে কারাগারের নানা গল্প শুনতাম।

পুরনো কারাবন্দিদের কারো কারো কাছে রেডিও ছিল। আমরা বিবিসি, ভোয়া শুনতাম। মধ্য ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং হুলিয়া, গ্রেপ্তার, নির্যাতনের মাধ্যমে এর বিস্তার প্রতিহত করা হচ্ছিল, সে খবর আমরা বিদেশি গণমাধ্যমের সাহায্যে জানতাম। এরই মধ্যে আমরা কারাগারের পরিবেশের সঙ্গে মোটামুটি খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যে সম্ভাব্য সাজার দুশ্চিন্তা মনকে দুর্বল করে ফেললেও কৃতকর্মের জন্য একটা পুলক অনুভূত হতো।

দেখতে দেখতে আরো কটা দিন কেটে গেল। দিনটি ছিল ৮ মার্চ ১৯৮৩। সন্ধ্যার পর একজন কারা কর্মকর্তা এসে আমাদের মধ্যে ২০ জনের একটি তালিকা পাঠ করে লকআপ থেকে বেরিয়ে আসতে বললেন। কানাঘুষা শোনা গেল, আমাদের সম্ভবত ঢাকার বাইরে কোনো কারাগারে স্থানান্তর করা হতে পারে। এক অজানা আশঙ্কায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল। এ সময়টায় কারাগারের এক কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে গল্প করে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

আনুমানিক রাত ৯টা নাগাদ সব আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে আমাদের মুক্তির বারতা এসে পৌঁছাল। কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে গচ্ছিত আমার কিছু টাকা এবং ঘড়ি ফেরত নিয়ে (এগুলো কর্তৃপক্ষ কারাগারে ঢোকার সময় তাদের জিম্মায় রেখেছিল) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের লৌহ কপাট দিয়ে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন এক অনাবিল আনন্দে মনটা নেচে উঠল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নিলাম। ঘড়িতে তখন রাত ১১টা। কালক্ষেপণ না করে একজন কারাসঙ্গীসহ দ্রুত রিকশায় চেপে বসলাম। আজ রাতে নিকটবর্তী কোনো আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিতে হবে। হাতে বেশি সময় নেই। রাত ১২টা থেকে আবার কারফিউ শুরু হবে।

লেখক : পরিচালক (জনসংযোগ), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

অকাতরে কেটে যাচ্ছি গাছ, লাগাচ্ছি কয়টি

    এমরান কবির
শেয়ার
অকাতরে কেটে যাচ্ছি গাছ, লাগাচ্ছি কয়টি

সারা দেশে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে, যেন গাছ কাটার মহোৎসব চলছে। সম্প্রতি যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা জেনে কোনো বিবেকবান মানুষের মাথা ঠিক থাকার কথা নয়।

বেসরকারি সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)-এর গাছ কাটাবিষয়ক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের মার্চ থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত দেশে সরকারি প্রকল্পে প্রায় ১৩ লাখ গাছ কাটা পড়েছে। এই হিসাবটি স্রেফ সংবাদপত্রের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।

আরডিআরসির লগিং অব প্লান্টস ইন বাংলাদেশ (২০২৪-২৫) শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি প্রকল্পে প্রায় এক লাখ ৮২ হাজার গাছ কাটা হয়েছে। আগের বছরে একই গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত কাটা হয়েছে সাড়ে ১১ লাখ গাছ। গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে খুলনা জেলায়, ৮৫ হাজারের ওপরে। এর বাইরে অভাবে পড়ে, চুরি করে, বাড়ি করতে গিয়ে, রাস্তা বানাতে, কারখানা বা অফিস স্থাপন করতে, এমনকি শত্রুতা করেও অনেক গাছ কাটা হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রাকৃতিক কারণে, যেমন ঝড়ের কবলে পড়ে এবং খরায়ও প্রচুর গাছ ধ্বংস হয় বা মারা যায়।

এই গণহত্যার প্রধান রাজা হলো খোদ সরকারি সংস্থা। আরডিআরসির  সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে গাছ কাটায় এক্সপার্ট হিসেবে যে সংস্থাগুলোর নাম উঠে এসেছে সেগুলো হলো সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বন বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা মৎস্য কার্যালয়, রাজশাহী জেলা পরিষদ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, যশোর জেলা পরিষদ,  মেহেরপুর জেলা পরিষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট।

গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫০ বছর বেঁচে থাকা একটা গাছ জীবন রক্ষাকারী যে অক্সিজেন দেয় তার মূল্য ২৫ লাখ টাকা, বায়ুদূষণ থেকে রক্ষায় ১০ লাখ টাকা, বৃষ্টি ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে বাঁচায় পাঁচ লাখ টাকা, মাটির ক্ষয়রোধ ও উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে বাঁচায় পাঁচ লাখ টাকা, বৃক্ষে বসবাসকারী প্রাণীদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে বাঁচায় পাঁচ লাখ টাকা, আসবাব, জ্বালানি কাঠ ও ফল সরবরাহ করে পাঁচ লাখ টাকা, বিভিন্ন জীবজন্তুর খাদ্য জোগান দিয়ে বাঁচায় আরো ৪০ হাজার টাকা।

তাহলে একটি বৃক্ষের আর্থিক সুবিধার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ রকম কোনো উপকার প্রদানকারীকে পরিণত বয়সের আগেই কি খুন বলা যায় না?

কেউ কেউ বলবেন, বৃহত্তর স্বার্থে এমন কিছু কাজ সম্পন্ন করতে হয়, যেখানে গাছ না কেটে উপায় থাকে না। মানলাম সে যুক্তি। কিন্তু এখানে কয়েকটি বিষয় কি বিবেচনা আনা যায় না? যেমন গাছ না কেটে যতদূর সম্ভব প্রকল্প ডিজাইন করা যায় না? যদি কাটতেই হয়, তাহলে ন্যূনতম পর্যায়ে কেটে করা যায় না? গাছ যদি বিশেষ প্রয়োজনে কাটতেই হয়, তাহলে হিসাব করে এর সমসংখ্যায় গাছ কি লাগানো যায় না?

২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভা বৈঠকে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন আইন ২০২১-এর খসড়া অনুমোদনের সময় ব্যক্তিমালিকানায় থাকা গাছ কাটতে অনুমতির বিধান রাখা হয়। সেই বৈঠক শেষে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, যাঁরা সাধারণ বাগান করবেন বা স্থায়ী যে গাছ লাগাবেন সেগুলোও তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামতো কাটতে পারবেন না।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এ রকম আইন বা নিয়ম আছে। আমার বাড়িতে একটি গাছ পড়ে গেছে, এটা আমি সিটি করপোরেশন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কাটতে পারব না।

এরপর হাইকোর্ট এক রায়ে বলেন, অনুমতি ছাড়া গাছ কাটা যাবে না, গাছ কাটার আগে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। এর পরও গাছ কাটা বা খুন করা থেমে নেই।

হাদিস শরিফে আছে, যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটা গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে। (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ, মুসনাদে আহমাদ)।

জন্মের সময় এই পৃথিবীকে যেমন পেয়েছিলাম, মৃত্যুর আগে যেন তার চেয়ে একটু ভালোর দিকে এগিয়ে দিতে পারি। একজন মানুষের ন্যূনতম কর্তব্য এটি। এটার জন্য জীবন দিতে হবে না। আমরা যদি বছরে একটি করে গাছ লাগাই ও পরিচর্যা করি, তাহলে প্রতিবছর লাগানো গাছের সংখ্যা হবে সতেরো কোটির বেশি। আরেক ফাগুনে তা দ্বিগুণ হবে।

আমরা তো কথা লাগাই। ক্যাচাল লাগাই। মারামারি লাগাই। ফেসবুকে লাগানো নিয়ে আদিরসাত্মক কৌতুকে মেতে উঠি। কিন্তু আসল কাজ করি না। তাই আসুন, এই মৌসুম থেকেই শুরু করি।

প্রতিবছর অন্তত একটি করে গাছ লাগাই ও পরিচর্যা করি।

 

লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

মন্তব্য

এই সহিংসতার শেষ কোথায়

    মিজানুর রহমান
শেয়ার
এই সহিংসতার শেষ কোথায়

১ জুলাই থেকে সারা দেশে এনসিপি পদযাত্রা শুরু করেছে। এটা তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি। একটি দল যখন কোনো  সমাবেশ  ঘোষণা করে সেখানে রাষ্ট্রের অনুমতি নিতে হয়। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখা।

তেমনিভাবে গোপালগঞ্জের কর্মসূচিতে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর। তাই গোপালগঞ্জে সংঘাতের যে ঘটনা ঘটেছে তা জাতির সামনে এখন তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় জনগণ উদ্বিগ্ন। ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন এক ব্যবসায়ী।

এ ধরনের হামলা, খুন ও ধর্ষণের ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে। বিএনপিসহ কিছু দল সরকারের বিরুদ্ধে মবকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলছে। খুলনায় যুবদলের এক নেতাকে গুলি করার পর পায়ের রগ কেটে হত্যা নিশ্চিত করা হয়েছে। চাঁদপুরে মসজিদের ভেতরে ইমামকে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছে।
চাঁদাবাজির বহু ঘটনা ঘটছে। পুলিশ নির্বিকার। এর আগে মার্চ মাসে মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলায় আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে মসজিদের ভেতর কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। কুমিল্লার মুরাদনগরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক পরিবারের তিনজনকে খুন করা হলো। মুরাদনগরে প্রবাসীর স্ত্রী ধর্ষণের শিকার হন এবং ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

গোপালগঞ্জের ঘটনায় কী দেখা গেছে। সকালে এনসিপি নেতারা গাড়িবহর নিয়ে শহরে ঢোকার আগেই পুলিশের গাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল। গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলো, ইউএনওর গাড়িতে হামলাও হলো। প্রশাসন কী করেছে? এসবের মধ্যেই দুপুর দেড়টার দিকে নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে এসে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্ক এলাকায় সমাবেশস্থলে হামলা চালায়। ব্যাপক ক্ষতিসাধনও করে। নেতারা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে পুলিশি নিরাপত্তায় টেকেরহাট হয়ে মাদারীপুরে যাওয়ার পথে বেলা পৌনে ৩টার দিকে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে ফের হামলা হয়। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকর্মীদের সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

এ পরিস্থিতিতে এনসিপির কেন্দ্রীয়  নেতারা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। পরে তাঁরা সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে পুলিশ সুপারের কার্যালয় ছাড়েন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় বুধবার রাত ৮টা থেকে পরবর্তী দিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২২ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়।

পুলিশ কেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? কেন পদে পদে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে? এর প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার, জনবলের অভাব, প্রশিক্ষণের অভাব এবং পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার অভাবও এ ক্ষেত্রে দায়ী হতে পারে। আমরা জানি, অতীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে পুলিশের কাজ ব্যাহত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কথামতো পুলিশ কাজ করেছে। যার ফলে পুলিশের নিরপেক্ষতা নষ্ট হয় এবং তারা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে তখন ব্যর্থ হয়। তা ছাড়া পুলিশের জনবলের ঘাটতি তো আছেই। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুলিশে দ্রুত জনবল নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু নিয়োগ দিলে হবে না, যথাযথ  প্রশিক্ষণ, রসদ-সরঞ্জামে পুলিশ বাহিনীকে সক্ষম করে তুলতে হবে। এটা স্বীকার করতেই হবে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে পুলিশের রসদ-সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, গাড়ি ধ্বংস হয়েছে। এখনো হয়তো তারা এগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যদি কাটিয়ে উঠতে না পারে তখন সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক।

বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময় পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এরা দলীয় লোক নিয়োগ দিয়ে তাদের অনুগত বানিয়ে নেতারা অনেক অপকর্ম করেছেন। এর খেসারত এখন জাতিকে পোহাতে হচ্ছে। পুলিশ জনগণের বন্ধু হওয়ার কথা ছিল। পুলিশ এখনো কিন্তু জনগণের বন্ধু হতে পারিনি। তা পারলে সহিংসতা প্রতিরোধে জনগণই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। সেটা এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে  না। তা ছাড়া আইন প্রয়োগের দুর্বলতাও আছে। বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা পীড়াদায়ক। অনেক সময় দোষীরা পার পেয়ে যায়। দীর্ঘদিনের এসব সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে পুলিশ বাহিনীকে গড়ে তুলতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। সংস্কারের জন্য অনেক সুপারিশ এসেছে। এগুলো পর্যালোচনা করে বাস্তবায়ন করা দরকার। দলমত-নির্বিশেষে সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে সবার আগে পুলিশ সংস্কারের কাজটিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে পুলিশ জনগণের বন্ধু হতে বাধ্য। বিষয়টি এখন খুবই স্পষ্ট হচ্ছে, পুলিশের এ রকম দুর্বলতা নিয়ে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।

 লেখক : সাবেক ব্যাংকার ও কলামিস্ট

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

দায়িত্ব ও মানবিকতার ঘোরতর বিপর্যয়

    কামরুল হাসান
শেয়ার
দায়িত্ব ও মানবিকতার ঘোরতর বিপর্যয়

যে বাতাসে পাখির পালকও ভেসে থাকতে পারে না, সেই বাতাসে কী করে হাজার টন ওজনের বিমান ভেসে থাকে তা বিজ্ঞানের এক বিস্ময়! জাহাজে বিপর্যয় ঘটলে নিকটবর্তী জল আছে, সড়কের যানের জন্য রয়েছে মাটি, কিন্তু বিমানের জন্য কিছু নেই। একটি বিমানকে তাই সর্বোচ্চ যত্ন ও দক্ষতা দিয়ে তৈরি করা হয়। যানবাহনে Factor of Safety বলে একটা নিরাপত্তা সূচক আছে। একটি গাড়ির ফ্যাক্টর অব সেফটি ১ হলে একটি বিমানের তা ১০।

অর্থাৎ একটি বিমান একটি গাড়ির চেয়ে ১০ গুণ নিরাপদ। এই নিরাপত্তা আসে ডিজাইন ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে এবং নিখুঁতভাবে মেরামত ও সংরক্ষণ করে। বিমানের প্রতিটি যন্ত্রাংশ সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে তৈরি করা হয় এবং তাদের প্রতিটির একটি খরচ আছে, যা উড্ডয়ন ঘণ্টার হিসেবে মেইনটেন করা হয়। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (ICAO) এসব ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে রেখেছে এবং তা পালনে বাধ্যবাধকতা আছে।
এসব মেনে চলে বলেই প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর আকাশে যে বাহনটির উড্ডয়ন সংখ্যা ৯০ হাজার থেকে এক লক্ষ, তার কয়টি বিমান দুর্ঘটনার কথা আমরা শুনি?

বিমান দুর্ঘটনা ঘটবে যদি কোথাও ঘাটতি থেকে যায়। সে ঘাটতি হতে পারে পাইলটের দক্ষতার কিংবা বিমানের ওড়ার সামর্থ্যের। যে বিমানটি গত সোমবার দুপুরে এক অচিন্তনীয় দুর্ঘটনা ঘটাল, আছড়ে পড়ল একটি ছাত্রগিজগিজ বিদ্যালয়ের ওপর, ঢুকে গেল তার শ্রেণিকক্ষে, মুহূর্তে ঝলসে দিল সংখ্যাতীত শিশুর কচি শরীর, হরণ করল অজস্র মা-বাবার প্রাণাধিক সন্তানের জীবন, সেই এফ-৭ বিমানটির উৎপাদন আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল উৎপাদনকারী দেশ চীন। রাশিয়ার তৈরি মিগ-২১-এর অনুকরণে চীন এফ-৭ বিমান সিরিজটির নকশা করে।

১৯৫০ সালে এটি প্রথম বাজারে আসে। পুরনো প্রযুক্তির ব্যবহার উপযোগিতা কমে যাওয়া আর নতুন প্রযুক্তির উন্নততর উপযোগিতার কারণে ১৯৭৬ সালে চীন এই মডেল বাতিল করে দেয়। অথচ আশ্চর্যকর ঘটনা হলো, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এ বিমান ২০১৩ সালে ক্রয় করে। অর্থাৎ যদি আমরা ধরেও নিই এটি সর্বশেষ বছরে নির্মিত বিমান, তবু ৩৭ বছর পরে আমরা বাতিল হয়ে যাওয়া বিমান কিনেছি। এটাকে হঠকারিতা বলব, নাকি ঔদাসীন্য বলব জানি না।

আমরা দরিদ্র বুঝলাম, কিন্তু সে কারণে পুরনো অনিরাপদ বিমান কিনে তা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ট্রেনিং পরিচালনা করা মূর্খতা। সেকেলে, ভাঙাচোরা, বাতিল হয়ে যাওয়া বিমান নিয়ে পরশু যে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটল সেটিই প্রথম দুর্ঘটনা নয়। ২০১৭ সালে কক্সবাজারে দুটি ফাইটার বিমান, দুটিই ট্রেনিং জেট। সংঘর্ষ হয়ে দুটি বিমানই বিধ্বস্ত হয়। ভাগ্যক্রমে চারজন পাইলটই বিধ্বস্ত হওয়ার আগে নিজেদের শূন্যে নিক্ষিপ্ত করে প্রাণে বেঁচে যান। এর পরের বছর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় এই একই এফ-৭ বিমান পরিচালনার সময় একজন বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার আনিসুর রহমান মারা যান। সেখানেও কারিগরি ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। ২০২২ সালে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে প্রশিক্ষণের সময় ভূপাতিত হয় আরেকটি এফ-৭ বিমান। উভয় পাইলটই ইজেক্ট করে প্রাণে বেঁচে গেলেও ফাইটার বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। অর্থাৎ ন্যাড়া বারংবার বেলতলায় যাচ্ছে আর তার টেকো মাথায় বেল পড়ছে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/23-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgবিমান দুর্ঘটনার অতিরিক্ত বিপদ হলো যে তার পেটের খোঁড়লে থাকা যাত্রীদেরই মৃত্যু ডেকে আনে তা নয়, তা মৃত্যু ঘটায় ভূমির মানুষদেরও, যাদের ওপর সে আছড়ে পড়ে। ঘটতে পারেএই আশঙ্কা মাথায় রেখে বিমানবন্দরগুলো যথাসম্ভব শহর থেকে দূরে জনবিরল প্রান্তরে তৈরি করা হয়। মিলিটারি এয়ারবেসগুলো থাকে দুর্গম, জনবিরল এলাকায়। কারণ মিলিটারি এয়ারক্রাফটের বেশির ভাগের শব্দের চেয়ে বেশি গতি, কোনোটি শব্দের গতির দ্বিগুণ (Mach 2), কোনোটি তিন গুণ (Mach 3)। তাদের বিধ্বস্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। মিলিটারি এয়ারক্রাফটের চেয়ে সিভিলিয়ান এয়ারক্রাফটের Stability বেশি, কিন্তু সামরিক বিমানের Maneuverability অনেক বেশি থাকায় তাদের ঝুঁকির মাত্রাও বেড়ে যায়। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, ঢাকার মতো দুনিয়ার একটি সর্বোচ্চ ঘনবসতির শহরের কেন্দ্রস্থলে কী করে একটি এয়ারবেস থাকতে পারে এবং কী করে তার আকাশে বিমান প্রশিক্ষণের মহড়ার আয়োজন করা হয়?

মাইলস্টোন কলেজ ও স্কুলে গত সোমবার দুপুরে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে গেল তার দায়িত্ব কে নেবে? একটি বহু পুরনো লক্কড়ঝক্কড় মার্কা বিমানের যে ফিটনেস নেই, তা কেউ কি জানত না? যারা এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল, যারা এই উড্ডয়নের ছাড়পত্র দিয়েছিল তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ঢাকার মতো একটি মানুষঠাসা নগরের আকাশে কী করে পাইলট প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়? এই ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজন কী?

আমাদের মানবিকতা ও মূল্যবোধ যে কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে মাইলস্টোনের দুর্ঘটনা তা আরো একবার নগ্নভাবে উন্মোচিত করে দিয়ে গেল। আগে মানুষ বিপদে পড়লে অপরাপর মানুষ এগিয়ে যেত, এখন তারা ভিডিও করে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়ে লাইভ শো করে। উত্তেজনাকর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে তারা হিরো হতে চায়, বিপদে কাতরাচ্ছে যে মানুষ তাকে উদ্ধারে তার মন নেই। আমরা দেখলাম আরো অধঃপতনের চিত্র। ৩০ টাকার পানি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, ৬০ টাকা রিকশা ভাড়া হয়ে গিয়েছিল ৫০০ টাকা। একটি ভিডিওতে দেখলাম অগ্নিদগ্ধ একটি শিশু কাতর হয়ে রিকশা থামানোর চেষ্টা করছে, অমানুষ রিকশাওয়ালা ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে চলে যাচ্ছে। তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে গেছে মানুষ, রক্ত দিয়েছে অনেকে। এটাই মানবিকতা।

আমাদের দূরদর্শিতার অভাব, পরিকল্পনার ঘাটতি, অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার যে সামগ্রিক দুর্দশাগ্রস্ত চিত্র তা-ই যেন উন্মোচিত করে গেল একটি মর্মন্তুদ দুর্ঘটনা। যেসব পিতা-মাতা তাঁদের সন্তানদের হারিয়েছেন শুধু তাঁরাই জানেন সন্তান হারানোর বেদনা কত অসহনীয়, কত ভারী। আমাদের যা রীতি-শোক প্রকাশ, একটা তদন্ত কমিটি গঠন, আর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে দায়িত্ব খালাস। এ যাত্রায়ও তার চেয়ে বেশি কিছু হবে না। পরিকল্পনার অভাবে এতগুলো তরুণ প্রাণ অকালে ঝরে পড়ল (চূড়ান্ত মৃতের সংখ্যা কত হবে কেউ জানে না। কেননা অগ্নিদগ্ধ অর্ধশত মানুষের জীবন সংকটাপন্ন, আর আশি ভাগ দেহ আগুনে পুড়ে গেলে বাঁচার সম্ভাবনা কম), কেন এই প্রাণহানি তা ভাবতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো প্রশিক্ষণ বিমান ঢাকার আকাশে আমরা না দেখিসেটাও নিশ্চিত করতে হবে। আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। যে দেশে মানুষ বেশি সে দেশেও মানুষের জীবনের দাম কম নয়এ সত্য সবাইকে বুঝতে হবে। আর ফিরিয়ে আনতে হবে মানবিকতার সেই সব বোধ, যা বিপদাপন্ন মানুষকে উদ্ধার করে, তাকে নিয়ে ভিডিওচিত্র না বানায়।

 

লেখক : কবি, অধ্যাপক ও বিমান প্রকৌশলী

মন্তব্য

রাজনীতিকে ‘অলাভজনক’ করাই হবে সবচেয়ে বড় সংস্কার

    নূরে আলম সিদ্দিকী
শেয়ার
রাজনীতিকে ‘অলাভজনক’ করাই হবে সবচেয়ে বড় সংস্কার

জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে চিরদিনের জন্য বদলে ফেলার একটি দুর্লভ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হওয়া দুটি তরুণ প্রজন্ম চরম অপমানজনকভাবে রুখে দিয়েছে বহুল সমালোচিত স্বৈরাচারী শাসনের অগ্রযাত্রাকে। এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল তরুণ প্রজন্ম। তাদের এই অবিস্মরণীয় অর্জন আজ সমগ্র বিশ্বের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

এরই স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট ২০২৪ সালে বিশ্বের সেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করেছে।

সঠিক গণতন্ত্রের অভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে আছে কেবল ক্ষমতা ভোগ ও লুটপাট। অথচ রাজনীতির মৌলিক উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনকল্যাণ, কিন্তু তা আজ ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রাজনীতিকে অলাভজনক করে তোলা এবং সেই সঙ্গে মন্ত্রী, এমপিদের সব ধরনের অনৈতিক আর্থিক ফায়দা লাভের সুযোগ বন্ধ করাই হবে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সংস্কার।

রাজনীতিতে এ ধরনের আমূল পরিবর্তন আনার মাধ্যমে গণতন্ত্র, সুশাসন ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। তবে এই পরিবর্তন আনতে হলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত সময়, ধৈর্য, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, কার্যকর নীতিমালা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে এই লক্ষ্যে সুচিন্তিত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশে রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে।

নির্বাচন, পদায়ন এবং সরকারি সুবিধাগুলোকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহারের প্রবণতা স্বাধীনতার পর থেকেই ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে। ফলে দুর্নীতি বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে সীমাহীনভাবে। রাজনীতিবিদদের অনেকে সরকারি প্রকল্প ও উন্নয়ন কার্যক্রমের আড়ালে অবৈধ সম্পদ অর্জনের পন্থা খুঁজে পান।
যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা অনৈতিক অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হবে না, তখন দুর্নীতি করার প্রবণতাও কমবে। জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজের প্রতি রাজনীতিবিদদের মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। প্রশাসন হবে কার্যকর, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। রাজনীতিতে এই পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে প্রথমেই নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন  এবং বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করে তোলা প্রয়োজন। রাজনীতিবিদদের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

দলীয় তহবিল ও নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য স্বচ্ছ ও নির্ধারিত নিয়ম থাকা এবং সেগুলো যাতে কঠোরভাবে মেনে চলা হয়, তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অর্থের অপব্যবহার রোধ করতে দলগুলোর তহবিল পরিচালনা নিয়মিত নিরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে রাজনীতিবিদদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা সীমিত করা উচিত। সরকারি সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও তা কার্যকর করতে হবে। সর্বোপরি রাজনীতিতে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ও মনোযোগ বাড়াতে হবে। যখন জনগণ রাজনীতির প্রতি সচেতন হবে, তখন তারা সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের প্রত্যাখ্যান করবে।

এই প্রক্রিয়ার অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেসব রাজনীতিবিদ রাজনীতিকে ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন, তাঁরা কখনো এই পরিবর্তন মেনে নেবেন না। তাঁদের বিরোধিতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে তারই প্রতিফলন ঘটছে। তা ছাড়া বেশির ভাগ মানুষ রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত নয়। তাদের শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা সময়সাপেক্ষ। সর্বোপরি যেসব প্রতিষ্ঠান রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ছাড়া রাজনীতিকে অলাভজনক করা সম্ভব নয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে সরকারি পদায়ন ও অনৈতিক সুবিধা বন্ধ করতে হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিজেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ব্যাপক সংস্কার এনে এই কমিশনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও কার্যকর দুর্নীতি দমন নিশ্চিত করতে হবে। বিচারব্যবস্থায় সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনীতিতে ও সমাজে নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতার গুরুত্ব নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যাতে তারা অনৈতিক কার্যকলাপ উদঘাটন করতে পারে। শিক্ষিত ও দক্ষ নেতাদের রাজনীতিতে উৎসাহিত করতে হবে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক পদে থাকা ব্যক্তিদের অপ্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা এবং বিশেষাধিকার সীমিত করতে হবে। সরকারি প্রকল্পে রাজনৈতিক প্রভাব এবং অবৈধ সুবিধা অর্জনের পথ বন্ধ করতে হবে।

নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী এবং তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সব কর্মকাণ্ড ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রেকর্ড করতে হবে, যেন যেকোনো অনিয়ম চিহ্নিত করা যায়। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সমঝোতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

এসব পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারকে গ্রহণ করতে হবে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে। এসব কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নই রাজনীতিকে অলাভজনক ও জনকল্যাণমুখী করার পথে একটি মাইলফলক হতে পারে। আর রাজনীতিকে অলাভজনক করার মাধ্যমে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক সংস্কার নয়, বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনেরও সূচনা। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও জনগণের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

 

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ