<p>কস্তুরী হলো একটি বিশেষ ধরনের সুগন্ধি। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সুগন্ধিও হলো এই কস্তুরী। এই সুগন্ধির উৎস হলো কস্তুরী হরিণ বা মাস্ক ডিয়ার নামের এক প্রজাতির পুরুষ হরিণ। এই হরিণ হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল, ইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, কিরগিজস্তান এবং কোরিয়ার বসবাস করে। এই হরিণটিনে নাভিতে একটি বিশেষ গ্রন্থি থাকে, যা থেকে কস্তুরী উৎপন্ন হয়। তবে এই কস্তুরীর ঘ্রাণের পেছনে লুকিয়ে আছে এক মর্মান্তিক সত্য। </p> <p>এই হরিণগুলি হিমালয়ের উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে, সামতো এলাকায় বসবাস করে। এই বিশেষ প্রজাতির হরিণের নাভিতে যখন একটি নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে, তখন একটি বিশেষ ধরনের গ্রন্থি বিকশিত হয়, যা থেকে কস্তুরী উৎপন্ন হয়। </p> <p>কস্তুরীর ঘ্রাণ এতটাই শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী। কথিত আছে, এর সামান্য পরিমাণ যদি কোনো ঘরে রাখা হয়, তবে সেই ঘরে বহু বছর ধরে এর সুবাস থেকে যায়। এই ঘ্রাণ এতটাই শক্তিশালী যে তিন হাজার ভাগ গন্ধহীন পদার্থের সঙ্গে এর এক ভাগ মেশালেও সমস্ত পদার্থই সুবাসিত হয়ে ওঠে। </p> <p>কস্তুরী সংগ্রহের প্রক্রিয়া অত্যন্ত কঠিন এবং দুঃখজনক। পুরুষ হরিণের দশ বছর বয়স হলে তার নাভির গ্রন্থি পরিপক্ব হয় এবং তখনই শিকারিরা এই হরিণ হত্যা করে গন্থি সংগ্রহ করে। একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থির ওজন সাধারণত ৬০-৬৫ গ্রাম হয়। সকল হরিণের নাভিতে একই পরিমাণে কস্তুরী উৎপন্ন হয় না; হরিণের বয়স এবং পরিবেশভেদে কস্তুরীর পরিমাণের তারতম্য হয় । ১ কেজি কস্তুরী পেতে প্রায় দুই হাজার হরিণ শিকার করতে হয়।</p> <p>কস্তুরী সংগ্রহের সময় এর গন্ধ এতটাই তীব্র থাকে যে শিকারিরা নিজেদের নাক মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। তবুও, এই গন্ধ সহ্য করা খুবই কঠিন। অনেক সময় শিকারিদের চোখ, নাক থেকে জল পড়তে শুরু করে, মুখ থেকে লালা ঝরা শুরু হয়, এমনকি কখনও কখনও জীবনহানিও ঘটে। </p> <p><strong>কস্তুরীর মূল্য এবং ব্যবহার</strong><br /> কস্তুরী পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান সুগন্ধি হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং এর দাম সোনার দামের তিনগুণ। এই সুগন্ধি প্রাচীনকালে মোগল সম্রাটরা এবং বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহরা ব্যবহার করতেন। কস্তুরীর গন্ধের প্রভাব এতটাই প্রবল যে রাজারা এই সুগন্ধি ব্যবহার করলে তাদের প্রতি রাণীরা বিশেষভাবে আকর্ষিত হতেন।<br /> কস্তুরী শুধুমাত্র সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না, এটি বিভিন্ন ঔষধি গুণের জন্যও পরিচিত। কস্তুরী জ্বর, স্নায়ুবিক রোগ, পেটের ব্যথা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও, কস্তুরী শক্তি বাড়াতে এবং যৌন উদ্দীপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।</p> <p><strong>কস্তুরী মৃগ</strong><br /> মাস্ক ডিয়ার বা কস্তুরীমৃগ একটি লাজুক স্বভাবের প্রাণী। সাধারণত নির্জন পরিবেশে বসবাস করে। স্ত্রী সঙ্গীকে আকর্ষন বিশেষ গ্রন্থির উগ্র ঘ্রাণ নিঃসৃত করে। এই সময়েই শিকারিরা সহজেই এই হরিণদের সন্ধান পেয়ে যায়। কস্তুরী মৃগের এই বিশেষ ঘ্রাণই তাদের জীবনের অন্যতম দুর্বলতা, যা তাদের শিকারির কাছে সহজ শিকার করে তোলে।</p> <p>পুরুষ হরিণের নাভি মুখের গ্রন্থিতে এক বিশেষ ধরনের কোষের জন্ম হয়। এই কোষ যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন এ থেকেই সুঘ্রাণ বের হতে থাকে। ১০ বছর বয়সে সুগন্ধি কোষ পূর্ণতা লাভ করে।</p> <p>তবে মজার ব্যাপার হলো, যে হরিণটির নাভিতে এই কোষের জন্ম, সে নিজে কিছুই বুঝতে পারে না। তার নাকে যখন এই সুগন্ধ এসে লাগে, তখন সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে এই সুঘ্রাণের উৎসের সন্ধানে। </p> <p><strong>নানারকম কস্তুরীর</strong><br /> ভারতীয় প্রাচীন গ্রন্থে তিন প্রকার কস্তুরীর উল্লেখ পাওয়া যায়: কামরূপী, নেপালী, এবং কাশ্মীরী। এর মধ্যে কামরূপী কস্তুরী সর্বোত্তম মানের এবং কাশ্মীরী কস্তুরী তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের। কস্তুরীর সুবাসেও ভিন্নতা রয়েছে এবং এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত।</p> <p><strong>কস্তুরী উৎপাদন প্রক্রিয়া</strong><br /> সর্বশেষে, কস্তুরী যেমন একটি দামি এবং জনপ্রিয় সুগন্ধি, তেমনি এর সংগ্রহ প্রক্রিয়া অত্যন্ত কষ্টদায়ক এবং নিষ্ঠুর। আমাদের উচিত এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তন করে কৃত্রিম সুগন্ধির বিকাশে মনোযোগ দেওয়া এবং এই নিষ্ঠুরতার অবসান ঘটানো। প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করার জন্য এবং এই মূল্যবান প্রাণীদের সংরক্ষণ করার জন্য, আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি। কৃত্রিম কস্তুরীর বিকাশ এবং ব্যবহার এই অমানবিক প্রক্রিয়ার অবসান ঘটাতে পারে এবং আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করবে।<br />  </p>