<p>আমাদের উপমহাদেশে ছাপাখানা আসে ইউরোপিয়ানদের হাত ধরে। ১৫৫৬ সালে গোয়ায় বসানো হয় প্রথম ছাপাখানাটি। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বসায় প্রথম ছাপাখানা। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে। ছাপখানার জন্য ব্লক লেটার তৈরি করেন চার্লস উইলকিন্স আর হুগলির পঞ্চানন কর্মকার।  ১৮০০ সালে হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের মিশনারিতে বসানো হয় বাংলার ঐতিহাসিক ছাপখানাটি। উদ্যোক্তা উইলিয়াম কেরি। পঞ্চানন কর্মকার এখানে চলে আসেন। এখান থেকেই বের হয় বাংলাভাষার প্রথম বই মঙ্গল সমাচার। উইলিয়াম কেরি বাইবেল অনুবাদ করে ছাপান ওই প্রেস থেকেই।</p> <p>ভারতীয় উপমহাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসেও জড়িয়ে আছে শ্রীরামপুরে মিশনারি প্রেসের নাম। প্রথম সংবাদপ্রত্র ‘সমাচার দর্পন’ বের হয় কেরি আর পঞ্চানন ঘোষের উদ্যোগেই। সেখান থেকে বের হলো শিশু-কিশোর ম্যাগাজিন ‘দিগদর্শন’। দিগদর্শনের হাত ধরেই ভারতীয় তথা বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের পথচলা শুরু। দিগদর্শনের প্রথম সংখ্যা ছাপা হয় ১৯১৮ সালে। গল্প-কবিতার পাশাপাশি ছিল ‘কম্পাসের গুণ’, ‘চুম্বক পাথরের প্রথম অনুভব’ শিরোনামের লেখা। সেই কালে রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট কিছুই ছিল না। জ্ঞান বিজ্ঞানের নাগাল পাওয়া সহজ ছিল না তখন। দিগদর্শন তাই শিশু-কিশোরদের জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান হয়ে ওঠে।</p> <p>ঢাকায় প্রথম ছাপাখানাটি বসানো হয় ১৮৪৮ সালে। সেই যন্ত্রটা এখানো রাখা আছে জাতীয় জাদুঘরে। সেকালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ছাপখানাটি ছিল কুষ্টিায়ার কুমারখালিতে। কাঙাল হরিনাথের ছাপাখানা। এখান থেকেই বের হয় মীর মোশারফ হোসেনের কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’। </p> <p>গুটেনবার্গের মতো কাঙাল হরিনাথও লেখাপড়া শেখেননি তেমন। বাবা-মাকে হারান শৈশবেই। দৈনিক দু পয়সা বেতনে চাকরি নেন একটা কপড়ের দোকানে। পরে নীল কুঠিতে চাকরি করেনে কিছুদিন। সাধারণ প্রজাদের প্রতি নীলকর আর জমিদারের অত্যাচার চরমে উঠেছিল। তার প্রতিবাদ করেই ইশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় লেখালেখি করতেন হরিনাথ। তারপর তিনি নিজেই প্রকাশ করেন ‘গ্রামবার্তা প্রবেশিকা’ নামে একটা মসিক পত্রিকা। এই পত্রিকার জন্যই ছাপাখানা বসান হরিনাথ। পরে পত্রিকাটা পাক্ষিক, আরো পরে সাপ্তাহিকে নেমে আসে। কাঙাল হরিনাথের ছাপাখানা সাথে জড়িয়ে আছে মীর মশারফ হোসেন, জলধর সেন লালন ফকিরের মতো বিখ্যাত মানুষের স্মৃতি। কাঙাল হরিনাথ নীলকর-জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনি লিখতেন। যেকেনো সময় লাঠিয়াল বাহিনীর আক্রমনের ভয় ছিল। লালণ ফকির ছাপাখানা পাহারা দিতেন তাঁর দলবল নিয়ে আসর জমিয়ে ।</p> <p>বাংলা প্রকাশনা জগতে সত্যিকারে শিল্পের ছোঁয়া দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে একটা ছাপাখানা গড়ে তোলেন কলকাতায়। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিখ্যাত শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘সন্দেশ’ ছাপা। অন্য পত্রিকার চেয়ে সন্দেশ ছিল একদম ব্যতিক্রম। বাহারি ছবিতে ভরপুর স্বন্দেশের প্রতিটা পাতা। উপেন্দ্রকিশোর নিজ হাতে সেসব ছবি আঁকতেন। তারপর সেগুলোর উপযোগি করে ধাতব ব্লক লেটার ও ব্লক ছবি তৈরি করতেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনে সন্দেশে আনেন ইউরোপীয় শিল্পের আদল। তাঁর বিখ্যাত গুপিগাইন বাঘা বাইন গল্পটিও প্রকাশ হয় সন্দেশে। আজকের কিশোরা যেমন কিআর জন্য গোটা মাস অপেক্ষা করে, তখন সন্দেশ পত্রিকার আবেদন ছিল এরচেয়েও বেশি। </p> <p>এদেশের প্রকাশনা শিল্পের আরেক দিকপল চিত্তরঞ্জন সাহা। প্রথমে একটা বইয়ের দোকান চালাতেন চৌমুহনীতে। তারপর ‘বাসন্তি প্রেস’ নামে একটা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরে ঢাকায় চলে আসেন। ‘ঢাকা প্রেস’ নামে একটা মুদ্রণ পতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় কলকাতা চলে যান। সেখানে বসেই তাঁর মাথায় আসে ঐতিহাসিক ভাবনা। গড়ে তোলেন স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ- মুক্তধারা। প্রচুর লেখক-সাহিত্যিক সেসময় শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন। চিত্তরঞ্জন সাহা কলকাতায় বসেই মুক্তধারা থেকে একে একে বের করলেন শরনার্থী বাংলাদেশি লেখকদের ৩২টা বেই। </p> <p>স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই ৩২টা বই নিয়ে তিনি বসে যান বাংলা একাডেমির বর্তমান বটতলায়। পাটের বস্তা পেতে। কয়েক বছর এভাবেই চলে। তার দেখাদেখি আরো কিছু প্রকাশ ফেব্রুয়ারিতে বই নিয়ে জড়ো হন বাংলা একাডেমিতে। এভাবেই যাত্রা শুরু অমর একুশে বইমেলার।</p> <p>দিন যত গড়িয়েছে, বংলাদেশের পুস্তক ও মুদ্রণ শিল্পও সম্মৃদ্ধ হয়েছে। ঢাকার অলিতে-গলিথে গড়ে উঠৈছে ছাপাখানা ও বই বাঁধাইয়ের কারখানা। সৃজনশীল প্রকাশন সংস্থাও এখন হাজারের ওপরে। অমর একুশে বইমেলা চলে টানা ২৮ দিন ধরে। এটা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী গ্রন্থমেলা। জামার্নির ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার পরেই সবচেয়ে বেশি লোক সমাগম হয় একুশে বইমেলায়। জোহান গুটেনবার্গের হাত ধরে প্রকাশনা শিল্পের পথচলা শুরু হয়েছিল, এদেশে তার সার্থক রূপায়ন করে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা। আর সেটিকেই বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত করেন চিত্তরজ্ঞন সাহা।<br />  </p>