<p>সে সময় উত্তাল রাজনীতিতে টালমাটাল গোটা ফ্রান্স। একদিকে রাজতন্ত্র যাঁতাকলে পিষ্ঠ মানুষ, অন্যদিকে প্রজাতন্ত্রের হাতছানি। এই দুই চক্রের কবলে পড়ে সাধারণ ফরাসিরা তখন দিশেহারা। এই ঘটনা কিশোর গ্যালোয়ার মনে গভীর রেখাপাত করে। অন্যায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্ম নেয় গ্যালোয়ার মনে। এমনিতে ছিলেন শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের মানুষ। কিন্তু ১৬ বছর বয়সে তাঁর ভেতরে ঘটে একটা বিরাট পরিবর্তন । </p> <p>গণিতে মজে যান গ্যালোয়া। শুধুই গণিত! খেতে, বসতে, ঘুমাতে, ক্লাসে—তাঁর মনে গণিতর সমীকরণ, মগজে সংখ্যাতত্ত্বের খেলা চলে অবিরাম। ১৭ বছর বয়সে গণিত জার্নালে গ্যালোয়ার প্রথম গবেষণাপত্র ছাপা হলো। এরপর অনেক ধৈর্যসহকারে দুটো গবেষণাপত্র তৈরি করেন। সে দুটি পড়ে মুগ্ধ বিখ্যাত গণিতবিদ কশি। তিনি চেয়েছিলেন সে বছর ‘একাডেমি অব সায়েন্স’-এর সবচেয়ে বড় পুরস্কারটা যেন গ্যালোয়া পান। কিন্তু বিচারকেরা সেটা হতে দিলেন না। কারণ রাজনৈতিক। গ্যালোয়ার বাবা ছিলেন প্রজাতন্ত্রপন্থী রাজনীতিবিদ। এতটাই দক্ষ আর জনপ্রিয় যে রাজতন্ত্র ফিরে এলেও নিজের এলাকা থেকে নির্বাচনে জিতে তিনি মেয়র হয়েছিলেন। সংস্কৃতিমনা মানুষ হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল। লিখতেন বুদ্ধিদীপ্ত সব কবিতা।</p> <p>এই কবিতা দিয়েই তাঁকে ঘায়েল করা হলো। রাজতন্ত্রপন্থীরা গাদা-গাদা অশ্লীল কবিতা লিখে মেয়রের নামে ছাপাতে লাগল।অপমানিত ও লজ্জিত গ্যালোয়ার বাবা আত্মহত্যা করে মনের জ্বালা জুড়ালেন। বাবার মৃত্যু ক্ষুব্ধ আর খ্যাপাটে করে তুলল গ্যালোয়াকে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় না গিয়ে প্রতিবেশী বেশ কিছু উগ্র রিপাবলিকান সমর্থক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাজতন্ত্রপন্থীদের ওপর। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বদলে লেগে গেল দাঙ্গা! বাবার মৃত্যুর পর আরও একবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তাঁকে পুরস্কারবঞ্চিত করল। কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন গ্যালোয়া।প্রায় ছেড়েই দিলেন গণিতচর্চা।</p> <p>১৮৩০ সাল। সারা ফ্রান্স তখন আরও উত্তাল রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে।লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে গ্যালোয়া যোগ দিলেন ‘ন্যাশনাল রিপাবলিকান গার্ড’-এ ।কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেই প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করা হয়। ফল হয় মারাত্মক, রিপাবলিকানদের রাজনীতি ঝুঁকে পড়ে জঙ্গিবাদের দিকে। </p> <p>বদরাগী গ্যালোয়া আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। প্রকাশ্যে ফরাসি সম্রাটকে খুন করার হুমকি দিচ্ছেন, নিষিদ্ধঘোষিত ন্যাশনাল রিপাবলিকান গার্ডের পোশাক পরে প্রকাশ্যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফল, ছয় মাসের জন্য জেলে পাঠানো হলো তাঁকে।জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গ্যালোয়া আরও বেপরোয়া। অতিরিক্ত মদ্যপান, মাত্রা ছাড়ানো রাগ, ক্ষোভ, হতাশা তাঁকে পুরোপুরি ভঙ্গুর করে ফেলে।</p> <p>এ সময় হঠাৎ করেই স্টেফেনি ফেলিসি নামে প্যারিসের বিখ্যাত এক ডাক্তারের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়লেন গ্যালোয়া। স্টেফেনির মতো স্বনামধন্য ডাক্তার গ্যালোয়ার মতো ভবঘুরে, খ্যাপাটে, মাতাল এক যুবককে কেন ভালোবাসলেন, এর জবাব খুঁজে পেল না কেউ। স্টেফেনি ছিলেন প্যারিসের এক ধনাঢ্য লোকের বাºত্তা। সে সময় কারও বাºত্তা অন্য কোনো পুরুষের প্রেমে পড়লে সেটা হবু বরের জন্য অপমানজনক ও পৌরুষে আঘাত বলে মনে করা হতো। স্টেফেনির বাগদত্তও তা-ই মনে করলেন। অপমানের জ্বালা জুড়াতে তিনি গ্যালোয়াকে জানালেন ডুয়েলের আমন্ত্রণ। গ্যালোয়াও বিনা বাক্যে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন।<br /> তখনকার দিনে ডুয়েল হতো পিস্তল দিয়ে। খুব কাছ থেকে ডুয়েলে অংশ নেওয়া দুজন পরস্পরকে গুলি করত। পিস্তলে যার হাত যত ভালো, জয় হতো তারই। আর পরাজিতের ভাগ্যে যে মৃত্যু জুটত, সেটা বলাই বাহুল্য। ডুয়েলের আহ্বানে সাড়া না দিলে লোকে গ্যালোয়াকে কাপুরুষ ভাবত, দুয়ো দিত। </p> <p>ডুয়েলে সাড়া দিলেও তিনি বুঝলেন, এই যুদ্ধে জেতা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তিনি নিজে ভালো পিস্তলবাজ নন, অন্যদিকে প্রতিপক্ষের পিস্তলের নিশানা খুব ভালো। সুতরাং মরতে চলেছেন তিনি। তাঁর মনে পড়ে গেল, আজন্ম আরাধ্য গণিতের কথা। সারা জীবন গণিতের পেছনে যেভাবে ছুটেছেন, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কি তা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে? কিন্তু তাঁর কাজের কোনো রেকর্ডও তো নেই। এদিকে হাতেও সময় নেই—মাত্র একটা রাত। যা করার ওই রাতেই করতে হবে। গ্যালোয়া কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেলেন। গণিত নিয়ে এযাবৎ যা করেছেন, যা ভেবেছেন সব লিপিবদ্ধ করবেন।</p> <p>পুরো রাতটা নির্ঘুম কাটাল গ্যালোয়ার। সূত্র, তত্ত্ব, সমীকরণে ভরিয়ে ফেললেন দিস্তার পর দিস্তা কাগজ। আর সেসব তত্ত্বে মাঝেমধ্যে খেয়ালবশে লিখে রাখলেন প্রেমিকার নাম। লিখতে লিখতে রাত পেরিয়ে গেল। ভোরবেলা যখন তাঁর সূত্র, তত্ত্ব লেখা শেষ হলো, তখন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিতে বন্ধুকে অনুরোধ করলেন, ডুয়েলে যদি তাঁর মৃত্যু হয়, তবে তিনি যেন গ্যালোয়ার সব কাজ ইউরোপের বড় বড় সব গণিতবিদের কাছে পৌঁছে দেন।</p> <p>১৮৩০ সালের ৩০ মে। যথারীতি ডুয়েলের ময়দানে হাজির গ্যালোয়া আর স্টেফেনির বাºত্তা। দর্শকও আছে অসংখ্য। দুজনেই পিস্তল তুললেন পর¯পরের দিকে। ফল যা হওয়ার তা–ই হলো—একটিমাত্র গুলিতে প্রাণপাখি উড়ে গেল অসাধারণ গণিতবিদ এভারিস্ট গ্যালোয়ার। পড়ে রইল গণিত নিয়ে করা তাঁর সব কাজ।<br /> গ্যালোয়ার লাশ সৎকারের সময় শহরজুড়ে আবার শুরু হলো দাঙ্গা। গুঞ্জন উঠল, স্টেফেনি গ্যালোয়াকে কখনো ভালোবাসেনি, ফাঁদে ফেলার জন্য ভালোবাসার অভিনয় করেছেন। আর যে লোক ডুয়েলে লড়েছেন, তিনি মোটেও স্টেফেনির বাগদত্ত নন, পেশাদার খুনি। আসলে গ্যালোয়াকে হত্যা করাই ছিল এই প্রেম-প্রেম নাটকের মূল উদ্দেশ্য। তবে আদৌ কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানতে পারেনি কেউ।</p> <p>গ্যালোয়ার জীবনের শেষ রাতে করা কাজগুলো অনুরোধমতো তাঁর বন্ধু ইউরোপের সেরা গণিতবিদদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। একটা কপি গণিতবিদ জোসেফ লিউভিলের কাছেও পৌঁছেছিল। তিনিই সক্ষম হয়েছিলেন গ্যালোয়ার লেখা গাণিতিক তত্ত্বগুলো সঠিকভাবে বুঝতে। প্রতিটি থিওরির সঠিক মর্মোদ্ধার করে সেগুলো ফ্রান্সের সেরা জার্নালে প্রকাশ করেছিলেন। তত দিনে গ্যালোয়ার মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে ১০ বছর। দুনিয়ার সব গণিতপ্রেমী বিস্ময়ভরা হৃদয়ে অনুধাবন করলেন এক তরুণ গণিতবিদের জীবনের শেষ রাতের মহিমা।</p> <p>সূত্র:</p> <p>১. নিউরনে আবারও অনুরণন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও মোহম্মদ কায়কোবাদ</p> <p>২. ব্রিটাইনকা</p> <p><br />  </p>