<p>শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের উসকানি দিচ্ছে একটি মহল। এ জন্য উসকানিদাতাদের দেশে ফেরত এনে গ্রেপ্তার করার পরামর্শ দিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর প্রধানরা। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক কথা বলে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছেন। এসব শিক্ষককেও চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।</p> <p>চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় এসব কথা বলেছেন রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও সংস্থার প্রধানরা।</p> <p>গতকালের ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাতজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, চারজন সচিব এবং বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা। বৈঠক শেষে একাধিক মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করে কালের কণ্ঠকে জানান, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বৈঠকে বলেছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অনেকে শিক্ষার্থীদের উত্তেজিত করতে নেতিবাচক কথা বলছেন। এ ছাড়া দুবাইয়ে অবস্থানরত বিএনপি নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরী প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে রেমিট্যান্স না পাঠাতে উসকানি দিচ্ছেন।</p> <p>তাঁকে দেশে ফেরত এনে গ্রেপ্তারের  পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কোটা আন্দোলন সম্পর্কে ফেসবুকে বিভিন্ন প্রপাগান্ডা, অপপ্রচার, বিশেষ করে দুবাই ও সৌদিতে কিছু শ্রমিক এটা করেছেন। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত নেতারা কোটা আন্দোলনের সঙ্গে দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের যুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরাও একই কথা বলেছেন।</p> <p>বৈঠকে উপস্থিত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক জানিয়েছেন, এই আন্দোলন ঘিরে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।</p> <p>কয়েকজন কর্মকর্তা বৈঠকে আরো জানান, এই আন্দোলন ঘিরে বিভিন্ন প্রপাগান্ডা ও অপপ্রচার সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে। সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে হবে। বিএনপি-জামায়াতের হত্যা, সন্ত্রাস, সহিংসতা ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাতে হবে। বৈঠকে কর্মকর্তাদের বক্তব্য শেষে পর্যায়ক্রমে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও বক্তব্য দেন।</p> <p><strong>নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না</strong></p> <p>সভা শেষে বিফ্রিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমরা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করছি না। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার পর তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্য, ভিডিও ফুটেজ, সাক্ষী-সাবুদ নিয়ে যাদের আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি, তাদেরই গ্রেপ্তার করছি। ভুলক্রমে যদি কাউকে নিয়ে আসা হয়, থানায় আমাদের অফিসাররা তাদের চেক করে নিরপরাধ হলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।’</p> <p>স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকেই বলছেন, আমরা গণগ্রেপ্তার করছি। কোনো গণগ্রেপ্তার আমরা করছি না। এমন কোনো জেলা নেই যেখানে ধ্বংসযজ্ঞ না চালালেও তারা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। আর ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জায়গাগুলো আপনারা সবাই দেখেছেন। আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করেছে। তারা প্রাণহানি ঘটিয়েছে। আমরা সব কিছুর নিন্দা জানাই। গণগ্রেপ্তার হচ্ছে না। হ্যাঁ, গ্রেপ্তার আমরা করেছি। যাত্রাবাড়ীতে যা হয়েছে আপনারা দেখেছেন। এসব ছাত্রদের কর্মকাণ্ড নয়। যারা এই কর্মকাণ্ড করেছে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ড করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হবে। আমরা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে অন্তরিন করব না।’</p> <p><strong>তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে সব কিছু বেরিয়ে আসবে</strong></p> <p>পুরো ঘটনা নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে সব কিছু বেরিয়ে আসবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন। ১৫০ জন নিহতের ঘটনায় কী পরিমাণ গুলি ব্যবহার করা হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের মেয়র, পুলিশ, আনসারসহ অনেককে আক্রমণ করেছে। যেখানে পারেনি সেখানে জীবনরক্ষায় গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। এগুলোর সব হিসাব-নিকাশ আমাদের পুলিশ কর্মকর্তারা রাখেন। কোনো একটি গুলি, কেনো একটি মৃত্যু যদি অনাকাঙ্ক্ষিত হয়, সে জন্য তদন্ত হবে। তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন আসার পর আমরা সারা বিশ্বকে জানাতে পারব, কী ঘটেছিল সেখানে।’ </p> <p>এ সময় আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তদন্ত কমিশনের কার্যপরিধি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধান ও তদন্তের স্কোপ যেহেতু অনেক বেড়েছে, তাই আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর। কারণ তদন্ত কমিশনের এখন একজনই সদস্য। আমরা সেখানে আরো তিনজন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত খুব শিগগিরই নেব।’</p> <p><strong>জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন যেকোনো সময়</strong></p> <p>স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সব রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এটা এক ঘণ্টায়ও হতে পারে, দুই ঘণ্টায়ও হতে পারে। এক দিনেও হতে পারে, দুই দিনেও হতে পারে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই। আইনমন্ত্রী এর আগে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, আজ বুধবার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন হতে পারে।</p> <p><strong>শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে ধাপে ধাপে, জানালেন শিক্ষামন্ত্রী</strong></p> <p>কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার কারণে বন্ধ থাকা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধাপে ধাপে খুলতে চান বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রশ্নে আমরা বারবার বলছি, জননিরাপত্তা সর্বাগ্রে। জননিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা সব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ধাপে ধাপে অবশ্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে চাই। শুরুতে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য যে বিদ্যালয়গুলো আছে, পরে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরূপণের মাধ্যমে (খুলে দেওয়ার বিষয়টি) নির্ধারণ করা হবে। নিরাপত্তা ঝুঁকি নির্ধারণ আমরা প্রতিদিন করছি। সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই যথাসময়ে সেটা জানিয়ে দেব। নিরাপত্তা ঝুঁকি যদি কমে, তখন আপনারা জানতে পারবেন, কখন খোলা হবে।’</p> <p>শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘যারা নিরপরাধ শিক্ষার্থী, যারা শান্তিপূর্ণভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে, তারা কেউ যাতে প্রশাসনিক কোনো হয়রানি বা আইনগত কোনো জটিলতায় না পড়ে, এ জন্য আমরা ঘোষণা দিয়েছি। কোনো শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবক যদি মনে করেন তারা নিরপরাধ, সে ক্ষেত্রে তাঁরা অবশ্যই সেটা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা সরাসরি তাঁদের সব ধরনের সহযোগিতা দেব।’ অনলাইনে ক্লাস করার বিষয়ে কিছু ভাবছেন কি না—এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘ইন্টারনেট যেহেতু সচল হয়েছে, সেটাও আমরা বিবেচনা করছি। এরই মধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি।’</p> <p><strong>ফেসবুক, টিকটক খুলে দেওয়ার বিষয়ে জানা যাবে আজ</strong></p> <p>ডাক ও টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, ‘বুধবার সকাল ১১টার পর ফেসবুক-টিকটক খুলে দেওয়ার বিষয়ে জানাতে পারব। টিকটক, ইউটিউব ও ফেসবুকের কাছে একটি ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। মৌখিক ও লিখিতভাবে জবাব দিতে বলা হয়েছে তাদের। এরই মধ্যে টিকটক আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানিয়েছে যে তারা উপস্থিত হয়ে মৌখিক ও লিখিতভাবে জবাব দিতে চায়। তবে ফেসবুক ও ইউটিউব বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) কোনো জবাব দেয়নি। যে কারণে বুধবার সকাল ৯টা, ১০টা ও ১১টায় এই তিন প্রতিষ্ঠানকে বিটিআরসিতে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা পাওয়া গেলে তা বিশ্লেষণ করে, না পেলেও আমরা আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত জানাতে পারব।’</p> <p>জরুরি প্রয়োজনে সভা ছেড়ে চলে যাওয়ার পথে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের নামে জঙ্গিদের গণভবন ও এয়ারপোর্টে অ্যাটাক করার পরিকল্পনা ছিল। কিভাবে তারা পরিকল্পনা করে জঙ্গি আক্রমণ করেছে ওভার অল এসব বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আমরা সব বিষয় অ্যাসেস করছি। তারা গণভবন অ্যাটাক করার প্ল্যান করেছিল। এসব স্থাপনা অ্যাটাক করার কোনো কারণ ছিল না শিক্ষার্থীদের। এটা তৃতীয় কোনো পক্ষ করেছে।’</p> <p>এ ছাড়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী। আরো যোগ দেন পররাষ্ট্রসচিব, বাণিজ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও জননিরাপত্তা বিভাগের দুই সচিব।</p>