<p>পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জা, বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর, মেজো মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরসহ তাদের মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রশাসক নিয়োগের আদেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের এই আদেশের মাধ্যমে বেনজীর পরিবারের গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কক্সবাজার ও সাভারের সম্পত্তি, রিসোর্ট, স্থাপনা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে এলো।</p> <p>গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন প্রশাসক নিয়োগের এই আদেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসক নিয়োগের আদেশ দেন আদালত। হাফিজুল ইসলাম বেনজীর আহমেদ এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা।</p> <p>দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের ক্রোক করা স্থাবর সম্পদ দেখভালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনের পর শুনানি শেষে আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘বেনজীরের ৬২১ বিঘা স্থাবর সম্পদ ঢাকা, সাভার, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও কক্সবাজারে রয়েছে।’</p> <p>গোপালগঞ্জে থাকা ২৮টি পুকুর দেখভালে জেলার মৎস্য কর্মকর্তাকে, কক্সবাজারের সম্পত্তি দেখভালে জেলা প্রশাসককে এবং সাভারের স্থাবর সম্পদ দেখভালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া অন্য স্থাবর সম্পদগুলো দেখভালে জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট দেখভালে দুদকের পরিচালককে (সম্পদ ব্যবস্থাপনা) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’</p> <p>দুদকের এই আইনজীবী আরো বলেন, যাদের রিসিভার (তত্ত্বাবধায়ক) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা মূলত ক্রোক করা সম্পত্তিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। ওই সম্পত্তির আয়-ব্যয়ের হিসাব একটি নির্দিষ্ট সময়ে আদালতকে জানাবেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে ওই সম্পত্তি বাজেয়াপ্তও করা হতে পারে। তখনো রিসিভার আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবেন।</p> <p><strong>গোপালগঞ্জের সম্পত্তি জেলা প্রশাসকের অধীনে</strong><br /> দুদক সূত্র জানায়, গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসককে সেখানে থাকা বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মীর্জা, বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও মেজো মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের সম্পত্তি দেখভালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। আদালতের এই আদেশের মাধ্যমে গোপালগঞ্জ সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের অধীনে কেনা ৬৫টি দলিলের ৩০২.৫৮ বিঘা ক্রোক করা জমি দেখভাল করবেন জেলা প্রশাসক, যার দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ১৪ হাজার ৫০০ টাকা।</p> <p><strong>মৎস্য খামার দেখবেন গোপালগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা</strong><br /> গোপালগঞ্জের মৎস্য খামার দেখভালের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে। বেনজীর আহমেদ তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে গোপালগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেছেন সাভানা অ্যাগ্রো। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে গোপালগঞ্জের সাভানা রিসোর্টের ভেতরে আছে বিশাল আকৃতির ১৫টি পুকুরসহ মোট ২৮টি পুকুর। এসব পুকুর দেখভাল করবেন গোপালগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা। ২০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনধারী সাভানা অ্যাগ্রো লিমিটেডের পরিচালক তিনজন। ১০টি শেয়ারধারী স্ত্রী জীশান মীর্জা চেয়ারম্যান, সমপরিমাণ শেয়ারের অধিকারী ২৯ বছর বয়সী বড় মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর এমডি। আর ২৪ বছর বয়সী মেজো মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর আছেন পরিচালক হিসেবে।</p> <p><strong>মাদারীপুরের সম্পত্তি দেখবেন জেলা প্রশাসক</strong><br /> বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মীর্জা, মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীরের মালিকানায় থাকা ২৭৩ বিঘা সম্পত্তি দেখভালের জন্য মাদারীপুরের জেলা প্রশাসককে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দিয়েছেন আদালত।</p> <p>দেড় বছরেরও কম সময়ের মধ্যে জীশান মীর্জার নামে ১১৪টি দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়। মাদারীপুর জেলার রাজৈর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ৬০ নম্বর সাতপাড়া ডুমুরিয়া মৌজায় এসব জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। উল্লেখিত দলিলগুলোতে জমির পরিমাণ প্রায় ৯ হাজার ১৬ শতাংশ বা ২৭৩ বিঘা। এসব জমির ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। যদিও বাস্তবে এসব জমির ক্রয়মূল্য দলিলে দেখানো মূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি। বেনজীর আহমেদ পুলিশের আইজি থেকে অবসরে যাওয়ার আগের ৫৯৪ দিনে বিপুল এই সম্পদ কিনেছেন। এ হিসাবে তিনি প্রতিদিন গড়ে ১৫.১৬ শতাংশ জমি কিনেছেন। তিনি অবসরে যান ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। আর মাদারীপুরের জমিগুলো কেনেন ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত। জমি কেনা শুরু করেন ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি।</p> <p><strong>কক্সবাজারের সম্পত্তিও জেলা প্রশাসক দেখভাল করবেন</strong><br /> বেনজীর আহমেদের কক্সবাজারের সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেখানকার জেলা প্রশাসককে। বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মীর্জা, মেয়ে ফরহিন রিসতা বিনতে বেনজীরের নামে থাকা কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ইনানীতে এবং সেন্ট মার্টিনের জিনজিরা দ্বীপে থাকা সাতটি দলিলের সম্পত্তি দেখভাল করবেন জেলা প্রশাসক।</p> <p>সাভারের সম্পত্তি দেখভাল করবেন ইউএনও আদালতের নির্দেশে সাভারে থাকা বেনজীরের একটি দলিলের সম্পত্তি দেখভাল করবেন সেখানকার ইউএনও।</p> <p><strong>মানবিক কারণে গুলশানের ফ্ল্যাটে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি</strong><br /> দুদক সূত্র জানায়, গুলশান আবাসিক এলাকার সিইসি (জি) ব্লকের ১৩৪ নম্বর (পুরনো ১৩০) প্লটের ১২ কাঠা ১২ ছটাক জমির ওপর দুটি বেসমেন্টসহ নির্মিত রেনকন আইকন টাওয়ারে ৯ হাজার ১৯২.৭৮ বর্গফুট ফ্ল্যাট ক্রয় করে বেনজীর আহমেদের পরিবার। চারটি ফ্ল্যাটের সমন্বয়ে বানানো হয় এটি। দুদক ডুপ্লেক্স এই ফ্ল্যাটে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার আবেদন করে। তবে আদালত জানান, যেহেতু এই ফ্ল্যাটে বেনজীর আহমেদ পরিবার নিয়ে বসবাস করেন, সেহেতু মানবিক কারণে এটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেবেন না। তবে ফ্ল্যাটটি জব্দ অবস্থায় থাকবে। এ ক্ষেত্রে সরাসরি প্রশাসক নিয়োগ না করলেও গুলশানের এ চারটি ফ্ল্যাট দেখভালে দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দায়িত্ব দেন আদালত।</p> <p>এদিকে আদালতে তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগের জন্য দুদকের আবেদনে বলা হয়, উল্লেখিত (বেনজীর এবং তার পরিবারের) স্থাবর সম্পদের সঠিক নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা, তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রিসিভার নিয়োগ করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ আদালতের আদেশে ক্রোক করা বর্ণিত সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে রিসিভার না থাকায় তা বেহাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্থাবর সম্পদের মধ্যে জমি ও ফ্ল্যাট ছাড়াও বেশ কিছু জমিতে রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, কটেজ, ডরমিটরিসহ গাছ, বাগান, পুকুর, পশুর খামার, মৎস্য খামার রয়েছে। এ ছাড়া শিশুদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন রকম রাইড, বোট ও রাতযাপনের কটেজ রয়েছে। ফলে সেখানে জমি ও তার উপরিস্থিত স্থাপনা, স্থাপনায় রক্ষিত আসবাব, ইলেকট্রনিক সামগ্রীসহ বর্ণিত অন্যান্য মাল, যন্ত্রপাতি, মেশিনারি ক্রোকের আওতাভুক্ত করে ক্রোক করা যাবতীয় সম্পদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রিসিভার নিয়োগ করা হলে পরবর্তী সময়ে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন সহজতর হবে।</p> <p>গত ২৪ মে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর, তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ২৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট), চারটি ক্রেডিট কার্ড ও ছয়টি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়। এরপর গত ২৬ মে একই আদালত বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটও জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর, তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়।</p> <p>কালের কণ্ঠে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ ও ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদন দুটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মূলত এর পরই দুদক বেনজীর এবং তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।</p> <p>বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের আইজি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাব এবং র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান যে সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের মধ্যে বেনজীরও ছিলেন।</p> <p>এসব অভিযোগের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেনজীর আহমেদকে গতকাল বৃহস্পতিবার (৬ জুন) সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত থাকতে নোটিশ পাঠিয়েছিল সংস্থাটি। তবে তার আগে গত বুধবার আইনজীবীর মাধ্যমে ১৫ দিন সময় চেয়ে আবেদন করেন বেনজীর।</p>