<p>কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক পথেই চলে আসছিল। সমস্যা হয় যখন কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠন সেই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে নিজেদের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। তারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মিশে গিয়ে দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সহিংসতা চালাতে থাকে।</p> <p>এই অবস্থায় সরকার ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। শিক্ষার্থীদের বড় অংশ রাজধানী ছেড়ে যায়। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়।</p> <p>এমন পরিস্থিতিতে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই দেশজুড়ে, বিশেষ করে রাজধানীতে রীতিমতো তাণ্ডব চালানো হয়। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি অনেক স্থাপনায়ও জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর-লুটপাট করা হয়। গণমাধ্যমে প্রতিফলিত মতামতে দেখা যায়, প্রায় সবাই স্বীকার করেন, এই তাণ্ডবে কোটা নিয়ে আন্দোলন করছিল যে শিক্ষার্থীরা, তাদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। তৃতীয় কোনো পক্ষ এসব নাশকতা করেছে।</p> <p>কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীরাও জোর দিয়ে বলেছে, এসব জ্বালাও-পোড়াও বা ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। শিক্ষার্থীরা যে এসব নৈরাজ্য বা ধ্বংসাত্মক তৎপরতার সঙ্গে জড়িত নয়, তা ঘটনাগুলো বিবেচনা কিংবা সামান্য বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায়। ১৯ জুলাই শুক্রবার নরসিংদী জেলখানায় হামলা চালানো হয়। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বড় বড় হ্যামার দিয়ে ভাঙা হয় প্রধান ফটক। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া আন্দোলনে কেউ এমন হ্যামার নিয়ে আসে না।</p> <p>কারাগারের অস্ত্রাগার থেকে ৮৬টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং প্রায় ৯ হাজার রাউন্ড গুলি লুট করা হয়। ৮২৬ জন আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয়, যার মধ্যে ৯ ছিল দুর্ধর্ষ জঙ্গি। কারাগারের অফিস কক্ষ, অস্ত্রাগার, বন্দিশালা, ব্যারাক, অফিসারদের বাসাবাড়ি, গ্যারেজে থাকা গাড়ি ও মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করা হয়। সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ কী বলবেন, এসব আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কাজ! ছাত্ররা আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে কী করবে? জঙ্গিদের মুক্তি দিয়ে কোটা আন্দোলনের কী ফায়দা হবে?</p> <p>নারায়ণগঞ্জের জালকুড়িতে শীতল পরিবহনের গ্যারেজে রাখা ২৪টি বাসে একসঙ্গে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মাদারীপুরে গ্যারেজ করে রাখা ৩৯টি বাসে আগুন লাগানো হয়। সারা দেশে এ রকম কয়েক শ গাড়ি পোড়ানো হয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ৪০টি স্থানে মাটির ওপরে থাকা ফাইবার অপটিক কেবল পোড়ানো হয় কিংবা বিচ্ছিন্ন করা হয়। মহাখালীতে ডাটা সেন্টারে আগুন দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, সারা দেশের ইন্টারনেট সংযোগ দীর্ঘস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, যাতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, যাতে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়। বিটিভিসহ আরো অনেক স্থাপনায় অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ছাত্ররা এমন পরিকল্পনা কেন করবে?</p> <p>কোথায় কোথায় হামলা করা হয়েছে, সেটি বিবেচনায় নিলেও হামলাকারীদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা মেলে। পদ্মা সেতুকে সারা দেশের মানুষ ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’ হিসেবে উল্লেখ করে। সেই সেতু নির্মাণ থেকে শুরু করে বর্তমান অনেক কাজকর্মই পরিচালিত হয় সেতু ভবন থেকে। মহা আক্রোশে পোড়ানো হয়েছে সেই সেতু ভবন। যানজটের ঢাকায় এক বড় উপশম নিয়ে এসেছে মেট্রো রেল। একেও অনেকে ‘স্বপ্নের মেট্রো রেল’ বলে থাকে। তার দুটি স্টেশন এমনভাবে ভাঙচুর করা হয়েছে যে এক বছরেও সেগুলো ঠিক করা যাবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পোড়ানো হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা। গণমাধ্যমের আলোচনায়ও উঠে এসেছে, সারা দেশের মানুষ এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হলেও কারো কারো কাছে তা ছিল চক্ষুশূল বা চিত্তজ্বালার কারণ। তা কতটা সত্য আমার জানা নেই। তবে এসব নাশকতার মধ্যে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ কিংবা অসহিষ্ণুতারই প্রকাশ ঘটেছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্যের সঙ্গে এগুলো কোনোক্রমেই সংগতিপূর্ণ নয়।</p> <p>দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নাশকতা ঠেকাতে ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করা হয় এবং বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতার জন্য সামরিক বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়। স্বস্তির ব্যাপার, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক ও শান্ত। যদিও অনেকের আশঙ্কা রয়েছে, এই আপাত শান্ত অবস্থাটি কত দিন স্থায়ী হবে তা নিয়ে। সরকারের নীতিনির্ধারক মহল নিশ্চয়ই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে এবং পরবর্তী করণীয় কী হবে তা নির্ধারণ করবে। আমরা সাধারণ মানুষ শান্তি চাই। এ বিষয়ে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন এবং যাঁরা ক্ষমতায় আসতে চাইছেন—তাঁদের উভয়ের কাছ থেকে আমরা যুক্তিসংগত, সহনশীল, গণতান্ত্রিক ও মানবিক আচরণ আশা করি।</p> <p>একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, সাম্প্রতিক সহিংসতায় চরম উসকানি থাকা সত্ত্বেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ মানবিকতা ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। নরসিংদীতে কারাগারে হামলা, কারারক্ষী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলা এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ের সময় জনতার ওপর গুলি চালানো হয়নি। যদিও এই জনতার একটি বড় অংশই গুজবে, উসকানিতে না বুঝেই এই হামলায় শরিক হয়েছে। আর তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কিছু দুষ্কৃতকারী তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করেছে। কারাবিধি অনুযায়ী, কারাগারের ফটক ভাঙার সময়ই যারা ফটক ভাঙছে তাদের ওপর গুলি চালানোর কথা। তাতে অনেক বড় ক্ষয়ক্ষতি হতো, অনেক হতাহত হতো। তার জন্য কারারক্ষী বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কোনো দায় বহন করতে হতো না। বরং তাঁরা জানেন, সেটি না করা হলেই তাঁদের অনেক রকম দায় নিতে হবে। তার পরও তাঁরা সরাসরি জনতার ওপর গুলি চালাননি। অন্যদিকে যারা সহিংস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা অনেক বেশি অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। ডিউটিতে যাওয়ার সময় পুলিশের দুজন সদস্যকে রাস্তায় অনেকটা অসহায় অবস্থায় পেয়ে তাঁদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়। লাশ ফুট ওভারব্রিজে ঝুলিয়ে রেখেছে। গাজীপুরে সাবেক মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারীকে মেরে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নারী সাংবাদিককে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়ন করা হয়েছে। এমন আরো অনেক ঘটনাই ঘটেছে।</p> <p>আন্দোলনে গুলিতে হতাহতের বিষয়টি নিয়েও ভিন্নমত আছে। টেলিভিশনে দেখলাম, গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন মাঝবয়সী এক লোক। তিনি জানান, তাঁকে পুলিশ গুলি করেনি। পুলিশ তাঁর সামনে ছিল। আর তাঁর গুলি লেগেছে পেছন দিকে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সামনের সারির এক শিক্ষার্থীর নাম মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। ১৮ জুলাই ব্যাপক নাশকতার পর তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লিখেছিলেন, আন্দোলনে শিবির-ছাত্রদল ঢুকে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে তিনি বেশ কিছু কথা লিখেছিলেন। পরদিন তাঁর গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়।</p> <p>আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এখানে একটি বিষয়ে লক্ষ রাখা প্রয়োজন, এটি যেন অতীতের মতো ‘গণগ্রেপ্তার’ বা ‘গ্রেপ্তার বাণিজ্য’ না হয়। যাদের গ্রেপ্তার করা হবে, তাদের বিষয়ে যেন আদালতে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, তথ্য-প্রমাণের অভাবে আদালত যেন গণহারে খালাস দিতে বাধ্য না হন।</p> <p>পাশাপাশি সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ, পুরো পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোথায় কোথায় আপনাদের ভুল ছিল, কেন সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়নি, সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উসকানি ছিল কি না, যা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছে—সব বিবেচনায় নিন। দেশ ও জাতির স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যৌক্তিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন।</p> <p>দেশে শান্তি বজায় থাকুক, দেশ সব দিক থেকে এগিয়ে যাক—এটিই আমাদের প্রত্যাশা।</p> <p><strong>লেখক : সাংবাদিক<br /> fmahmud53@yahoo.com</strong></p>