<article> <p style="text-align: justify;">চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইংরেজি সাহিত্যের একজন শিক্ষক শিক্ষকতা ছেড়ে পুলিশ ক্যাডারে চাকরি শুরু করেছিলেন। পরে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ফিরে এসেছিলেন। পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করার পর তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করিনি, যোগাযোগ ছিল না। কয়েক বছর পর একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখতে পাই সিভিল পোশাকে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">জিজ্ঞেস করলাম আপনি এখানে কিভাবে? উত্তরে বললেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার জয়েন করেছি। ওই চাকরি আসলে আমার জন্য নয়।’ যাঁরা সাহিত্য পড়েছেন, তাঁদের পক্ষে বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব চাকরি ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু এসব উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের খবর কোনো মিডিয়ায় সেভাবে দেখা যায় না।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">পত্রিকায় ঘটা করে দেখা যায়, অমুক দোকানদারের ছেলে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। অমুক দরিদ্র পরিবারের ছেলে বা মেয়ে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাজটি করে ফেলেছেন তাঁরা। বিষয়টা এমন যে পৃথিবীতে বিসিএস ক্যাডার ছাড়া যেন আর কোনো চাকরির মূল্য নেই।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এ সপ্তাহেই বাসায় আসা এক মেহমান বললেন, ‘আমি একটি কাজ করতে যাচ্ছি, সেখানে সব বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা থাকবেন।’ তাঁর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাঁর নিজের বড় ভাই, যিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাঁর কথা জিজ্ঞেস করলাম। জানালেন, তিনি অবসরে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বিষয়ে যোগ্য অধ্যাপক নেই বিধায় বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দুই বছরের এক্সটেনশন দিয়েছে। বাংলাদেশে এই কৃষিবিদদেরই বেশি বেশি প্রয়োজন। এ দেশে যত গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে, তার কোনটা জনগণ ও দেশের কাজে লেগেছে বা কে কী জেনেছে সেই গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কে? শুধু কৃষি গবেষণার ফলে শাক-সবজি, ফলমূল, শস্য থেকে শুরু করে কোটি কোটি মানুষের জীবনধারণের জন্য পণ্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">অথচ বিসিএস ক্যাডারে তাঁদের কোনো মাহাত্ম্যই নেই। সবই যেন প্রশাসন ক্যাডার! একটি উপজেলা ও জেলায় প্রথম পজিশন হবে কৃষি কর্মকর্তার, তারপর হবে শিক্ষা কর্মকর্তার, তারপর হবে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের। বাকি সব ক্যাডার হবে এই ক্যাডারগুলোর পরের। কিন্তু পুরোপুরি উল্টো বিষয় ঘটে চলেছে ৫০ বছরের অধিক কাল ধরে পুরোপুরি স্বাধীন হওয়া এ দেশে! ব্রিটিশরাজ প্রবর্তিত প্রশাসনের যে দর্শন, তা-ই থেকে গেল। দর্শন পড়ুক, সাহিত্য পড়ুক, বিজ্ঞান পড়ুক, ইঞ্জিনিয়ারিং আর ডাক্তারি, যে যা-ই পড়ুক, এখন সবাই হতে চায় প্রশাসক আর পুলিশ। কী শিক্ষা আমরা পাচ্ছি, আর কী শিক্ষা দিচ্ছি? আর কেনই বা দিচ্ছি?</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/21-06-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" height="230" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/21-06-2024/2/kalerkantho-ed-2a.jpg" width="322" />কী শেখানো হচ্ছে আমাদের সমাজে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে? সমাজকে আমরা কোথায় নিয়ে গিয়েছি! ৪০তম বিসিএসের একজন বুয়েটিয়ান অ্যাডমিন ক্যাডার ছেড়ে চলে এসেছেন এবং দীর্ঘ একটি পোস্ট দিয়েছেন ফেসবুকে। তিনি ওই ক্যাডারে ৮০ দিন কাজ করার পর স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়ে চলে এসেছেন। এটিই ছিল তাঁর প্রথম এবং একমাত্র সরকারি চাকরি। কিছু বিষয় তাঁর কাছে অদ্ভুত লেগেছে, তাই ছেড়ে এসেছেন। বুয়েটের বেশির ভাগ মেধাবী শিক্ষার্থীকে তথাকথিত ঠাটবাটের জীবন যে খুব একটা আকৃষ্ট করবে না সেটি বুঝি, কিন্তু মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি বুয়েটের শিক্ষার্থীও নিজেদের অর্জিত বিশেষায়িত জ্ঞান পেছনে ফেলে রেখে হচ্ছেন পুলিশ কিংবা প্রশাসক। একই কাজ করছেন ডাক্তার ও কৃষিবিদরাও।</p> <p style="text-align: justify;">অ্যাডমিন ক্যাডার ছেড়ে আসা একজন লিখেছেন, ‘অ্যাডমিন ক্যাডারে ছুটি নেই, ছুটি নিলে নাকি ভালো কর্মকর্তা হওয়া যায় না। বলা হয়, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সব কিছুই অ্যাডমিন ক্যাডারদের করা লাগে। তাই সব কাজ ভালো লাগবে না আবার সব কাজ খারাপও লাগবে না। অনেক কিছুই করার সুযোগ আছে, কিন্তু ইনোভেশনের সুযোগ নেই। কাজ কিভাবে হয় সব ২৫০ বছর ধরে ঠিক করা আছে। এটা মেনে নিতে পারলে খারাপ না। সবচেয়ে ভালো দিক হলো আপনি সব জায়গায় নেতা হবেন আর সব ভালো কাজের রিকগনিশন পাবেন আপনার বস। অ্যাডমিন ক্যাডারে হিপোক্রাসির প্রয়োজন হয় খুব।...দেশের মূল সমস্যা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, কালচার—সব কিছু বিসর্জন দিয়ে কৃষিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষক সবাই হতে চান প্রশাসক। গন্তব্য হয় অ্যাডমিন ক্যাডার। কিন্তু কেন? কে দেখবে এসব? সবাই যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে। কোটি কোটি মানুষের জন্য উৎপাদনমুখী কাজ, সৃষ্টিশীল কাজ, প্রকৃত শিক্ষা ও জ্ঞান নিয়ে যেখানে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে সব কিছু বাদ দিয়ে শিক্ষিতরা প্রশাসক আর পুলিশ হবেন! এ কী খেলা শুরু হলো দেশে?’</p> <p style="text-align: justify;">অতি সম্প্রতি তথ্য ক্যাডারের আরেকজন কর্মকর্তা ক্যাডার সার্ভিস ছেড়ে নন-ক্যাডারে (সাবরেজিস্ট্রার পদে) যোগ দিয়েছেন। আর সব পত্রিকার পাতা এই খবরে ছেয়ে গেছে। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন। একজন সাবেক সচিব লিখেছেন, ‘সবাই ছেলেটিকে গালমন্দ করছেন। করাটা অযৌক্তিক নয়। ছেলেটি গালমন্দ খাবারই যোগ্য, তবে আমার একখান কথা আছে।’ তিনি তথ্য ক্যাডারের এবং প্রশাসন ক্যাডারের অনেক বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বড় পদে যেতে মরিয়া হয়ে উঠি। বড় পদ পেয়েও যাই, কিন্তু বড় পদ পাওয়ার দায় শোধ করি না। বড় পদের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে এবং দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করে দিন পার করতে চাই। জনশ্রুতি রয়েছে, রেডিও বাংলাদেশের জনবল ব্যবস্থাপনায় মহাগিট্টু লেগে লেজে-গোবরে হয়ে আছে। সেখানে পদোন্নতির জটিলতা এতই তীব্র যে হতাশ হওয়া ছাড়া ন্যূনতম আশার আলো নেই। জটিলতা দেখার ও দূর করার কেউ নেই। তাই এই ছেলেটির চলে যাওয়াকে কেউ কেউ নীরব প্রতিবাদ হিসেবেও দেখছেন।’ এই বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ রকম অনেক মন্ত্রণালয়ের অনেক বিভাগেই গিট্টু লেগে থাকে, বছরের পর বছর কেউ সেখানে কিছু করার জন্য এগিয়ে আসেন না। অ্যাডমিন ক্যাডারের লোকজনই সেসব জায়গায় পোস্টিং হয়, দু-একজন গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তাঁরা সব গিট্টু খুলে পদোন্নতিসহ অন্যান্য পদ এবং অন্যান্য জায়গা মসৃণ করেন। অর্থাৎ ব্যক্তির কারণেই এ ঘটনা ঘটে। তিনি সিএসপিদের প্রশংসা করেছেন। কারণ তিনি তাঁদের অনেককে কাছ থেকে দেখছেন। ‘বর্তমানে যাঁরা কর্মকর্তা, তাঁরা কাকাসুমারা, মারকাট করে পদ-পদবি দখলে ব্যস্ত। কেউ কেউ বছর না যেতেই একটার পর একটা বড় মন্ত্রণালয় বাগিয়ে নেন। তাঁদের ব্রত কাজ নয়, পদই ধর্ম, পদই জীবন, পদ বাগাও, ভোগ করো, কাজের খেতা কিলাও, কেবল পদের পেছনে দৌড়াও।’ </p> <p style="text-align: justify;">যখন বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়, সভা-সেমিনার হয়, অনেকেই বলেন এবং আশা করেন যে সরকার এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করবে, যেখানে শিক্ষিত হলে মানুষ এসব আর করবে না—এমন শিক্ষা তাঁরা রাষ্ট্র বা সরকার থেকে আশা করেন।</p> <p style="text-align: justify;">সরকারি চাকরির কিছু ক্যাডারের কিছু বিশেষত্ব থাকবে, কিন্তু স্বাধীন দেশে সব কিছুই হবে জনগণের কল্যাণে। তাদের ভয় দেখানোর জন্য, তাদের কাছে দুর্ভেদ্য কিছু প্রমাণ রাখার জন্য, ব্রিটিশ আর পাকিস্তানের প্রশাসকদের চরিত্র প্রদর্শনের মতো যাতে কিছু না হয়। বিশেষত্বে পরিপূর্ণ এই জীবন সবার ভালো লাগবে না, সবার সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ার কথা নয়। এক ধরনের মাদকতা অনেককে আটকে রাখে, যা ক্রিয়েটিভ ও মুক্তমনাদের আকর্ষণ করবে না। তাঁদের কাছে নতুন কিছু সৃষ্টি শুধু আদেশ পালন করা আর নিরীহ জনগণের ওপর ক্ষমতার লাঠি প্রদর্শন করা কখনো ভালো লাগবে না। তাই দেখতে পাই, অন্তত কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বুয়েটিয়ান যথাক্রমে পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডার ছেড়ে এসেছেন।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক :</strong> শিক্ষা গবেষক, সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ</p> <p style="text-align: justify;">masumbillah65@gmail.com</p> </article>