<article> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশের রাজনীতি বেশ কয়েক বছর ধরে কেবল নির্বাচনের বেড়াজালে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিরোধীরা একভাবে নির্বাচন চায়, তো সরকারপক্ষ অন্য পথে হাঁটে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একসময় বড় ধরনের অনাস্থা তৈরি হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার উদ্ভাবন করা হয়েছিল, কিন্তু সেটিও নেপথ্যের শক্তি দ্বারা হাইজ্যাক হয়ে যায়। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শক্তি সেটিকে আরো পাকাপোক্তভাবে পেতে চায়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ার পর রাষ্ট্রক্ষমতায় ভিন্ন শক্তির দখলদারি দুই বছরের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় বিরাজনৈতিকীকরণসহ অনেক কিছুই করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতা দখলকারীরা কিছুতেই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। শেষমেশ ভালোয় ভালোয় নির্বাচন সম্পন্ন করে তারা ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়। সে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় দেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">দেশের সর্বোচ্চ আদালত গণতন্ত্রের মূলসূত্রে ফিরে যাওয়ার পথ দেখালেন। সরকারি দল আদালতের দেখানো পথ মেনে নিল, কিন্তু বিরোধীরা মানল না। সেই থেকে আবার নতুন করে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষের অবস্থান দুই মেরু অভিমুখী হতে থাকল। সরকারপ্রধান বিরোধীদলীয় প্রধানকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি ব্যবস্থার উদ্ভাবন করতে চেয়েছিলেন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবও তিনি আলোচনার টেবিলে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা অনির্বাচিতদের ওপর ছেড়ে না দিয়ে নির্বাচিত সরকারি এবং বিরোধীদলীয় প্রায় সমানসংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠন করা এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি পথ সৃষ্টি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় বিরোধী দল তা প্রত্যাখ্যান করে। তাদের হিসাব ছিল সরকারকে আন্দোলনের মাধ্যমে উত্খাত করে নিজেদের মতো করে সব কিছু সাজানোর। সেবার দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল, তা ছিল কল্পনারও অতীত।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">দেশ গভীর সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক সংকটে পড়তে যাচ্ছিল। ক্ষমতাসীন সরকার চরম মূল্যে সেই সংকটকাল অতিক্রম করেছিল।</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="মতাদর্শের দ্বন্দ্ব" height="336" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/30-04-2024/mk/kk-6-2024-04-30-01a.jpg" width="400" />অন্যদিকে বিরোধী শক্তিকে আর স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা যায়নি। এখানে বলে রাখা ভালো, নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বটি কেবল দুই দলের দ্বন্দ্ব ছিল না। এটি ছিল বাংলাদেশে পঁচাত্তর-পরবর্তী পরস্পরবিরোধী মতাদর্শেরও দ্বন্দ্ব। অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার দ্বন্দ্ব। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় সেসব শক্তি অবস্থান করে অসাম্প্রদায়িক এবং তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নিধনে যেভাবে অভিযান পরিচালনা  করেছিল, ২১ আগস্ট ঘটিয়ে ছিল, তাতে গণতান্ত্রিক এবং অগণতান্ত্রিক শক্তির স্বরূপটিও প্রকাশ্য হয়ে যায়। তা ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতির এই দুই পরস্পরবিরোধী ধারার দ্বন্দ্ব আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। সেটিরও প্রভাব পড়েছিল ২০১৩-এর নভেম্বর, ডিসেম্বরের অগ্নিসন্ত্রাস এবং ২০১৪-এর নির্বাচনে। তখন থেকেই নির্বাচন কেবল এই দুই পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের শক্তির রশি টানাটানিতে পরিণত হয়।</p> <p style="text-align: justify;">বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী পক্ষটি ২০১৪ কিংবা ১৮-এর চেয়ে অনেক বেশি চেহারাগত পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। আন্তর্জাতিক নানা গোষ্ঠীও এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়েছিল। কিন্তু বিরোধী পক্ষ নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে একটা বড় ধরনের সাংবিধানিক সংকট তৈরির যে হিসাব-নিকাশ নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল, তা সফল করা যায়নি। বিরোধীরা সরকার উত্খাত বা সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারেনি। আন্দোলনের জ্বালাও-পোড়াও চরিত্রটিও সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। বিরোধীরা হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগের ব্যর্থ কর্মসূচি দিয়েছিল। এটি তাদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি।</p> <p style="text-align: justify;">নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য না হওয়ার যে দাবি বা অভিযোগ বিরোধী পক্ষ করেছিল, তা-ও খুব একটা গতি পায়নি। নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ প্রমাণিত হলে জনগণ আন্দোলনে অংশ নিতে কার্পণ্য করে না, এটি ১৯৯৬ সালেই প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিরোধীরা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়ে নির্বাচন নিয়ে যেসব অভিযোগ করতে থাকে, তা প্রমাণ করার সুযোগ ছিল না। মূল বিরোধী দল না থাকলেও ৭ জানুয়ারির নির্বাচন এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় এবং সরকার নির্বাচন পর্বটি উতরে যায়। বিরোধী দল ভাবতে পারেনি এভাবে সরকার উতরে যাবে এবং বিদেশিরাও নির্বাচনকে মেনে নেবে। তার পরও বিরোধীরা আশ্বস্ত হতে চাইল না। তারা সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং উপজেলা বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তাদের তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাই দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রার্থী হলেন। দল তাঁদের বহিষ্কার করেছে, কিন্তু তাতেও কেউ ভীত বলে মনে হয় না। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক কিংবা দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেয়নি। কিন্তু দলের এমপি, মন্ত্রী এবং প্রভাবশালীদের অনেকেই তাঁদের পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের প্রার্থী করে উপজেলার রাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। দলীয় প্রধান তাঁদের উপজেলা নির্বাচন থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও অনেকে দলীয় প্রধানের নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগে এ ধরনের প্রবণতা অতীতে কিছু দেখা গেলেও এবার সেটি একটু বেশি বলেই মনে হচ্ছে।</p> <p style="text-align: justify;">বিরোধীরা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অনাস্থা এবং বর্জনের যে ধারায় চলছে, তাতে গণতান্ত্রিক ধারায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সুযোগ কমে যায়। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনেরও আশঙ্কা থেকে যায়। সম্ভবত আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত এই ধারায়ই থাকতে চায়। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ এই সমস্যাটি নেতাকর্মীদের মধ্যে রাজনৈতিক বাস্তবতা উপলব্ধি না করারই বার্তা দেয়। এমনকি তাঁরা দলীয় প্রধান ও নীতিনির্ধারকদের কৌশল বা অবস্থানকেও খুব একটা আমলে নিতে চাচ্ছেন না। ফলে বিরোধীরা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ যেসব অভিযোগ আনে কিংবা যেভাবে সরকারের নেতিবাচকতা দেখাতে চায়, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, মন্ত্রী, এমপি তাকেই এগিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন যেন। বিরোধীরা যেসব কৌশল নিচ্ছে, তা তাদের জন্যই বুমেরাং হবে কি না, সেটি অনেকটাই নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের স্বচ্ছ নীতি-কৌশল থাকা না থাকার ওপর। মোটাদাগে বলা চলে, দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি বা সরকারি দলের চলার পথে গর্ত খোঁড়ার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ সেই গর্ত ভরাট করবে, নাকি গর্ত আরো গভীর করার ক্ষেত্রেই অবদান রাখবে, সেটিই এখন রাজনৈতিকভাবে বোঝার বিষয়। </p> <p style="text-align: justify;"><b>লেখক : </b>ইউজিসি বঙ্গবন্ধু ফেলো এবং সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়</p> </article>