<article> <p style="text-align: justify;">১৩১৩ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পূজা পর্বের গান ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি’। হাম্বীর রাগে সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে গীত গানটি এখনো অনেকের কানে বাজে। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শংকর ‘কত অজানারে’ নামে একটি কালজয়ী উপন্যাস লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‌‘সংসার পরিক্রমার পথে কত বিচিত্র সঞ্চয়ই যে দিনে দিনে পর্যাপ্ত হয়ে ওঠে তার বুঝি ইয়ত্তা নেই।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">যা একদিন অচেনা থাকে, অজানা থাকে, তাকেই আবার চিনে ফেলি, জেনে ফেলি। অপরিচয়ের অবগুণ্ঠন খুলে কখন সে-ই আবার ধরা দেয় মনের কাছে। এই এমনি করেই সঞ্চয়ের পুঁজি একদিন ভারী হয়ে ওঠে, আর স্মৃতির আকাশে রং ধরে তখনই।’</p> <p style="text-align: justify;">শংকর বলেছেন স্মৃতির আকাশে রং ধরার কথা।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আবার এই স্মৃতির আকাশে কিন্তু জং ধরে, ধুলা পড়ে। কারো কারো স্মৃতিভ্রম হয়। অনেকেরই স্মৃতিবিভ্রাট ঘটে। ‘ভুলে যাওয়া’ একটা রোগ।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কেউ কেউ আবার কল্পনার রং চড়াতে এমনই ওস্তাদ যে অনেক ক্ষেত্রে সেটা আর কল্পনা থাকে না। ডাহা মিথ্যাচার হয়ে হয়ে যায়। রাজনীতিতে এমন মিথ্যার চর্চা অবশ্য নতুন কিছু নয়। দেশে-বিদেশে সর্বত্রই হয়। কাউকে কাউকে মহীয়ান করতে গিয়ে এই মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া হয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এই মিথ্যাচার করতে গিয়ে দেখা যায়, কাউকে নায়ক বানাতে গিয়ে খলনায়ক বা ভিলেনে পরিণত করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">ঠিক এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে নতুন একটি বয়ান দিয়েছেন। বলা চলে, নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন তিনি। তাঁর দাবি, ‘২৭ মার্চের আগেও জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর সেটি ছিল ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে।’ তিনি বলেছেন, ‘এটাই স্বাধীনতা ঘোষণার প্রকৃত ইতিহাস।’ অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক।’ বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, এটা একেবারেই অস্বীকার করছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা খাটো করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘জনাব শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের তারা তখন বিভোর ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য।’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বর্ণনার জন্য এক নয়া ইতিহাসবিদ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাহেবকে পাওয়া গেল। না মোটেই ‘ভুলে যাওয়া রোগে’ পেয়ে বসেনি তাঁকে। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই কথাগুলো বলেছেন। চেয়েছেন বিতর্ক সৃষ্টি করতে। নিজে বিএনপি থেকে তো বিতাড়িতপ্রায়। হৃত অবস্থান ফিরে পেতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে তাই কুণ্ঠা বোধ করেননি। একটুও দ্বিধান্বিত হননি।</p> <p style="text-align: justify;">হাফিজ উদ্দিন আহম্মদরা বারবারই ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করেছেন ও করছেন। জাতিকে তাঁরা কী মনে করেন? তাঁদের কাছ থেকে নতুন করে ইতিহাসের পাঠ নিতে হবে?   </p> <p style="text-align: justify;">২৫ মার্চ রাতের অপারেশন সার্চলাইটের কথা আমরা জানি। আমরা জানি ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘...বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান...’।</p> <p style="text-align: justify;">১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ২৭ মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশিত হয়। ২৭ মার্চ গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, ‘...২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেওয়ার পরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে।’ দিল্লি থেকে প্রকাশিত দ্য স্টেটসম্যানের খবরে বলা হয়, ‌‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।’ ২৭ মার্চ ‌‘বেঙ্গল ইনডিপেনডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস হেরাল্ড।</p> <p style="text-align: justify;">২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘‌বাংলাদেশের একটাই মানুষের ঘোষণার অধিকার ছিল, আর তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এটা নিয়ে যে বিতর্ক আসতে পারে, সেটাই তো কেউ কখনো চিন্তা করেনি।’ এমনকি জিয়াউর রহমান নিজেও কখনো এই বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেননি। তিনি কখনো নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি করেননি। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৪ সালের ২৬ মার্চ অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করা হয়। নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‌‘৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্তরূপ দিলাম।...তারপর এলো সেই কালো রাত। ২৫শে ও ২৬শে মার্চের মধ্যবর্তী কালো রাত।...২৬শে মার্চ। ১৯৭১ সাল। রক্ত অক্ষরে বাঙালীর হৃদয়ে লেখা একটি দিন। বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন স্মরণ রাখবে এই দিনটিকে। স্মরণ রাখতে ভালোবাসবে। এই দিনটিকে তারা কোনো দিন ভুলবে না। কো-নো-দি-ন না।’</p> <p style="text-align: justify;">এখন নব্য ইতিহাসবিদ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাহেব কী বলতে চাইছেন? এসব খবর মিথ্যা? ১৯৭১ সালে যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, সবই তাহলে মিথ্যা! তবে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক প্রমাণ করতে গিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ জিয়াকেই মিথ্যাবাদী প্রমাণ করে ছাড়লেন। বিএনপি কি তাদের ওয়েবসাইট থেকে জিয়াউর রহমানের এই লেখাটি সরিয়ে নিয়েছে?</p> <p style="text-align: justify;">উপমহাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮০ সালে। এই ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রের মুখ দিয়ে ছড়ায় ছড়ায় কিছু সংলাপ উচ্চারিত হয়েছে। এসব সংলাপ এখনো অনেকের মুখে মুখে ফেরে। তারই একটি হচ্ছে, ‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’। হাফিজ উদ্দিন আহম্মদদের মতো নব্য ইতিহাসবিদদের কাছ থেকে আরো কত বিকৃত ইতিহাস শুনতে হবে, জানতে হবে—কে জানে! বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, হাফিজ সাহেব যেদিন এই ইতিহাস বয়ান করলেন, সেদিনই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে ইফতারিতে মোলাকাত করেছে বিএনপি। আহারে রাজনীতি!</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক</strong><b><strong> :</strong> </b>সাংবাদিক</p> <p style="text-align: justify;">habib.alihabib@gmail.com</p> </article>