<article> <p>মানসিক সুস্থতাকে সহজ ভাষায় আমরা মন-মনন ও আবেগ-আচরণের স্বাভাবিক, ভারসাম্যপূর্ণ ও ঈপ্সিত অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। একে ‘ব্যক্তিত্বের পূর্ণ এবং সমন্বয়পূর্ণ কার্যকারিতা’ বলেও আখ্যায়িত করা যায়। আর আমাদের চারপাশে অনবরত ঘটে যাওয়া যাবতীয় ইতিবাচক ঘটনাবলিকে ‘কল্যাণ’ পদবাচ্যে অভিহিত করা যেতে পারে। বস্তুতপক্ষে সমাজে একজন মানুষের যাপিত জীবনে মানসিক সুস্থতা ও কল্যাণ—এই দুটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করে।</p> </article> <p>আমরা মানসিক সুস্থতা ব্যতীত কেবল শারীরিক সুস্থতা দিয়েই সব কাজ করতে পারি না। এ জন্য যেকোনো মানুষের জন্যই শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার পাশাপাশি মানসিকভাবেও সুস্থ থাকা একান্ত জরুরি। তা না হলে একজন মানুষ শারীরিকভাবে যতই কর্মক্ষম আর সম্ভাবনাময় হোক না কেন, তার সব কিছুই দিনশেষে অপূর্ণতা ও অনুশোচনায় পরিণত হতে পারে শুধু মানসিক সুস্থতার অভাবে। জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার তৃতীয় অভীষ্টে সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ অর্জনের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।</p> <p>আমাদের সরকারও এসডিজির এই লক্ষ্যমাত্রা ৩.৪-এর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। উপরন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতি ও কর্মসূচিতে এর ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জরিপে উঠে এসেছে যে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৭.৩ শতাংশই মানসিক বৈকল্যের শিকার।</p> <p>বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মাদকাসক্তি, আত্মহত্যার চেষ্টা, অতি চঞ্চলতা, বুলিং, সাইবার ক্রাইম, গ্যাং কালচার, ইন্টারনেট ও ফেসবুক আসক্তি তথা প্রেমঘটিত সম্পর্কের পরিণতিতে এ ধরনের মানসিক বিপর্যয়ের চোরাবালিতে প্রতিনিয়ত আটকে যাচ্ছে ভুক্তভোগীরা। আরো ভয়ানক জরিপ উঠে এসেছে গবেষণায় : দেশের ৮২ শতাংশ শিশু বুলিংয়ের শিকার হয়ে বেড়ে ওঠে, যা তাকে পরবর্তী সময়ে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলতে প্রভাব ফেলে। প্রকৃতপক্ষে মানসিক রোগ, যৌন হয়রানির শিকার, বুলিংয়ের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরের মানসিকতা বিকৃত ও ভঙ্গুর হবে—এটাই স্বাভাবিক।</p> <p>সর্বশেষ ২০১৮-১৯ সালের মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ বা দুই কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নানা ধরনের মানসিক জটিলতায় আক্রান্ত এবং প্রতি ১০০ জনের মধ্যে সাতজন বিষণ্নতায় ভুগছেন। অথচ স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার হলো যে ভুক্তভোগীদের ৯২ শতাংশই চিকিৎসার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে।</p> <p>অন্যদিকে ১৩.৬ শতাংশ শিশুও বিচিত্র ধরনের মানসিক অসুখে ভুগছে বলে জরিপে উঠে এসেছে, কিন্তু তাদের ৯৪ শতাংশই কোনো ধরনের চিকিৎসা পাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে প্রাণ হারায়। অথচ মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মহত্যার এই হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।</p> <article> <p><img alt="মানসিক সুস্থতা ও কল্যাণে চাই সচেতনতা" height="402" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/15-03-2024/6.jpg" style="float:left" width="500" />মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও মনোবিদদের মতে, তথ্য-প্রযুক্তির নিরবচ্ছিন্ন প্রসারমাণতা ও এর ওপর অত্যধিক মাত্রায় নির্ভরতা, বিশেষ করে মোবাইল, ইন্টারনেট ও ফেসবুকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মানসিক রোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। পাশাপাশি মাদকাসক্তিও একটি বড় কারণ, যা তরুণদের মধ্যে মানসিক সুস্থতাকে চরমভাবে বিঘ্নিত করে। বর্তমানে শুধু শিশু-কিশোর আর তরুণদের মধ্যেই নয়, বরং প্রবীণ ও বয়সী লোকজনের মধ্যেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের যে ভয়ানক প্রবণতা শুরু হয়েছে—এই শ্রেণির মানুষের মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার পেছনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তিকে দায়ী করেছেন। তাঁরা বলে যাচ্ছেন, কোনো ধরনের শারীরিক পরিশ্রম না করে শুধু এভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ফলে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিনিয়ত সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আর এর অনিবার্য পরিণাম হিসেবে শিশু-কিশোররা বড় হয়ে সমাজে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে। প্রায় সময় মনের ভেতর পুষে রাখা কথা বলতে না পেরেও মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় কেউ কেউ। এর ফলে দেখা দেয় নতুন নতুন সমস্যা। এ ব্যাপারে সন্তানের দিকে সবার আগে মা-বাবাকেই মনোযোগ দিতে হবে। আর সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অভিভাবকের সচেতন হওয়ার বিকল্পও অবশ্য তেমন একটা নেই।</p> <p>মানসিক সুস্থতা ও কল্যাণ সুরক্ষা একক কোনো প্রক্রিয়া নয় যে এটি স্রেফ একজনের দ্বারা অর্জিত হয়ে যাবে। এ জন্য দরকার সমন্বিত, সুপরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, দারিদ্র্য ও সামাজিক কুসংস্কার আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগের ঘাটতি রয়েছে—এ কথা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি এ বিষয়ে সীমাহীন উদাসীনতা ও অসচেতনতাও বর্তমান। উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের একটি বাস্তব ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাড়াতে হবে সচেতনতা। আমরা শারীরিক অসুস্থতাকে যেমন গুরুত্ব দিই, সেভাবে মানসিক অসুস্থতাকে পাত্তা দিই না। পরিতাপের বিষয় হলো যে মানসিক স্বাস্থ্য বলে কিছু একটা আছে, সেটাও অনেকে জানে না। আবার জানলেও আমলে নিতে চায় না। অথচ ব্যক্তির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয় মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে।</p> <p>জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল আমাদের চিন্তা, আবেগ কিংবা অনুভূতিই নয়, বরং কিভাবে আমরা প্রতিকূল পরিবেশেও মানসিক চাপের সঙ্গে মানিয়ে নেব, অন্যদের সঙ্গে মিশব এবং সুস্থ জীবন যাপন করব—সব কিছুতেই এটি প্রভাব বিস্তার করে। মানসিক সুস্থতা যাচাইয়ের তিনটি উপায়ের কথা উল্লেখ করা যায়—চিন্তা, ইচ্ছাশক্তি ও সমাজে নিজের অবদান সম্পর্কে সচেতন হওয়া। সবার জন্য ওষুধ না, নিজের আবেগ আয়ত্তে আনতে হবে। আর নিজেকে ভালোভাবে জানতে হবে, বুঝতে হবে। অন্যকে না, নিজেকে চিনতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে।</p> <p>মানসিক সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন সম্পর্কেও চিন্তা-ভাবনা করা জরুরি। ইতিবাচক যেকোনো পরিবর্তনকেই কল্যাণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সে হিসেবে মানসিকভাবে সুস্থ থাকাটাও খোদ কল্যাণেরই অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পেশাগত, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় তথা সামগ্রিক জীবনাচারে মানুষের পারিপার্শ্বিক বাধা-বিপত্তিগুলোর মূলোৎপাটনকেও কল্যাণ বলে বর্ণনা করা যায়। প্রকৃত অর্থে কল্যাণ সাধন ব্যতিরেকে মানসিক সুস্থতা অর্জন করা যায় না। এ জন্য মানসিক সুস্থতা ও কল্যাণ সাধন দুটি বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যক্তির যাপিত জীবনে কল্যাণ হাসিল হলেই কেবল জীবনের সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং সর্বতোভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক চলাফেরা করা সম্ভব হয়। এ জন্য কল্যাণ সাধনের বিষয়টি মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার নয়। একেও সমান গুরুত্ব প্রদান করা উচিত।</p> <p><b>লেখক : </b>অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ</p> <p>রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p> </article>