<article> <p style="text-align: justify;">ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমান্ত দীর্ঘ এক হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার। এই সীমান্তকে কেন্দ্র করে নরেন্দ্র মোদি সরকার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিল। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। আর এটা নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে এই সুদীর্ঘ সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে সুরক্ষিত করা হবে। সরকারিভাবে সেই উদ্যোগ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। অমিত শাহ আরো জানিয়েছেন, ভারত-মিয়ানমার যে ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম (FMR) এযাবৎ ছিল, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রীয় সরকার সেটা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে সেই প্রক্রিয়াটা তাদের দিক থেকেও শুরু করেছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবিলম্বে  FMR সাসপেন্ড করারও সরকারি নির্দেশ জারি করেছে।</p> <p style="text-align: justify;">এর ফলে ভারত ও মিয়ানমারের সম্পর্ক কী হতে পারে, সেগুলো নিয়েও যথেষ্ট ভাবছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর, মিয়ানমার সরকারকেও বোঝাচ্ছেন, কোন পরিস্থিতিতে এবং কেন ভারতকে এই সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে। আবার মিয়ানমার নিয়ে যে সমস্যা এবং ভারতের দিক থেকে তার যে মোকাবেলা, সেটা ভারত ও বাংলাদেশকে আরো কাছাকাছি এনে দিয়েছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এর কারণ বাংলাদেশও বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতকে এবং গোটা বিশ্বকে জানাচ্ছে যে মূলত যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, মিয়ানমার সরকারের উচিত, তাদের মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। কেননা তাদের শিকড় মিয়ানমারেই রয়েছে, যদিও শেখ হাসিনা সরকার মানবিক কারণে তাদের বলপূর্বক বিতাড়িত করছে না।</p> <p style="text-align: justify;">জাতিসংঘ, অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ভারতের মতো বহু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন অনুদান দেওয়া হয়। আর রোহিঙ্গাদের মধ্যে যাতে কোনো সামাজিক সমস্যা না হয়, তার জন্যও হাসিনা সরকার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের যত্পরনাস্তি দেখাশোনার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু নীতিগতভাবে বাংলাদেশের সরকার মনে করে, মিয়ানমার সরকারের এখনই তাদের ফেরত নিয়ে যাওয়া উচিত।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এ ছাড়া ভারতের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশকে এই মর্মে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে তারা মিয়ানমারের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করবে। জয়শঙ্কর নিজে গিয়ে বাংলাদেশকে বলেছিলেন। আবার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাও বলেছেন, কোনোভাবে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে যাওয়ার একটা সেফ প্যাসেজের ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেটা ভারত খতিয়ে দেখছে।</p> <p style="text-align: justify;">তবে এটা মেনে নিতে আমার অন্তত কোনো দ্বিধা নেই যে ভারত এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কূটনীতি করতে বাধ্য হয়েছে। এর কারণ মিয়ানমারের সীমান্তে চীন খুব সক্রিয়। চীন নানাভাবে সেখানে নির্মাণের কাজ করছে। পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ করছে এবং সখ্যও গড়ে তুলছে মিয়ানমারের সেনা শাসনের সঙ্গে। সেখানে যদি বাংলাদেশের জন্য ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পূর্ণ একটা বৈরিতার পথে চলে যায়, তাহলে ভারতের একটা অন্য বিপদ আসতে পারে। এতে চীন-মিয়ানমার অক্ষটা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এমনিতেই চীন ভারতের প্রতিবেশী সব রাষ্ট্রে থাবা বসাচ্ছে, ড্রাগনের নিঃশ্বাস এখন মালদ্বীপ থেকে শুরু করে নেপাল পর্যন্ত বইছে। শ্রীলঙ্কায়ও চীনের প্রভাব বিস্তারের পরিণতি আমরা দেখেছি।</p> <p style="text-align: justify;">অমিত শাহ কিছুদিন আগেই জানিয়েছিলেন, কাঁটাতার বেঁধেই তৈরি হবে নজরদারির জন্য আলাদা ট্র্যাক। মণিপুরের মোড়ে ইন্দো-মিয়ানমার যে ১০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, তা এরই মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। সেই সঙ্গে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাইব্রিড সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম বা কড়া নজরদারির ব্যবস্থার পাইলট প্রজেক্ট হয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মিয়ানমার সীমান্ত ঘিরতে এই তত্পরতার পেছনে মণিপুরের অশান্তিও একটা কারণ বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। মণিপুরের অশান্তি যে থামানো যাচ্ছে না, তার পেছনে বহিরাগতদের একটা মস্ত বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা তারা অনেকেই মিয়ানমার থেকে আসছে।</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও ভারত" height="270" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/February/12-02-2024/1.jpg" width="360" />গত বছরের মে মাস থেকে মেইতেই এবং কুকি-জো সম্প্রদায়ের সংঘর্ষ চলছে মণিপুরে। প্রাণ গেছে প্রায় ২০০ মানুষের। ঘরহারা হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। মণিপুরের বিজেপি প্রশাসন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ এই মেইতেইদের অভিযোগ হচ্ছে, মিয়ানমার থেকে জঙ্গিরা এসে কুকি জঙ্গিদের মদদ দিচ্ছে। এতে অশান্তি বাড়ছে। কুকি-জো সম্প্রদায় অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাদের দাবি, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং ভোটে ফায়দা নেওয়ার জন্যই মেইতেইদের বিরুদ্ধে অশান্তি ছড়াচ্ছেন।</p> <p style="text-align: justify;">দেশের ভেতর রাজনৈতিক অভ্যন্তরীণ বিতর্ক যা-ই হোক, বীরেন সিংয়ের প্রশাসন শুরু থেকেই এফএমআর বাতিলের পক্ষে ছিল। কেননা বীরেন প্রশাসনের দাবিই ছিল, মণিপুরের একটা বড় অংশ ইন্দো-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতার না থাকায় জঙ্গি, মানব চোরাচালনকারীদের বিনা বাধায় মণিপুরে ঢুকে তারা অশান্তি ছড়াচ্ছে এবং মণিপুরের কুকি জঙ্গিদের অস্ত্র জুগিয়ে মদদ দিচ্ছে। সম্প্রতি একটা সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে বীরেন সিং বলেছেন, আগের কেন্দ্রীয় সরকার, ইউপিএ সরকার আমাদের একা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমাদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। অসম রাইফেলস আছে, কিন্তু তারা জঙ্গিদের সামলাতে পারে না। সীমান্ত সুরক্ষিত করতে পারে না। মিয়ানমার এদিকে অশান্ত। সেখানেও তো তার সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্মিলিত আক্রমণে সীমান্তবর্তী অনেক এলাকায় মিয়ানমার সেনাও তো কোণঠাসা।</p> <p style="text-align: justify;">সরকারি সূত্রেরও খবর, গত কয়েক মাসে অন্তত ৬০০ মিয়ানমার সেনা তাদের পরিবার নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে মিজোরামের লংতলাই জেলায় আশ্রয় নিয়েছে। অশান্তির ভয়ে ভারতে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিকও রয়েছে। আসলে বাংলাদেশ ও ভারত দুই পক্ষেরই মাথাব্যথার কারণ। বাংলাদেশের সরকারি স্তর থেকে প্রতিনিধিরা ভারত সফরে এসেছিলেন এবং সেখানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে ভারত-বাংলাদেশ একজোট হয়ে কাজ করবে। এই বিষয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গেও বাংলাদেশের কথাবার্তা চলছে। পরে বিস্তারিত কর্মপদ্ধতি ঠিক করা হবে।</p> <p style="text-align: justify;">ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে যেসব ভারতীয় রয়েছে, তারা যেন এখনই সেখান থেকে অন্যত্র চলে যায়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যেসব ভারতীয় নাগরিক রাখাইনে যাওয়ার কথা ভাবছে, তারা কেউ যেন সেখানে এখন না যায়। ওখানকার পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। সব ধরনের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ল্যান্ডলাইন অকেজো হয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাল শুরু হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কখনো রোহিঙ্গা নিয়ে কোনো চিড় ধরেনি। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, মিয়ানমারের সেনারাও যথেষ্ট চাপের মধ্যে আছে। ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে বলছে, এখন সে দেশে না যাওয়াই ভালো। কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও সীমান্তবর্তী মিয়ানমার এলাকায় সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। সামরিক শাসকদের দখলে থাকা অনেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ বিরোধী বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে। এই সংঘর্ষের প্রভাব পড়ছে মূলত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার, বান্দরবান এলাকায়। মিয়ানমারের নাগরিকরা ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেই পালিয়ে আসছে। গোলাগুলি আছড়ে পড়ছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়। হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। দুই দেশের সংকট একই ধরনের। যৌথভাবে তাই এর মোকাবেলা করা যায় কী করে, আর সেটা কতটা সম্ভব, সেই বিষয় ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় উঠে এসেছে।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকার দেওয়া সত্ত্বেও তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন এবং মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে একযোগে কাজ করার বিষয়ে আলোচনা। একই সমস্যায় তো ভারতও জর্জরিত। তাই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ভারতের জন্য এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই কারণে অসামরিক ও সামরিক শরণার্থীর স্রোত বন্ধ করতে মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা অমিত শাহকে জানানো হয়েছে। মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরামের বিরোধিতাও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মিয়ানমারে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়ে উঠছে নতুন ভূ-রাজনৈতিক চালে। কিন্তু এই নতুন ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবেই করবে। যেমনটা অতীতেও অন্যান্য বিষয়ে তারা করে এসেছে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি</p> </article>