<article> <p style="text-align: justify;">দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আজ। নির্ধারিত হবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য কারা হবেন দেশের আইন প্রণেতা।</p> <p style="text-align: justify;">২০২৩ সালজুড়েই দেশের রাজনীতিবিদ, আলোচক, সুধীসমাজ, পেশাজীবীসহ সমাজের নানা স্তরের মানুষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় মুখর ছিল। আলোচনায় অংশ নিয়েছেন বিদেশি রাজনীতিবিদ, সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশের রাষ্ট্রদূত।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এ বছর বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ৪০টি দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যার শুরুটা করেছে বাংলাদেশ। শেষটা করবে যুক্তরাষ্ট্র আগামী নভেম্বর মাসে। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তার সামান্যতম অন্য কোনো দেশের নির্বাচন নিয়ে হয়নি।<br /> অনেক আলোচনা, শঙ্কা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি,  স্যাংশন, শ্রমনীতি ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবারের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে আলোচনায় থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের বড় একটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছে।</p> </article> <p style="text-align: justify;">এর পরও দেশ নির্বাচনী জ্বরে ভেসেছে। প্রচার-প্রচারণার কোনো কমতি ছিল না। হানাহানি, প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ—সবই হয়েছে। প্রশাসন নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকায় এবং নির্বাচন কমিশন শক্ত অবস্থান নেওয়ায় নির্বাচনকেন্দ্রিক বিশৃঙ্খলা এবং সন্ত্রাসের মাত্রা অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে অনেকটাই কম।</p> <article> <p style="text-align: justify;">সারা বিশ্বে একের পর এক আলোচিত সব ঘটনা ঘটে চলেছে। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ জোরদার, জাপানে এক দিনে ১৫৫ ভূমিকম্পের আঘাত, যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক রাজ্যের আদালতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা, সমুদ্রপথে পণ্যবাহী জাহাজে হুতি বিদ্রোহীদের হামলা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের পাল্টা আক্রমণ ও হুঁশিয়ারি, উত্তর কোরিয়ার আরেক ধরনের মারাত্মক হুঁশিয়ারিসহ আছে আরো অনেক খবর এবং আলোচনা। কিন্তু আমাদের দেশের নির্বাচনী হাওয়ায় এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেভাবে আলোচনায় আসেনি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">রাজনৈতিক খবরের কথা বাদ দিয়ে যদি অর্থনীতির খবরের কথায় আসি, তাহলে দেখা যাবে সেখানেও অনেক কিছু ঘটছে। বিশ্বের আর্থিক বাজারকে বলা হয় বছরের ৩৬৫ দিনের ২৪ ঘণ্টার বাজার।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">অর্থাৎ বিশ্বে আর্থিক বা মুদ্রাবাজার কখনো এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয় না। যখন ইউরোপের বাজার বন্ধ হয়, তখন এশিয়া এবং ওশেনিয়ার বাজার চালু হয়। আবার এশিয়া এবং ওশেনিয়া যখন বন্ধ হয়, তখন উত্তর আমেরিকা অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার বাজার চালু হয়। আর এই ২৪ ঘণ্টা ধরে চালু থাকা বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি আমাদের আন্তর্জাতিক লেনদেনে অংশ নিতে হয়, তখন তো নিজেদের অন্তত সেই পর্যায়ের কাছাকাছি নিতে হবে। গত বছরের শেষের দিকে জোর আলোচনা ছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ আর নীতিসুদের হার বা বেঞ্চমার্ক রেট বাড়াবে না, বরং এ বছর থেকে কমাতে শুরু করবে। ফলে অনেক আর্থিক বিশ্লেষক এবং অর্থনীতিবিদ একভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন এবং মতামত দিয়েছিলেন। এখন ফেডারেল রিজার্ভ বলছে যে নীতিসুদের হার বৃদ্ধির পর্ব সমাপ্ত হলেও কবে থেকে এই সুদের হার কমানো হবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। ফলে সব বিশ্লেষণ এবং মতামত ওলটপালট হয়ে গেছে, যার প্রতিফলন লক্ষ করা গেছে বছরের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের স্টক এক্সচেঞ্জে যখন শেয়ার মূল্যের ভালো দরপতন হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">এ বছর এমন এক সময় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যার মাত্র সাত দিন আগে ছিল ইংরেজি বছরের শেষ দিন। আমাদের দেশের বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের ব্যাবসায়িক হিসাব সম্পন্ন বা ক্লোজ করে ইংরেজি বছরের শেষ দিনে। বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের বার্ষিক হিসাব সম্পন্ন বা ক্লোজ করে ইংরেজি বছরের শেষ দিনে। আর এই দিনেই জানা যায়, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কম্পানি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতি, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ফলে জানুয়ারি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ ধরে চলে এসব খবর নিয়ে নানা রকম বিশ্লেষণ, আলোচনা এবং মতামত প্রদানের কাজ। এবার নির্বাচনী আমেজে এসব বিষয় সেভাবে স্থান করে নিতে পারেনি।</p> <p style="text-align: justify;">আমাদের দেশে গণতন্ত্র নেই বলে এক শ্রেণির আলোচক এবং পশ্চিমা বিশ্ব সমালোচনা করে। অথচ আমাদের দেশের মতো এ রকম নির্বাচনী আমেজ পশ্চিমা বিশ্বে কল্পনাই করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অনেক দেশে কখন নির্বাচন আসে আর কখন নির্বাচন শেষ হয়, তা ভালোভাবে বোঝার উপায় থাকে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে অংশ নিয়ে আমাদের দেশের মতো এক ধরনের উত্তেজনা বা জাতিগত বিদ্বেষ সৃষ্টি করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে একটু সরগরম অবস্থার সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া কানাডা বা পশ্চিমা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নির্বাচন নিয়ে তেমন শোরগোল দেখা যায় না। আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচনের দিন জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়, যা উন্নত বিশ্বে কল্পনাও করা সম্ভব নয়।</p> <p style="text-align: justify;">আমাদের জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে ছুটি দেওয়ার কারণে ভোটার উপস্থিতি যদি কম হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেননা এই ছুটির কারণে ভোটার একটানা তিন দিন ছুটি পাবেন। ফলে ভোটার ভোট দেওয়ার পরিবর্তে কোথাও ঘুরতে যেতে পারেন। এমনিতেই মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি আসক্তি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রাধান্য থাকায় ভোটদানে আগ্রহ কমে গেছে। তার ওপর অনেকেই দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়াকে অগ্রাধিকার দেন না। এই প্রবণতা যে শুধু আমাদের দেশে, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের দেশেও একই অবস্থা। ফলে এখানকার জাতীয় নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতির হার  ৫০ শতাংশ পার হতে চায় না।     </p> <p style="text-align: justify;">আমরা যতই গণতন্ত্রের কথা বলি না কেন, বিশ্বে এখন অর্থনীতির স্থানই শীর্ষে। অর্থ এবং অর্থনীতিই এখন সব কিছুর চালিকাশক্তি। অর্থনীতি যদি উন্নত না হয় বা শক্ত অবস্থানে না থাকে, তাহলে গণতন্ত্রও সেভাবে জায়গা করে নিতে পারে না। গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। দেশ পরিচালনার জন্য এই ব্যবস্থাটি থাকতে হবে, তাই আছে। বরং বলা চলে যে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করাই এখন আসল কথা।</p> <p style="text-align: justify;">আমাদের দেশের গণতন্ত্র নিয়ে যে বিশ্বের অনেক দেশেরই আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ, তারও অন্যতম কারণ আমাদের অর্থনীতির অভূতপূর্ব উন্নতি এবং সম্ভাবনা। তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশেও যেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি না হারায়, সেদিকেও সমান নজর দিতে হবে। সারা বিশ্বেই এখন অর্থনীতি সব কিছুর ওপরে। তাই আমাদেরও অর্থনীতিকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে। গণতন্ত্র থাকবে, নির্বাচন আসবে, নির্বাচন যাবে, কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন অব্যাহত থাকে পূর্ণমাত্রায়, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার স্বার্থে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক :</strong> সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা<br /> nironjankumar_roy@yahoo.com</p> </article>