<article> <p style="text-align: justify;">শীতের সকালে এসেছি মৌলভীবাজার জেলার বাইক্কা বিলে। মাথার ওপর দিয়ে ৯টি বুনোহাঁস উড়ে এলো। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর হাঁসগুলো ভালো করে  দেখলাম। ৯টিই ‘লালঝুঁটি-ভুতিহাঁস’; ছয়টি পুরুষ আর তিনটি স্ত্রী।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আগেই দল-পানা ও শাপলা-পদ্মের মাঝে চুপিসারে ভেসে ছিল দুই ডজন পরিযায়ী হাঁস।</p> <p style="text-align: justify;">লালঝুঁটিগুলো নামার পর তাদের আসরটি আরো রঙিন হলো।</p> <p style="text-align: justify;">পুরুষ লালঝুঁটি-ভুতিহাঁসের মুখ ও মাথা গাঢ়-লাল, আর চঞ্চুটি সিঁদুরে। মাথার ওপরে কমলা রঙের ঝুঁটি।</p> </article> <p style="text-align: justify;">ঝুঁটি উঁচু করলে সুদর্শন পুরুষগুলোকে দেখে মনে হয় হংসকুলের অভিজাত পাড়ার আপস্টার্ট পোলাপান।  ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ভুতিহাঁসের পূর্বরাগ শুরু হলে দেশের বড় বড় বিলে আজও তাদের লাল ঝুঁটি তোলা পুরুষদের সারিবদ্ধ সাঁতার দেখার সৌভাগ্য হয় আমাদের। তবে এই মনোহর দৃশ্য আর কত দিন  যে উপভোগ করতে পারব জানি না। ভুতিহাঁসের বিচরণক্ষেত্রগুলো দ্রুত সংকুচিত ও কলুষিত হয়ে যাচ্ছে।</p> <article> <p style="text-align: justify;">অগভীর পানির নিচে কাদামাটিতে জন্মানো নরম উদ্ভিদ ভুতিহাঁসের প্রধান আহার্য। মাছ আর ভুতিহাঁসই নিমজ্জিত এই উদ্যানের সত্যিকারের সমঝদার। শরীরটা ভেসে থাকার জন্য তৈরি বলে বেশির ভাগ হাঁস দেহকে পানির গভীরে নামাতে পারে না। শুধু ভুতিহাঁসেরাই ডুব দিয়ে বিলের তলের ডুবো উদ্যানে গিয়ে আহার ও বিহার করার ক্ষমতা রাখে। নিচে নেমে ওরা উদ্যান থেকে খাবার সংগ্রহের পাশাপাশি চঞ্চু চালনায় এর প্রুনিং অর্থাৎ কি না সাফসুতরো করা আর নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ বিষ্ঠা-সার প্রয়োগের জরুরি কাজ একই সঙ্গে সেরে ফেলে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">নিমজ্জিত এই উদ্যানগুলোর মূল্য দূরে থাক, এর অস্তিত্বের কথাই বেশির ভাগ লোক জানে না। জলজ উদ্ভিদ বলতে প্রায় সবাই বোঝেন পানিতে ভেসে চলা দল, পানা ও উলফিয়া, অথবা ওপরে জেগে থাকা শাপলা, মাখনা ও পদ্মের মতো উদ্ভিদ। লোকে সচেতন হওয়ার আগেই হয়তো এই নিমজ্জিত উদ্যানগুলো বিরান হয়ে যাবে। কারণ, শীতকালে অনেকেই পাম্প চালিয়ে বিল থেকে সব পানি সরিয়ে মাছ ধরে। শুকনা বিলে জলজ উদ্ভিদের কোঁড়া, চারা, বীজ সবই রোদে পুড়ে শেষ হয়। এই পোড়ামাটির বিলে পরের বর্ষায় পানি এলেও জলজ উদ্ভিদের বাগানটি আর সেভাবে গড়ে ওঠে না। আহার্য থাকে না বলে অমন বিলে মাছ হয় না। আসে না পাখিও।</p> <p style="text-align: justify;">মাছ ধরার জন্য সরকার বছরে ১১ হাজার জলমহাল ইজারা দেয়। ইজারার শর্ত থাকে, জাল দিয়ে মাছ ধরা যাবে, কিন্তু বিল শুকিয়ে নয়। তবে জাল দিয়ে মাছ ধরলে সব মাছ ধরা পড়ে না বলে অনেক ইজারাদারই শর্তের তোয়াক্কা না করে বাঁধ কেটে কিংবা পাম্প লাগিয়ে সেচ দিয়ে মাছ ধরেন। এভাবেই দেশের অনেক উর্বর বিল নষ্ট হয়েছে। ২৫ বছর আগেও মাছ ও পাখির জন্য খ্যাত ছিল পাশুয়া বিল। আমরা তখন শুমারিতে গিয়ে সেখানে ৫০ হাজার ভুতিহাঁস গুনেছি। তারপর প্রতি বছর বাঁধ কেটে বিলের পানি ফেলে মাছ ধরা হয়েছে পাশুয়ায়। বিলটি এখন এক ফসলি একটি ধানক্ষেত মাত্র। সেখানে আজ আর কোনো মাছ নেই, একেবারে হারিয়ে গেছে বুনোহাঁসেরাও।</p> <p style="text-align: justify;">সব মিলিয়ে পাঁচ প্রজাতির পরিযায়ী ভুতিহাঁস আজও শীতে বাংলাদেশে আসে, যার তিনটিই এখন ‘বিপন্ন’ বলে চিহ্নিত। লালঝুঁটি ছাড়া অন্যদের নাম ‘মরচে রং-ভুতিহাঁস’, ‘পাতি-ভুতিহাঁস’ ও ‘বেয়ারের-ভুতিহাঁস’। বেয়ারের-ভুতিহাঁস তো বিশ্বেই ‘মহাবিপন্ন’ পাখি।</p> <p style="text-align: justify;">লালঝুঁটি-ভুতিহাঁস এখন পর্যন্ত এক হিসাবে ভালোই আছে, আজও হাজার পাঁচেক হাঁস শীতে এসে বাস করে বাংলাদেশে। শীত শেষ হলে এরা যায় দূর উত্তরে, চীনও ছাড়িয়ে মঙ্গোলিয়ায়। গ্রীষ্মে জনবিরল দেশটির কোনো নিরালা জলার পারে অথবা ভাসমান পাতার বাসায় এরা ডিম দেয়। শীতে জলাভূমি বরফে ঢেকে যাওয়ার আগেই এ দেশে ফিরে আসে আবার। তবে এখানে বাসা বাঁধার দুর্বুদ্ধি না হয়ে ভালোই হয়েছে। এ দেশে বিলের পারে মাটিতে ডিম দিত শুধু দেশি মেটেহাঁস। ওদের ডিম দেওয়ার মতো জমিন আজ আর নেই কোনো বিলের কিনারায়। এখন ভুতিহাঁসের শীতের আশ্রয়টুকু টিকে থাকলেই আমরা কৃতার্থ!</p> </article>