<p>নিজের সবচেয়ে ভয়ানক দুঃস্বপ্নটি দেখা আমাদের যে কারো জন্যই বেশ ভোগান্তিমূলক। অথচ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদেরকে প্রতিদিনই এমন দুঃস্বপন্ন তাড়া করে বেড়ায়। এমনকি মানসিক রোগের জগতেও সিজোফ্রেনিয়া এখনো একটি ট্যাবু হয়ে আছে এবং এনিয়ে খুব বেশি একটা কথা বলা হয় না।</p> <p>সিজোফ্রেনিয়া তীব্র একটি মানসিক রোগ যার ফলে রোগী বাস্তবতার বোধ বা উপলব্ধি হারিয়ে ফেলেন। প্রায়ই তার হেলুসিনেশন হয়। অর্থাৎ বাস্তবে নেই বা ঘটছে না এমন কিছু ঘটতে দেখা বা শোনা। এবং ডিলিউশন হয় অর্থাৎ মনে এমন বিশ্বাস বা মনোবিকার থাকে যে, কেউ বুঝি তাকে গায়েব বা অদৃশ্য থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে বা তাকে হত্যা করার চেষ্ট করছে। এছাড়াও সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন, যেমন, হুট করেই একটি বিষয় থেকে এমন আরেকটি বিষয়ে কথা বলা শুরু করেন যার সঙ্গে আগেরটির কোনো সম্পর্ক নেই। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবন-যাপন থেকেও নিজেদের গুটিয়ে নেন। সিজোফ্রেনিয়াকে বলা হয় একটি জীবন্তু দুঃস্বপ্ন।</p> <p>সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা অন্যের ওপর সহিংসতা না করে বরং নিজেই সহিংসতার শিকার হন। এই রোগ পুরোপুরি ভালো হয় না। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অনেক সময় সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা লজ্জার কারণে কারো সাহাজ্য চাইতে আসে না। আবার অনেক সময় লোকে তাদেরকে ছেড়ে চলে যায়, কেননা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা অযথাই লোককে ভয় পায় যে তারা হয়তো তার ক্ষতি করবে। এ কারণে লোকে অনেক সময় সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদেরকে পাগল মনে করেন।</p> <p>কিন্তু সঠিক ধারণা না থাকলে লোকে আসলে বুঝতেই পারেন না সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত একজন মানুষ কীরকম দুঃসহ জীবন যাপন করেন। এখানে সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্তদের সম্পর্কে রইল এমন ৭টি বিষয় যা সকলেরই জানা দরকার।</p> <p><strong>১. সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা সহিংস নন</strong><br /> এরবরং নিজেদের সঙ্গেই সহিংসতা করেন অনেক সময়। তাদের ডিলিউশন এবং হেলুসিনেশন বা উৎকল্পনাগুলো যখন চরম মাত্রায় পৌঁছে যায় তখন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগী অন্যদের ক্ষতি না করে বরং নিজের ক্ষতি করেন। তবে সেসময় তারা জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলতে পারেন এবং দেয়ালে কিল-ঘুষি মেরে নিজেকেই আহত করতে পরেন। এসময় অন্য কেউ এসে তাদের পাশে দাঁড়ালে তারা বরং শান্ত হয়ে আসেন এবং বাস্তবতার বোধ ফিরে পান।</p> <p>এই রোগ জীবনভরই থাকে। ভালোবাসা এবং মানসিক সহায়তার মাধ্যমেই শুধু একজন সিজোফ্রেনিয়া রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়। সুতরাং আপনার কাছের কারো যদি এই রোগ থাকে তাহলে তাদেরকে মানসিকভাবে সহায়তা করুন। তাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দিন তাদের উৎকল্পনাগুলো বাস্তব নয়। এবং সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসলেই তারা সুস্থ থাকতে পারবেন।</p> <p><strong>২. এরা প্রতিদিনের স্বভাবিক কাজকর্ম করতে অক্ষম নন</strong><br /> সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সক্ষম নয় বলে মনে করা হয়। এবং তাদেরকে কোনো মানসিক চিকিৎসালয়ে নজরদারির মধ্যে রাখা উচিত বলেও বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু এই ধারণা ভুল। বরং সঠিক চিকিৎসা এবং ওষুধ দিলে তারা বরং কাজেকর্মে অন্যদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন।</p> <p><strong>৩. সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্তরা খুবই সৃজনশীল হয়ে থাকেন</strong><br /> প্রফেসর জন ন্যাশ একজন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত গণিতবিদ। যার সিজোফ্রেনিয়া ছিল। তাকে নিয়ে হলিউডে একটি বিখ্যাত সিনেমা বানানো হয়। সিনেমাটির নাম ‘অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড’। সিনেমাটিতে দেখানো হয় কী করে স্ত্রীর সহযোগিতায় জন ন্যাশ সিজোফ্রেনিয়া থেকে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গণিতবিদ হয়ে উঠেছিলেন। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চমাত্রায় সৃষ্টিশীল লোকদের চিন্তার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের মিল রয়েছে। সৃজনশীলতার নানা পরীক্ষায়-নিরীক্ষায় সাধারণের চেয়ে তাদের চিন্তা আনেক বেশি সৃষ্টিশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে। কোরিওগ্রাফির জগতে কিংবদন্তী শিল্পী নিজনস্কি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।</p> <p><strong>৪. সিজোফ্রেনিয়া শুধু বংশগত রোগ নয়</strong><br /> পূর্বপুরুষদের কারো মধ্যে এই রোগ থাকলে কারো সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। আর জমযদের কারো একজনের সিজোফ্রেনিয়া হলে অপরজনের তাতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৬৫%। কিন্তু এটি শুধু বংশগত রোগ নয়। পারিপার্শ্বিক নানা কারণে এই রোগ হতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো মাদক সেবন। এমনকি সৃজনশীল বা দার্শনিক চিন্তা করতে গিয়েও অনেকের সিজোফ্রেনিয়া হয়েছে।</p> <p><strong>৫. সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা আছে</strong><br /> এই রোগ হয়তো পুরোপুরি ভালো হয় না। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা সম্ভব। তবে এই রোগ অন্যান্য মানসিক রোগের মতোই আজীবন মাথার মধ্যে থেকে যায়। ফলে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদেরকে স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করার জন্য সবসময়ই চিকিৎসা নিতে হয়।</p> <p><strong>৬. সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা ‘পাগল’ নন</strong><br /> সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা প্রায়ই এই উৎকল্পনায় ভোগেন যে লোকে বুঝি তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বা তাদেরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে বা কেউ তাকে গোপনে নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব দেখে লোকে হয়তো তাদেরকে পাগল ভাবতে পারেন। তারা এমনকি অনেক সময় এও ভাবতে পারেন যে তাদের কল্পনার বাইরে বাস্তবে আর কিছুই ঘটছে না। তারা অনেক সময় এমন কিছু শুনতে পান যা অন্যরা শুনতে পায় না। অদৃশ্য সেই স্বর হয়তো তাদেরকে নিজের ক্ষতি করতে বলছে। তারা এমন কিছু দেখছে যা অন্যরা দেখছে না। যা হয়তো তাদের ক্ষতি করতে আসছে।</p> <p>এজন্য তাদেরকে ঠিক পাগল বলা উচিত নয়। এরা অনেক সময় জনসম্মুখে থাকলে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। এমনকি বেশিরভাগ সময়ই বাইরে থেকে বুঝা যায়না কেউ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত কিনা। কেননা তারা তাদের উৎকল্পনাগুলো কারো কাছে প্রকাশ করে না।</p> <p><strong>৭. সিজোফ্রেনিয়া সহজে শনাক্ত করনা যায় না</strong><br /> আপনার বন্ধুও যদি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে তিনি নিজে না বললে আপনি বাইরে থেকে দেখে তার রোগ ধরতে পারবেন না। জনসম্মুখে থাকার সময় সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরা তাদের উৎকল্পনাগুলোর প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না বা খুবই দক্ষতা ও সক্রিয়ার সঙ্গে তা অগ্রাহ্য করেন। যদিও অন্য কিছু আচরণ দেখে সিজোফ্রেনিয়ার রোগীকে শনাক্ত করা সম্ভব। যেমন, এরা অনেক সময় খুবই ধীরে এবং টেনে-হিচঁড়ে কথা বলেন। এরা অনেক সময় একই বাক্য বা শব্দ বারবার বলতে থাকেন। এবং হুট করেই একটি বিষয় থেকে আরেকটি বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন। যে দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। আর এই রোগ যখন তুঙ্গে থাকে তখন তারা সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারেন। কারণ তখন তাদের মনে এই উৎকল্পনা কাজ করে যে লোকে বুঝি তাদেরকে বিষ খাইয়ে হত্যা করবে।</p> <p>তবে একটু যত্ন করলে এবং ভালোবাসা দিলেই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত লোকরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারেন। এমনকি তারা সৃজনশীলতার অসামান্য নজির স্থাপন করতে পারেন।</p> <p>সূত্র: এনডিটিভি</p> <p> </p>