প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের ফিলিস্তিনের প্রতি অব্যাহত সমর্থন জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানানোর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কিংবা সম্পর্কও নেই বাংলাদেশের। এ ছাড়া বাংলাদেশের সাধারণ পাসপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ইসরায়েল ছাড়া সব দেশের জন্য এই পাসপোর্ট বৈধ।
ফিলিস্তিনকে সমর্থনের অনন্য দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ
- ► ইসরায়েলকে প্রত্যাখ্যানই শুধু নয়, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ আছে পাসপোর্টে
► আরব অনেক দেশের চেয়েও বাংলাদেশিরা সোচ্চার, সরকার আন্তর্জাতিক ফোরামে
মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ এস ওয়াই রামাদান কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের যে আন্তরিকতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, তা বিশ্বে বিরল। তিনি নিজে খুব কম দেশেই এমন ভালোবাসা দেখেছেন। ফিলিস্তিনের জনগণ বাংলাদেশের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ফিলিস্তিনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও এর জনগণের অধিকারের পক্ষে বাংলাদেশ সরব আছে। আগামীতেও থাকবে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্রগুলো বলছে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রকাশ্য ও আড়ালে অবস্থান—দুটিই শতভাগ ফিলিস্তিনের পক্ষে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ যখন মুক্তিযুদ্ধ করছে, তখন ফিলিস্তিনের জনগণ বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়েছে। তখন তারা তাদের সংবাদপত্রগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রামের খবর ব্যাপকভাবে প্রকাশ করেছে। খুব কম দেশই কিন্তু তখন আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেব না। কারণ আমরা জানি যে তারা দখলদার। তারা কিভাবে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড কেড়ে নিচ্ছে।’
ড. লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, ‘ফিলিস্তিনের সঙ্গে আমাদের ভাতৃত্বের সম্পর্ক কেবল ধর্মের ভিত্তিতে নয়; আমরা যখন তাদের মতো দুর্ভোগের শিকার হচ্ছিলাম তখন ফিলিস্তিনের জনগণ আমাদের সমর্থন-সহযোগিতা দিয়েছে। আমাদেরও দায়িত্ব তাদের পাশে দাঁড়ানো।’
ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘ইসরায়েল কিছুদিন পর পর ফিলিস্তিনে হামলা চালিয়ে বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয় যে ফিলিস্তিন আছে। তবে ফিলিস্তিনের প্রতি আমাদের সমর্থন যেন অব্যাহত থাকে, পররাষ্ট্রনীতিতে যেন ফিলিস্তিন ইস্যু কোনোভাবেই উপেক্ষিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ফিলিস্তিনের প্রতি আমাদের জনগণের জোরালো সমর্থন আছে।’
জানা গেছে, ফিলিস্তিন, বিশেষ করে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ১৯৭১ সাল থেকে। আরব দেশগুলোর বেশির ভাগই যখন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তখন ফিলিস্তিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে। তখন বাংলাদেশ চিকিৎসা, ত্রাণসহ বিভিন্ন সহযোগিতা পাঠিয়েছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি ফিলিস্তিন, পবিত্র আল-আকসার জন্য সশরীরে লড়াই করেছে। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের লাইব্রেরির ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ১৯৮৭ সালে প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি যুবক পিএলওতে যোগ দিয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়াই করেছে। বাংলাদেশ সব সময় ইসরায়েলের দখলদারির নিন্দা এবং ফিলিস্তিনের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানিয়ে আসছে। ১৯৭৪ সালে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াসির আরাফাত প্রথম দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছিলেন। এরপর ইয়াসির আরাফাত বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সফর করেন।
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণার পর থেকে জাতিসংঘের যে ১৩৮টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। ১৯৮০ সালে একজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধার ছবিসংবলিত ডাকটিকিটও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), জাতিসংঘেও ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশ সরব। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে এমন অনেক দেশের সঙ্গে ফিলিস্তিনের পাশাপাশি ইসরায়েলেরও নিবিড় সম্পর্ক ও সহযোগিতা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ সব সময় ইসরায়েলকে অন্য চোখে দেখেছে। বর্তমানে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার বিষয়টি সুরাহা করতে বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে চিঠি পাঠিয়েছেন। ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য ঢাকায় ফিলিস্তিন দূতাবাসে জরুরি ওষুধ ও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ।
সম্পর্কিত খবর

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি : অকালে ঝরা ফুল
যাঁদের হারালাম
নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবক রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছে স্কুলটির তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার (৯), সপ্তম শ্রেণির মাহতাব রহমান ভূঁইয়া (১৪), চতুর্থ শ্রেণির আয়মান (১০), সপ্তম শ্রেণির আব্দুল মুসাব্বির মার্কিন (১৪), সপ্তম শ্রেণির মেহনাজ আফরিন হুমাইয়রা (১৪), তৃতীয় শ্রেণির ওয়াকিয়া ফেরদৌস নিধি (৯), তৃতীয় শ্রেণির নুসরাত জাহান আনিকা (১০), অভিভাবক রজনী ইসলাম (৩৭) ও লামিয়া আক্তার সোনিয়া; তৃতীয় শ্রেণির সাদ সালাউদ্দিন (৮), সপ্তম শ্রেণির সামিউল করিম (১৩), সপ্তম শ্রেণির সায়ান ইউসুফ (১৪), তৃতীয় শ্রেণির সায়মা আক্তার (৯), তৃতীয় শ্রেণির রাইসা মণি (৯), অষ্টম শ্রেণির তানভীর (১৩), অষ্টম শ্রেণির মাহিয়া তাসনিম (১৪), পাইলট তৌকির ইসলাম সাগর (২৭), ষষ্ঠ শ্রেণির আব্দুল্লাহ শামীম (১৩), নাদিয়া তাব্বাসুম নিঝুম (১৩) ও তার ছোট ভাই দ্বিতীয় শ্রেণির আরিয়ান আশরাফ নাফি (৯), শিক্ষক মেহরিন চৌধুরী (৪৬) ও মাসুকা বেগম (৩৭), অভিভাবক আফসানা আক্তার (২৮), তৃতীয় শ্রেণির শারিয়া আক্তার (৯), দ্বিতীয় শ্রেণির বোরহান উদ্দিন বাপ্পী (৮), শিক্ষক জোবায়ের (৩০), শিক্ষার্থী জোনায়েত (৯), শিক্ষার্থী আফনান ফাইয়াজ (১৪), শিক্ষার্থী এরিকসন (১৩), শিক্ষার্থী ওমর নূর আশিক (১১), আসিফ, মারিয়াম উম্মে আফিয়া ও উক্য মারমা।

পরশুরাম সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত
- জামায়াতের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি
ফেনী প্রতিনিধি

ফেনীর পরশুরামে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে তিন বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজন নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত ১টা ৩০ মিনিটের দিকে উপজেলার গুথুমা বাঁশপদুয়া সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত মিল্লাত হোসেন পৌর এলাকার বাঁশপদুয়া গ্রামের ইউছুফ মিয়ার ছেলে এবং নিহত লিটন একই গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। আহত আবছারও একই গ্রামের মৃত এয়ার আহম্মদের ছেলে।
পরশুরাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. ইফতেখার হোসেন জানান, গুলিবিদ্ধ মিল্লাত হোসেনকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার আগেই তিনি মারা যান এবং মো. আবছারের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ লিটনকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু রাতেই তিনি মারা যান বলে খবর আসে।
এলাকাবাসী ও বিজিবি সূত্রে জানা যায়, ২১৬৪/৩ এস পিলারের কাছে বিএসএফের ৪৩ ব্যাটালিয়নের আমজাদনগর ক্যাম্পের সদস্যরা বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে গুলি চালান।
এ বিষয়ে ফেনী বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোশারফ হোসেন জানান, এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। কেন তাঁরা গভীর রাতে শূন্য রেখা অতিক্রম করেছেন বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। বিজিবির পক্ষ থেকে বাংলাদেশি নাগরিক নিহতের ঘটনায় বিএসএফকে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে। নিহত লিটনকে আনার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিএসএফের তাড়ায় একজন আহত : চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, শিবগঞ্জ উপজেলার সিংনগর সীমান্তের ওপারে বিএসএফের তাড়ার মুখে দেশে ফেরার পথে সেলিম মিয়া (২৫) নামের এক বাংলাদেশি চোরাকারবারি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বিজিবি।
সেলিম একই ইউনিয়নের তারাপুর পণ্ডিতপাড়া গ্রামের আরিফুল হক ওরফে হানিফের ছেলে। তবে তিনি কিভাবে আহত হয়েছেন তা বিজিবি জানাতে পারেনি। এ ছাড়া সীমান্তে গুলির কোনো ঘটনাও ঘটেনি বলে জানিয়েছে বিজিবি।
বিজিবি জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ৪টার দিকে সিংনগর বিওপির অধীন সীমান্ত পিলার ৪/৫-১ এস-এর কাছ দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে দুই-তিনজন চোরকারবারির একটি দল। এ সময় ৭১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের দৌলতপুর ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের চ্যালেঞ্জ করলে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বিজিবি ঘটনাটি জানার পর সেলিমের বাড়িতে খোঁজ করে তাঁকে পায়নি। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত আহত ব্যক্তির খোঁজ করেও তাঁর সন্ধান মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি লুকিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
জামায়াতের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি : দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে অন্যায়ভাবে হত্যা করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং জাতিসংঘের অধীনে সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে তিনি এ দাবি জানান।
জামায়াত আমির বলেন, ‘আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায়ই বিনা কারণে হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে ভারত বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও হত্যাকাণ্ড ক্রমাগত বাড়ছে। এসব হত্যাকাণ্ড ও ঘটনার আজ পর্যন্ত কোনো তদন্ত ও বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ সব সময় প্রতিবেশীদের কাছে বন্ধুসুলভ ও সম্মানজনক আচরণ কামনা করে। আশা করি, ভারত সরকার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে এবং বাংলাদেশি দুই যুবক মিল্লাত হোসেন ও লিটন হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। একই সঙ্গে আমরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সব বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতিসংঘের অধীনে আন্তর্জাতিক তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় বিবৃতিতে।

তারেক রহমানের নির্দেশ
নিহতদের বাসায় গিয়ে সহমর্মিতা ফখরুলসহ বিএনপি নেতাদের
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের বাসাবাড়িতে গিয়ে সহমর্মিতা জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। একই সঙ্গে তাঁরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে সমবেদনা ও শোক বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।
গতকাল শুক্রবার দলটির নেতারা নিহতদের বাসায় যান বলে জানিয়েছেন বিএনপির মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিকেল ৪টায় ঢাকার সেনানিবাসে অবস্থিত শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
আর মির্জা ফখরুল ইসলামের সঙ্গে ছিলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এ কে এম শামছুল ইসলাম। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যান রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে নিহত তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান আনিকাদের বাসায়।
দলের যুগ্ম মহাসচিব ও মিডিয়া সেলের সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি যান শিক্ষিকা মাসুকা বেগমের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে তাঁরা এই শিক্ষিকার কবর জিয়ারত করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে শোক ও সমবেদনা জানান।
জাতীয়তাবাদী মহিলাদলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসসহ দলের অন্য নেত্রীরা যান নীলফামারী জেলায়। সেখানে তাঁরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মেহরিন চৌধুরীর কবর জিয়ারত করেন, যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করে ২০ জন শিশুর প্রাণ রক্ষা করেছেন।
নীলফামারীতে জাতীয়তাবাদী মহিলা দল : নীলফামারী ও জলঢাকা প্রতিনিধি জানান, উত্তরায় শিক্ষার্থীদের জন্য জীবন উৎসর্গকারী মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মেহরিন চৌধুরীর কবর জিয়ারত করতে গতকাল শুক্রবার তাঁর গ্রামের বাড়িতে যায় বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের নেতৃত্বে মহিলা দলের নেত্রীরা নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ি চৌধুরীপাড়া গ্রামে পৌঁছান। তাঁরা কবর জিয়ারতের পর শিক্ষিকা মেহরিনের পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে তাঁদের প্রতি সমবেদনা জানান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য হেলেন জেরিন খান, মৃত মেহরিন চৌধুরীর স্বামী মনছুর হেলাল, নীলফামারী জেলা মহিলা দলের সভাপতি তাসমিন ফৌজিয়া ওপেল, লালমনিরহাট মহিলা দলের সভাপতি অ্যাডভোকেট জিনাত ফেরদৌস আরা রোজি, জলঢাকা উপজেলা মহিলা দলের সভাপতি নাসনি আক্তার ববি প্রমুখ।

‘কালো জামাটায় নুসরাতের গায়ের ঘ্রাণ লেগে আছে’
শিমুল মাহমুদ

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান আনিকা। নতুন জামার প্রতি একটা টান ছিল ওর। প্রায়ই বায়না ধরত নতুন জামা কিনে দেওয়ার। ছবি আঁকতে খুব পছন্দ করত আর পছন্দ ছিল পাখি পুষতে।
গত সোমবার রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় মারা গেছে নুসরাত। উত্তরার দিয়াবাড়ীর মেট্রো রেলের ডিপোর পাশেই নুসরাতদের বাড়ি।
ড্রয়িংরুমের যে সোফায় বসে নুসরাত টিভি দেখত, সেখানে বসে আছেন বাবা আবুল হোসেন। পাশেই নুসরাতের প্রিয় সাইকেলটি। ভেতরের রুমে বিলাপ করছেন মা পারুল বেগম।
আবুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘটনার পর নিখোঁজ মেয়ের মরদেহ পাই পাঁচ ঘণ্টা পর, সিএমএইচে। গিয়ে দেখি, মুখে শুধু কালো দাগ। চুলের বেণি, স্কুলের আইডি কার্ড, ইউনিফর্ম কোনো কিছুই পোড়েনি।’
আবুল হোসেন বলেন, ‘ঘটনা ঘটে ২১ জুলাই। এর দুই দিন আগে নতুন জামা কিনে দিতে আবদার করেছিল।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও বাবার হাত ধরে স্কুলে যায় নুসরাত। দুপুরে টিফিন নিয়ে যান মা পারুল বেগম। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর ১০ মিনিট আগেও আমার সঙ্গে কথা হয়। ক্লাস থেকে বের হয় মন খারাপ নিয়ে। জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু হয়েছে? কিছু বলেনি। তখন দুপুর ১টা। আমি ঠাণ্ডা একটা কোক, রোল আর একটা কেক টিফিন নিয়ে যাই। বললাম, টিফিন খেয়ে নিয়ো। কোচিং শেষে আমি না হয় তোমার বাবা এসে নিয়ে যাব।এর কিছুক্ষণ পর বিমান বিধ্বস্ত হলো।’
তিনি বলেন, ‘ঘটনার খবর শুনে স্কুলে গিয়ে দেখি, শ্রেণিকক্ষে স্কুলের ব্যাগ, টিফিন বক্স পড়ে আছে। মেয়ে আমার টিফিনটুকুও খেতে পারল না।’
নুসরাতের ঘরে ঢুকতেই চোখ যায় দেয়ালে তার ছবিটির দিকে। দরজায় ফুল, লতাপাতা, মাঝে আরবিতে ‘আল্লাহ’ লেখা হাতে আঁকা ছবি। বিছানার পাশে পড়ার টেবিল রাখা, ড্রয়িং খাতা, বাংলা ও ইংরেজি বই। এর পাশে ওয়ার্ডরোব।
নুসরাতের মা ওয়ার্ডরোব খুলে কালো রঙের জামা বের করে দেখান। মেয়ের জামা বুকে জড়িয়ে চুমু খেতে খেতে বলেন, ‘এই জামাটায় মেয়ের গায়ের ঘ্রাণ পাই। স্কুলে যাওয়ার আগে মেয়েটার এ জামা পরা ছিল। কিছুদিন পর পর আবদার করত নতুন জামা কিনে দিতে। কত জামা যে কিনে দিয়েছি, এর মধ্যে এই জামাটা বেশি পরত।’
তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল নুসরাত। মেজো বোন সুমাইয়া আক্তার রাত্রিও থাকত একসঙ্গে। সেও একই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে।
সুমাইয়া কালের কণ্ঠকে বলে, ‘নুসরাত যেদিন মারা যায়, সেদিন আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই ও স্কুলে চলে যায়। দুজনের মধ্যে প্রায়ই খুনসুটি লেগে থাকত। এখনো আমার মনে হয় না যে ও নেই।’
সুমাইয়া বলেন, ‘গত দুই দিন আমি ওর বিছানায় যাইনি। যখনই ঘুমাতে যাই, আমার মনে হয়, নুসরাত আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে।’