<p>শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ‘আয়নাঘর’ নামটি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে দেশজুড়ে। সেখানে বন্দিশালায় আটকে রেখে মানুষের ওপর চালানো হতো নির্যাতন। কুমিল্লার লাকসামেও এমন একটি কথিত ‘আয়নাঘর’ ছিল বলে কয়েক দিন ধরে চারদিকে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সেখানেও বিরোধী মতের মানুষদের তুলে নিয়ে চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। বছরের পর বছর না হলেও লাকসামের এই আয়নাঘরে অনেক সময় কয়েক দিন আটকে রেখেও অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো বলে খবর পাওয়া গেছে।  </p> <p>সম্প্রতি লাকসাম পৌর শহরের উত্তর বাজার এলাকায় লাকসাম থানার অন্য পাশে অবস্থিত কথিত সেই ‘আয়নাঘরের’ সামনে ব্যানার টানিয়েছেন নির্যাতিতরা। এরই মধ্যে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই মানুষজন কথিত সেই আয়নাঘর দেখতে সেখানে যাচ্ছে। </p> <p>নির্যাতিতদের সঙ্গে কথা বলে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,  কথিত যেই আয়নাঘরে ব্যানার টানানো হয়েছে- সেই মার্কেটটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ‘টর্চার সেল’ গড়ে তুলেছিলেন লাকসাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী। </p> <p>মহব্বত আলী কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের শ্যালক। মূলত তাজুলের হয়ে লাকসাম এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে লাকসামে মহব্বতই ছিল শেষকথা। তার কথার বাইরে গেলেই শুরু হতো নির্যাতন ও হয়রানি। কথিত আয়নাঘরের নিচের দুই ফ্লোরে প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় মহব্বতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনই লাকসামের বিক্ষুব্ধ জনতা সেখানে ভাঙচুর চালিয়ে সব মাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। আর এতেই মহব্বতের অত্যাচারের অবসান ঘটে।</p> <p>মহব্বতের নেতৃত্বে চলা সেই ‘আয়নাঘরে’ নির্যাতিতদের একজন লাকসাম পৌরসভা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনির আহমেদ। মনিরকে একাধিকবার সেখানে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।  </p> <p>মনির আহমেদ বলেন, ‘লাকসামের এই আয়নাঘরের প্রধান জল্লাদের নাম হলো মহব্বত আলী। তিনি তাজুলের শ্যালক হওয়ায় লাকসামকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করেছিলেন। লাকসামের বহুল আলোচিত এই আয়নাঘরের মহব্বতের সঙ্গে মানুষের ওপর নির্যাতন চালাতেন লাকসাম পৌরসভার সাবেক মেয়র আবুল খায়ের, ইউপি চেয়ারম্যান ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপজেলা সভাপতি নিজাম উদ্দিন শামীম, ইউপি চেয়ারম্যান ওমর ফারুকসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও ক্যাডাররা। ভিন্ন দলের রাজনীতি করায় আমাকে একাধিকবার তুলে নিয়ে সেখানে নির্যাতন চালানো হয়েছে। বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছে।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘আয়নাঘরের ভবনটির সম্পত্তি নিরীহ মানুষের। মহব্বত তার দুলাভাই মন্ত্রী তাজুলের প্রভাবে সেটি দখলে নিয়ে একরাতের মধ্যেই ভবন তুলতে শুরু করেন। ভবনটির তিনতলার পুরো ফ্লোর এবং ছাদে চারতলায় থাকা একটি কক্ষে চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। বিএনপির রাজনীতি করি বলে আমাকে একবার লাকসাম থানার এসআই বোরহান উদ্দিন ধরে নিয়ে মহব্বতের আয়নাঘরে দিয়ে আসেন। পরে তিন ঘণ্টা আমাকে একটানা নির্যাতন করে আবার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তখন বারবার মনে হচ্ছিল এখনই মনে হয় মরে যাব। সরকার পতনের পর মানুষ লাকসামের আয়নাঘর নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছে। এখানে নির্যাতিত মানুষরাই গত সপ্তাহে ব্যানার টানিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অনেকে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’</p> <p>নাম প্রকাশ না শর্তে লাকসাম পৌর বিএনপির অন্যতম শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘আমাকে তুলে নিয়ে মহব্বত ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী প্রথমে নির্মম নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে তারা আমার পায়ুপথে গরম চা ঢেলে দেয়। বারবার বৈদ্যুতিক শক দেয়।’</p> <p>লাকসাম হাউজিং এলাকার এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, ‘মহব্বত সব কিছুই করেছেন তাজুল ইসলামের নির্দেশে। আমি হাউজিং এলাকায় বাড়ি নির্মাণের সময় চাঁদা দিতে রাজি হইনি বলে আমাকে তুলে নিয়ে নির্যাতন চালায় মহব্বত বাহিনী। পরে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে জীবন রক্ষা করেছি। সেদিনের কথা মনে হলে এখনো ভয়ে কেঁপে উঠি আমি। আমি মনে করি, তাজুল ইসলাম ও মহব্বতদের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। তারা দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে লাকসামের মানুষকে গোলামের মতো শাসন করেছে।’</p> <p><br /> গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই লাকসাম থেকে পালিয়ে যান মহব্বত আলী। তার বাহিনীর সদস্যরা এখন এলাকা থেকে গা ঢাকা দিয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে মহব্বত কোথায় আছেন কেউ জানে না। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে। এ জন্য বারবার চেষ্টা করেও এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।</p>