<p>মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পাওয়া চাকরি ছাড়ার ঘোষণা দিলেন পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গোলাম ছরোয়ার তুহিন। মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) নিজের ফেসবুকে এক পোস্টে এ ঘোষণা দেন তিনি।</p> <p>ফেসবুকে পোস্টে গোলাম ছরোয়ার তুহিন বলেন, পুলিশ সদস্যদের পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি তুহিন। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্যসহ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ভেঙেচুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধ্বংস করা দেখে দুঃখ পেয়েছেন তিনি।<br />    <br /> নিচে ওসি গোলাম ছরোয়ার তুহিনের ‘এম ডি তুহিন’ নামের ফেসবুক আইডিতে তার দেওয়া ষ্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো- ‘বিদায় বাংলাদেশ পুলিশ। বিদায় বেলা কিছু কথা। আমার বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে চলে আসেন। আমার মা একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষিকা ছিলেন। তখন আমার জন্ম হয়নি। বড় হবার সাথে সাথে জানতে পেরেছি তৎকালীন সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ থাকায় আমার মায়ের পরামর্শে তিনি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় চলে আসেন। এসে তিনি স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং একটি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি পেশা হিসেবে ব্যবসাকে বেছে নেন। বাউফল উপজেলার বাহেরচর বন্দরে আমাদের একটি দিনের আড়ত, একটি রাইস মিল ও একটি ফার্মেসি ছিল। বেড়ে ওঠা কালীন আমার বাবাকে মাঝেমধ্যে পুলিশও সেনাবাহিনীর লোকজন খুঁজতে আসতো, কিন্তু কেন আসতো তা আমরা জানতাম না। নানা অপবাদ দিয়ে আমার বাবাকে খোঁজা হতো। পুলিশের জন্য আমার বাবা বাড়ি থাকতে না পেরে বিভিন্ন শহরে এসে ক্যানভাচারের কাজ করতো জীবিকা নির্বাহের জন্য। এভাবে আত্মগোপনে থেকে তাকে অনেকদিন পার করতে হয়েছে। একবার আমাদের স্বনামধন্য এমপি আ স ম ফিরোজ মহোদয় নৌকা মার্কা না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। কিন্তু আমার বাবা নৌকার বিপক্ষে না যেয়ে নৌকা মার্কায় অবিচল থেকে কাজ করেন, কার পক্ষে কাজ করেছেন তাকে আমরা চিনিও না তেমন। নীতিগত কারণে তিনি নৌকা মার্কার প্রার্থীর প্রতি অবিচল ছিলেন কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত নৌকা মার্কা হেরে গেল। স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হল এবং পুনরায় আওয়ামী লীগে যোগদান করলেন। এরপর আমাদের পরিবারের অবস্থা বিরোধীদলের চেয়েও খারাপ ছিল। এরপর আমার বাবা পুরাদমে ব্যবসায় মনোযোগ দিলেন ও সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। সেই থেকে আমাদের পরিবার সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে আছি। এরপর বেশ ভালোই ছিলাম।<br />  <br /> হঠাৎ একদিন (বিএনপি ঘরনার) আমাদের বাড়ির এক মেয়ে আমার বড় ভাইকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে নিজ দায়িত্বে আমাদের ঘরে চলে আসেন। আমার ভাই তখন বরিশালে ছিল। নানাভাবে মেয়েকে বুঝালাম, পরিবারের সাথে কথা বললাম ফিরে যাওয়ার জন্য কিন্তু তিনি অনঢ় ছিলেন, তিনি যাবেন না। এলাকার সব লোক মিলে বুঝিয়ে ও তাকে ফেরাতে পারেন নাই।</p> <p>হঠাৎ রাতের বেলা পুলিশ আসলো, আমার বাবা মাকে গ্রেপ্তার করল এবং থানায় নিয়ে মামলা দিয়ে চালান দিল। বলল, আমরা নাকি ঐ মেয়েকে অপহরণ করেছি। আসলে কী আইনে কী অপরাধ ছিল সেটাই আমরা জানতাম না, পরে শুনেছি নারী নির্যাতনের নতুন আইন হয়েছে। যাহোক অনেক কিছুর পরেও সেই মেয়েকে নিয়েই আমার বড়ভাই এখনো সংসার করছেন। আমার বাবা মায়ের জন্য এরচেয়ে বড় অপমান আর কিছু ছিল না। পুলিশ তো জানত, কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা ছিল। ছেলের সুখের জন্য আমার বাবা-মা সবকিছু মেনে নিলেন কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অপমানের কথা ভুলতে পারলেন না। এরপরও অনেক পুলিশ হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। কারণ আমাদের পিছনে কোনো শক্তি ছিল না। বাবা আমাকে বলেছিলেন, যাইহোক কখনো কোনো মানুষের ক্ষতি করবে না। সেই নীতিতেই বেঁচে আছি এবং পথ চলছি। আমার বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তালিকাভুক্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কারোর দয়ায় বা করুনায় নয়। বীর মুক্তিযোদ্ধার কোটায় আমার চাকরি হয়েছে।</p> <p>যেভাবে ৫ আগস্ট দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলো, যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্যসহ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে অপমান করা হলো, ভেঙেচুরে চুরমার করা হলো, সেখানে কোন নৈতিক অধিকারে আমি এ চাকুরি করি। চাকরি কালীন আমি সব কর্মস্থলেই নিরপেক্ষতার সাথে কাজ করতে পেরেছি, তবে রাজনৈতিক কারণে কিছু কাজ করতে হয়েছে যেহেতু আমি সরকারি চাকরি করি। আমি জীবনে কখনো কোনো তদবির করি নাই, যেখানে দায়িত্ব দিয়েছে সেখানেই দায়িত্ব পালন করেছি। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস আমাদের শেষ হয়েছে। এখন হয়ত নতুন স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস শুরু হবে।<br />  <br /> আমি নতুন প্রজন্মের কাছে আমার মুক্তিযোদ্ধার কোঠায় থাকা চাকরিটি ছেড়ে দিলাম, তারা নতুন উদ্যমে জায়গা পূরণ করে নিবেন এবং প্রত্যাশিতভাবে দেশকে সাজাবেন এ অনুরোধ রাখলাম। </p> <p>আমি আমার বাবার দেখানো নীতিতেই বাকিটা পথ হাঁটবো। বাবা বলেছিলেন, যেখানে সম্মান নেই, সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিও। সাধারণ জনগণের কাছে পুলিশ যেভাবে অসম্মানিত হলো, সেই ইমেজ নিয়ে কিভাবে জনগণকে সেবা করব। আমি আমার বাবার সম্মান রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে বিদায় জানালাম। আমি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের জন্য আবেদন পত্র পাঠিয়ে দিলাম। তবে আইন পেশার সাথেই যুক্ত থাকবো। সকলের জন্য শুভকামনা রইল। আমিন। জয় বাংলা <br /> বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।’</p> <p>এই আবেগ ঘন এ ষ্ট্যাটাসে স্বরূপকাঠি থানাসহ বিভিন্ন এলাকায় তার সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব ও জন সাধারনের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রীয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই তার লিখিত বক্তব্য ফেসবুকে শেয়ার করে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন।<br />  <br /> আব্দুল মাসুদ মামুন নামের একজন লিখেছেন, ‘নিজেও একজন মুক্তি যোদ্ধার সন্তান হিসেবে তোমার মনের কষ্টটা অনুভব করছি। এ জাতির দুর্ভাগ্য, আমাদের চেতনার যখনই স্খলন ঘটে তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা বার বার জাতির চেতনার ওপর আঘাত হানে। আসলে এর থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি না।’</p> <p>শারমিন কবির বিথি লিখেছেন, ‘আপনি একজন সৎ ও দক্ষ পুলিশ অফিসার ছিলেন। সম্মানের সঙ্গে নুন-ভাত খাওয়াও ভালো। আপনার সিদ্ধান্তের জন্য আপনাকে শ্রদ্ধা জানাই। আল্লাহ আপনার ও আপনার পরিবারকে ভালো রাখুন। আপনি প্রমাণ করলেন, আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।’</p> <p>এইচ এম লিজন লিখেছেন, ‘পুলিশ বাহিনীতে আপনার মতো অফিসার দরকার। আপনাদের মতো অফিসারদের কারণে আজও এ বাহিনী টিকে আছে। আপনার সিদ্বান্তকে সম্মান জানাই কিন্তু এ চলে যাওয়া মেনে নেওয়ার মত নয়।’</p> <p>এই ষ্ট্যাটাসটি শেয়ার করে অ্যাডভোকেট আফসানা মিমি লেখেন, আমাদের স্বরূপকাঠী থানার বর্তমান ওসি, আপনি দেখিয়ে দিলেন আপনার নীতি-আদর্শ। আপনাকে স্যালুট তুহিন ভাই।</p> <p>এ ব্যাপারে স্বরূপকাঠি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. গোলাম ছরোয়ার তুহিনের অফিসিয়াল মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে এইচ এম শাহিন (ওসি তদন্ত) রিসিভ করেন। তার কাছে ওসি তুহিনের স্বেচ্ছায় অবসরের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘মিডিয়ার মাধ্যমে ফেসবুকে এমন একটা ষ্ট্যাটাস দেওয়ার খবর জেনেছি। বর্তমানে ওসি সাহেব অসুস্থজনিত কারণে ছুটিতে আছেন। নেছারাবাদ থানায় পুলিশের কার্যক্রম চলমান আছে।’</p>