<p>রাজশাহী নগরে গত চার যুগে তিন হাজারের বেশি পুকুর ও জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। এসব পুকুর ভরাট করে ভূমিতে রূপান্তরসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জমির মালিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়াও পুকুর ভরাটে স্থানীয় প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।</p> <p>পরিবেশসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুকুর ভরাটের কারণে রাজশাহীর পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাপমাত্রা বাড়ছে। বড় একটি বিষয় হলো, কোথাও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে।</p> <p>হ্যারিটেজ রাজশাহীর সভাপতি এবং নদী ও জলাশয় বিষয়ক গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকীর একটি বইয়ে তথ্য রয়েছে, রাজশাহী নগরে ষাটের দশকে চার হাজার ২৮৩টি পুকুর, দিঘি ও অন্যান্য জলাশয় ছিল। ২০১৫ সালের মধ্যে এসব পুকুর-জলাশয়ের সংখ্যা কমে দুই শর ঘরে নেমে আসে।</p> <p>গত ৯ বছরে ভরাট করা হয়েছে আরো শতাধিক পুকুর। গত কয়েক বছরে ব্যাপক হারে পুকুর-জলাশয় ভরাট করে গড়ে উঠেছে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, ভবন, দোকানপাটসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান। এখন নগরে পুকুর-দিঘির সংখ্যা শতের ঘরে চলে এসেছে।</p> <p>মাহাবুব সিদ্দিকীর গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৮১ সালের দিকে পুকুর-জলাশয়ের সংখ্যা দুই হাজার ২২৭টিতে নেমে আসে। ২০০০ সালে পুকুর-জলাশয় কমে হয় ৭২৯টি। ২০০৯ সালে তা গিয়ে ঠেকে ৩১৩টিতে। এরপর ২০১৫ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ২০০টির মতো। </p> <p>পুকুর ভরাটকরণ ঠেকাতে হ্যারিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহাবুব সিদ্দিকী ২০১০ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে উচ্চ আদালত রাজশাহী নগরীর সব ধরনের জলাশয় ভরাটে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাব দিতে বলেন। সে অনুযায়ী ২০১২ সালে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নগরে জলাশয় ভরাটের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে লিখিত দিয়েছিল উচ্চ আদালতকে। এর পরও পুকুর বা জলাশয় ভরাট করা থামেনি। </p> <p>জানতে চাইলে নদী ও জলাশয় গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘বর্তমানে রাজশাহীতে পুকুর ও জলাশয়ের সংখ্যা এক শর মতো হবে। কারণ যেগুলো অবশিষ্ট ছিল, গত কয়েক বছরে এসব পুকুর ভরাট করা হয়েছে। অথচ পুকুর-জলাশয় ভরাট না করতে উচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলেও পুকুরগুলো কৌশলে ভরাট করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কেউ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’</p> <p>রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অথরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আগের কোনো হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে ২০০৪ সালে আমাদের জরিপে এক হাজার ৯২৫টির মতো পুকুর পাওয়া যায়। এরপর এ ধরনের আর কোনো জরিপ হয়নি। এর মধ্যে অনেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। সেই হিসাবে পুকুরের সংখ্যা এখন ১৫০ থেকে ২০০টি হতে পারে।’</p> <p>কিছুদিন আগে নগরে দায়রাপাক নামে সাড়ে ছয় বিঘা আয়তনের একটি পুকুর ভরাট করে সেখানে কলা চাষ করছেন জমির মালিক। হালিম উদ্দিন নামের ওই ব্যক্তি বলেন, ‘যেহেতু এটি  কিনে নিয়েছি, কাজেই এখন এই জায়গা আমি আমার মতো ব্যবহার করব।’</p> <p><strong>ভরাট করা ঐতিহাসিক তিনটি দিঘি</strong></p> <p>মহাকাল দিঘি : রাজশাহী নগরে হজরত শাহ মখদুম (রা.)-এর মাজারের পাশে একসময় ছিল সুবিশাল মহাকাল দিঘি। ১৯২৯-৩০ সালের দিকে বিশালাকার এই দিঘিটি ভরাট করে গড়ে তোলা হয় রাজশাহী কলেজের মাঠ। বর্তমানে এই মাজারের নিচের পুকুরটি সেই দিঘিরই অবশিষ্ট অংশ।</p> <p>হাতিডোবা দিঘি : রাজশাহী নগরীর শিরোইল বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফরমের একটি অংশে ছিল বিশালা হাতিডোবা দিঘি। জমিদার ভবানীচরণ ছিলেন এই দিঘির মালিক। জনশ্রুতি রয়েছে, দিঘিতে ডুবে ওই জমিদারের একটি হাতি মারা যায়। সেই থেকে দিঘিটির নাম হয় হাতিডোবা দিঘি। ১৯৫৮ সালে নগরের শিরোইল এলাকার বাসিন্দা মোসলেম হুদা দিঘিটি কিনে নেন। ১৯৮২ সালে দিঘিটি ভরাট করে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ শিরোইল বাসস্ট্যান্ড গড়ে তোলে।</p> <p>বড়কুঠি দিঘি : রাজশাহী-নাটোর সড়ক প্রশস্তকরণে ১৯৮৫-৮৬ সালে ভরাট করা হয় নগরের বড়কুঠি এলাকার বিশাল বড়কুঠি দিঘি। এটি প্রথমে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির। পরে চলে যায় রবার্ট ওয়াটসন কম্পানির হাতে। আরো পরে মেদেনীপুরের জমিদারি সম্পত্তিতে পরিণত হয়। সেটি এখন কেবলই কাগজে-কলমে, বাস্তবে নেই। এ ছাড়াও ভরাট করা পুকুরের তালিকায় রয়েছে  শ্রুতকীর্তিদের পুকুর, পর্বত শেখের পুকুর, বন পুকুর, খোলা পুকুর, কালী পুকুর, সোবহান মিয়ার পুকুর, ধোপা পুকুর, তুরকান শাহর পুকুর, উকিলদের পুকুরসহ ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী ২৫৮টি পুকুর-জলাশয়।</p> <p>এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বলেন, ‘পুকুর বা জলাশয় ভরাট রোধে আইন থাকলেও মানা হচ্ছে না। গোপনে একের পর এক জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। তবে সেসব স্থানে আমরা কোনো স্থাপনা গড়ে তোলার অনুমতি দিই না।’</p> <p>সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) রাজশাহী জেলা সভাপতি আহমেদ শফিউদ্দিন বলেন, ‘পুকুর ভরাটের কারণে রাজশাহীর পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। গরমের সময় তাপমাত্রা বাড়ছে, শীতের সময় শীত বাড়ছে। বড় বিষয় হলো, কোথাও কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। একসময় যেসব পুকুরে নিম্ন শ্রেণির মানুষ গোসল করত, থালা-বাসন পরিষ্কার  করত, সেসব পুকুর আর ব্যবহার করতে পারে না তারা। সব মিলে পুকুর ভরাটের কারণে চরম ক্ষতি হয়েছে রাজশাহীর।’</p> <p>রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘অতীতে পুকুর ভরাট করেছে কি না, বলতে পারব না। তবে এখন আর ভরাট করার সুযোগ নেই।’</p> <p>রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘পুকুর-জলাশয় ভরাটের কারণে রাজশাহীর পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমরা ১৬টি পুকুর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরগুলো এখনো ভরাট হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে। তাদের নির্লিপ্ততায় এসব পুকুর-জলাশয় ভরাট হচ্ছে।’</p>