<p style="text-align:justify">আল-ওয়াহহাবিয়া, ওয়াহাবিজম বা ওহাবি আন্দোলন সুন্নি ইসলামের একটি সংস্কারবাদী ধর্মীয় আন্দোলন, যার সূচনা ১৮ শতকে। প্রাথমিকভাবে এটি নজদের মধ্য আরব অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং পরে আরব উপদ্বীপের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব আত-তায়মি (রহ.) (১৭০৩-১৭৬১ খ্রি.)।</p> <p style="text-align:justify">এ আন্দোলনের মূলভিত্তি ছিল তাওহিদ বা মহান আল্লাহর একত্ববাদ। এতে ইসলাম ধর্মের আদি উৎস গ্রন্থ কোরআন ও হাদিসের ওপর জোর দেওয়া হয়। এবং কুফর, শিরক, বিদআত, মাজার, মুসলিম মনীষীদের কবর জিয়ারত ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়।</p> <p style="text-align:justify">স্মরণীয় যে অষ্টাদশ শতকের শুরুতে মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলে নেতৃত্ব দিচ্ছিল তুরস্কের উসমানীয় খিলাফত, পারস্যের সাফাভি এবং ভারতবর্ষে মোগল—এ তিনটি সাম্রাজ্য। সুলতান দ্বিতীয় সেলিম বাগদাদ জয় করলে অটোমান সাম্রাজ্যই মধ্যপ্রাচ্যে তথা বিশ্বে একটি বড় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়, যারা ছিল মূলত সুন্নি। এবং এ আন্দোলন সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আন্দোলনটি তুর্কি, পারস্য ও বিদেশি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রথম বড় আরব নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহের প্রতিনিধিত্ব করে, যা ১৩ শতকে আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের পর থেকে ইসলামী বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল।</p> <p style="text-align:justify">তাই এটি একদিকে ইতিবাচক সংস্কারবাদী আন্দোলন হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছে, অন্যদিকে মাজহাবপন্থী ও পীরপন্থী আলেম-ওলামা এ আন্দোলনকে ইসলামবহির্ভূত প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।</p> <p style="text-align:justify"><em>[হাসান বিন আবদুল্লাহ আলে শায়েখ, প্রবন্ধ : আল-ওয়াহহাবিয়াহ ওয়া যাঈমুহা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব, গৃহীত : ফরীদ ওয়াজদী, দায়েরাতু মাআরিফিল ক্বারনিল ইশরীন (বৈরুত : দারুল মারিফাহ, তৃতীয় প্রকাশ), পৃষ্ঠা-৮/৮২১]</em></p> <p style="text-align:justify"><strong>কে ছিলেন মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাব (রহ.)</strong></p> <p style="text-align:justify">মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাব (রহ.) বর্তমান সৌদি আরবের রাজধানী শহর রিয়াদ থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত উয়ায়না নগরীতে ১১১৫ হি./১৭০৩ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বংশধারা বর্তমানে ‘আলে শায়েখ’ নামে পরিচিত এবং সৌদি আরবের সাবেক ও বর্তমান গ্র্যান্ড মুফতি এই বংশোদ্ভূত। তাঁর সংস্কারবাদী আন্দোলন সৌদি রাষ্ট্রের জন্মলাভে সবিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ১১৫৭ হি./১৭৪৬ খ্রি. তিনি আমির মুহাম্মাদ বিন সউদের শাসনাধীন ছোট্ট নগরী ‘দিরঈইয়া’তে আগমন করেন। তাঁর দাওয়াতি কার্যক্রম জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর খ্যাতির কথা পৌঁছে যায় আমির মুহাম্মাদ বিন সউদের দরবারেও।</p> <p style="text-align:justify">আমির নিজে শায়খের দরবারে উপস্থিত হন। অতঃপর তিনি শায়খের হাতে হাত রেখে বাইআত গ্রহণ করে স্বীয় রাজ্যে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন। ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত এই ঐতিহাসিক বাইআতই ‘দিরঈইয়া চুক্তি’ হিসেবে পরিচিত, যা দুই মুহাম্মাদের ভাগ্য একসূত্রে গ্রথিত করে দিয়েছিল। মুহাম্মাদ বিন সউদ এ দুটি শর্তারোপের মাধ্যমে শায়খের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন—</p> <p style="text-align:justify">১. যদি আল্লাহ কখনো বিজয় দান করেন তাহলে শায়খ যেন তাঁকে ছেড়ে অন্যত্র না যান।</p> <p style="text-align:justify">২. ফসল তোলার সময় জনগণের কাছ থেকে বার্ষিক যে কর নেওয়া হয় তা যেন রদ না করেন। (হুসাইন বিন গান্নাম, রাওজাতুল আফকার ওয়াল আফহাম, তাহকিক : ড. নাছেরুদ্দিন আল আসাদ, পৃষ্ঠা-৮৭)</p> <p style="text-align:justify">এ সম্পর্ক পারিবারিক সম্পর্কে পরিণত হয়ে আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সউদের সঙ্গে শায়খের এক কন্যার বিবাহ হয়। (আবদুল মওদুদ, ওহাবি আন্দোলন, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, সপ্তম মুদ্রণ-২০১১, পৃষ্ঠা-১৫)</p> <p style="text-align:justify">যদিও মুহাম্মাদ বিন সউদ ছিলেন ‘দিরঈইয়া’র প্রশাসনিক প্রধান, তবে কার্যত শায়খই ছিলেন এই রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। রাজ্যের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে সাক্ষাৎ করতেন। </p> <p style="text-align:justify">[উসমান বিন আবদিল্লাহ বিন বিশর, উনওয়ানুল মাজদ ফি তারিখে নাজদ, তাহকিক : আবদুর রহমান বিন আবদুল লতিফ বিন আবদিল্লাহ আলে শায়েখ (রিয়াদ : দারাতুল মালিক আবদিল আজিজ, চতুর্থ প্রকাশ : ১৯৮২), ১/৪৬]</p> <p style="text-align:justify"><strong>আন্দোলনের আইনি ভিত্তি</strong></p> <p style="text-align:justify">ওহাবি মতাদর্শ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.), শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এবং ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)-এর মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়। যেহেতু ওহাবিজম মাজার, সমাধি ও পবিত্র বস্তুর অতিভক্তি নিষিদ্ধ করে, তাই ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত অনেক স্থান যেমন মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিদের বাড়ি এবং কবর সৌদি শাসনের অধীনে ধ্বংস করা হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে যে মক্কা ও মদিনার আশপাশের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর প্রায় ৯৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।</p> <p style="text-align:justify">ওহাবি মতাদর্শে যে বিষয়গুলোর প্রতি বেশি জোর দেওয়া হয়, তা হলো মহান আল্লাহর একত্ববাদের ওপর বিশ্বাস। কোরআন ও হাদিসের কঠোরতর অনুসরণ। তাকলিদ বা মাজহাবভিত্তিক মতাদর্শের নিন্দা, কবরকে ঘিরে সমাধিসৌধ বা কোনো ব্যক্তির মাজার বানানো যাবে না এবং পুণ্যের উদ্দেশ্যে কবর জিয়ারত নিষিদ্ধ করতে হবে। ধর্মীয় শুদ্ধতার চর্চায় নমনীয়তার কোনো স্থান নেই। ব্যক্তিকে বেশি ভক্তি করা যেমন—পীর বা বুজুর্গ ব্যক্তির জন্য আলাদা সম্মান প্রদর্শনের সুযোগ নেই। নেশাদ্রব্য পান করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, জনসংগঠন গড়ে তোলা যাবে না। সব মুসলমানকে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতে হবে। নারীদের কঠোর ইসলামী অনুশাসনের মধ্যে থাকতে হবে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>ওহাবি আন্দোলনের সঙ্গে ভিন্নমত</strong></p> <p style="text-align:justify">বিষয়টি এমন নয় যে ওহাবি আন্দোলনকে সেই সময়ের শাসক শ্রেণি এবং আলেম-ওলামারা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলেন, বরং তৎকালীন অনেকে এ আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। ওহাবি আন্দোলনের বিরোধিতায় তিনটি শক্তির উদ্ভব ঘটেছিল, তারা হলো—১. রাষ্ট্রশক্তি ও প্রশাসন (উসমানীয় খলিফারা), ২. আলেম-ওলামা, ৩ জনসাধারণ। তারা বলেছে যে আবদুল ওয়াহাব (রহ.) জমহুর তথা বেশির ভাগ মুসলমানের আকিদা-বিশ্বাস পরিপন্থী মত পোষণ করেছেন। (‘ছিয়ানাতুল ইনসান’ গ্রন্থের ভূমিকা দ্রষ্টব্য; গৃহীত : আহমদ বিন হাজার আলে বুত্বামি, পৃষ্ঠা-১২২)</p> <p style="text-align:justify">এই বিরোধিতার কবলে পড়ে শায়খ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করার নির্দেশ দেন এবং জিহাদের ডাক দেন। মুহাম্মাদ বিন সউদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ওহাবি আন্দোলন একটি বিপ্লবী ও সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়।</p> <p style="text-align:justify">১১৭৯/১৭৬৫ খ্রি. বিন সউদ মৃত্যুবরণ করেন এবং তদস্থলে পুত্র আবদুল আজিজ শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনিও পিতার মতো শায়খের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন এবং তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করতেন। তাঁর আমলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর ওপর ‘দিরঈইয়া’র নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর হাতে ১১৮৭ হি./১৭৭৩ খ্রি. দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর লড়াই চলার পর রিয়াদ নগরী পদানত হয়। (মাসউদ আলম নাদভি, মুহাম্মাদ বিন আবদল ওয়াহহাব : মুছলিহুন মাজলুমিন ও মুফতারা আলাইহ, উর্দু থেকে আরবি অনুবাদ : আবদুল আলিম আল-বাসতুভি (রিয়াদ : ১৪২০ হি.), পৃষ্ঠা-৫৭)</p> <p style="text-align:justify">১২০৬ হি./১৭৯২ খ্রি. ৯২ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শায়খ প্রায় ৫০ বছর দাওয়াত ও জিহাদে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>আন্দোলনের প্রভাব</strong></p> <p style="text-align:justify">এ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আরব উপদ্বীপের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইতিহাস এক নতুন মোড় নেয়। সূচনা হয় আধুনিক ইসলামী রেনেসাঁ ও আরবীয় গণজাগরণের। এ আন্দোলন মূলত ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন হলেও পরে এটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়।</p> <p style="text-align:justify">আবদুল ওয়াহহাব (রহ.) একাধারে দরস-তাদরিস, আলেম-ওলামা, আমির-ওমারাহদের কাছে চিঠিপত্র প্রেরণ, পুস্তিকা প্রণয়ন প্রভৃতিতে ব্যস্ত থাকেন। একে একে নাজদসহ রিয়াদ, আল-কাসিম, হায়েল, সুদায়ের, আহসা, মক্কা, মদিনাসহ আরবের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর দাওয়াত পৌঁছে যায়। হজের সময় আসা হাজিদের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে তথা মিসর, সুদান, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, ভারতবর্ষ প্রভৃতি এলাকায় তাঁর দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে।</p> <p style="text-align:justify">এভাবে জাজিরাতুল আরবে ওহাবি আন্দোলন এক মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যায়। অনিবার্যভাবে ওহাবি আন্দোলনের বিস্তারের ধারাবাহিকতায় ‘সৌদি আরব’ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পরে এ আন্দোলন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অদ্যাবধি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় সৌদি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ওহাবি মতাদর্শের ওপর রচিত বিভিন্ন বই-পুস্তক বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয় এবং সেই মতাদর্শ প্রচার-প্রসারের জন্য আলাদা বিভাগ খোলা রয়েছে।</p>