<p style="text-align:justify">রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন ছিল অনাড়ম্বর ও সাদাসিধা। তিনি জাঁকজমকহীন জীবনযাপন করা পছন্দ করতেন। রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে তিনি বিরল নজির স্থাপন করেছেন। তিনি সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন। তাঁর বসবাস ছিল সাধারণ ছোট একটি গৃহে। গৃহে ছিল না কোনো দামি আসবাব। শয়ন করতেন চাটাইয়ে। যার ফলে দেহ মোবারকে চাটাইয়ের দাগ পড়ে যেত।</p> <p style="text-align:justify">ভীষণ খাদ্যকষ্টেও তিনি দিনাতিপাত করেছেন। শুধু নিজে না, বরং বিলাসী জীবন পরিহার করতে তিনি সাহাবায়ে কিরামকে আদেশ করেছেন। বর্ণিত আছে, তিনি যখন মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে শাসনভার অর্পণ করে ইয়েমেনে পাঠাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম উপদেশ ছিল, ‘হে মুয়াজ, নিজেকে বিলাসিতা থেকে বাঁচিয়ে রেখো। কেননা আল্লাহর বিশেষ বান্দারা বিলাসী জীবনযাপন করে না।’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৫৭৬৬)</p> <p style="text-align:justify">প্রকৃত মুমিন বান্দা জান্নাতের সুখ-শান্তির জন্যই সব পার্থিব আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে থাকে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, হে আয়েশা, যদি তুমি (ইহকাল ও পরকালে) আমার সান্নিধ্য লাভের ইচ্ছা রাখো, তবে দুনিয়ার সম্পদ থেকে এ পরিমাণ নিজের জন্য যথেষ্ট মনে কোরো, যে পরিমাণ একজন মুসাফিরের পাথেয় হিসেবে যথেষ্ট হয় এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সাহচর্য থেকে বেঁচে থাকো। আর তালি না লাগানো পর্যন্ত কোনো কাপড়কে পুরনো মনে কোরো না। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১৭৮)</p> <p style="text-align:justify"><strong>রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিলাসিতাহীন খাবার গ্রহণ</strong></p> <p style="text-align:justify">রাসুলুল্লাহ (সা.) খাবারদাবারের ব্যাপারে অল্পে তুষ্ট ছিলেন। চলা যায়, এমন খাবার তিনি যথেষ্ট মনে করতেন। উরউয়াহ (রা.) বলেন, একবার আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) আমাকে বলেন, হে ভাগ্নে! আমরা দুই মাসে তিনটি নতুন চাঁদ দেখতাম। কিন্তু (এর মধ্যে) আল্লাহর রাসুলের বাড়ির চুলাগুলোতে আগুন জ্বলত না। আমি বললাম, আপনারা কিভাবে দিনাতিপাত করতেন? তিনি বলেন, দুটি কালো বস্তু খেজুর ও পানি দিয়ে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪৫৯)</p> <p style="text-align:justify">অন্য এক বর্ণনায় হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর পরিবারের লোকেরা একনাগাড়ে তিন রাত গমের রুটি পেট পুরে খাননি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৪১৬)</p> <p style="text-align:justify">আবু কাতাদাহ (রহ.) বলেন, আমরা একবার আনাস বিন মালেক (রা.)-এর দাওয়াতে হাজির হলাম। খাওয়ার শুরুতে তিনি আমাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা খান! আমার জানা নেই, রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুর সময় পর্যন্ত পাতলা রুটি দেখেছেন কি না। আর তিনি কখনো ভুনা বকরির গোশত চোখে দেখেননি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৪২১)</p> <p style="text-align:justify">তবে সুস্থ-সবল শরীরে আল্লাহর ইবাদত করার উদ্দেশে সাধ্যমতো উত্তম ও সুস্বাদু খাবার গ্রহণে ইসলামের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ ও অপচয় করা থেকে নিরুত্সাহ করা হয়েছে। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খাওয়া, তার বেশি নয়। আবার অল্পে তুষ্ট থাকা মুমিনের অন্যতম গুণ। </p> <p style="text-align:justify"><strong>রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাদাসিধা পোশাক</strong></p> <p style="text-align:justify">আড়ম্বরতা এড়িয়ে চলা এবং সাদাসিধা পোশাক পরা ঈমানের পরিচায়ক। এটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত। তিনি জৌলুস ও চাকচিক্য পছন্দ করতেন না। নিতান্ত সাদাসিধা পোশাক পড়তেন। এক হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন, সাদাসিধা হওয়া ঈমানের পরিচায়ক, সাদাসিধা হওয়া ঈমানের পরিচায়ক, সাদাসিধা হওয়া ঈমানের পরিচায়ক। বর্ণনাকারী বলেন, আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন ক্ষেত্রে সাদাসিধা? তিনি বলেন, পোশাকের ক্ষেত্রে। (কিতাবুয যুহুদ)</p> <p style="text-align:justify">তবে মনে রাখতে হবে, সাদাসিধার অর্থ মোটেও নোংরামি, অপরিচ্ছন্নতা ও অসৌন্দর্য নয়। মুমিনের পরিহিত পোশাক সব সময় সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। নামাজসহ অসংখ্য ইবাদতের জন্য পোশাকের পবিত্রতা আবশ্যক করা হয়েছে। তবে অহংকার সৃষ্টি হয়—এমন পোশাক পড়তে নিষেধ করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। তিনি বলেন, ‘যার হৃদয়ে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, কিছু মানুষ তো তাদের কাপড় ও জুতা সুন্দর হওয়া পছন্দ করে। তখন তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। আর অহংকার সত্য বিলুপ্ত করে এবং মানুষকে অসম্মান করে।’ (সহিহ মুসলিম)</p> <p style="text-align:justify"><strong>রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনাড়ম্বর শয়নস্থল</strong></p> <p style="text-align:justify">রাসুলুল্লাহ (সা.) আখিরাতমুখী সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। দুনিয়ার যৎমান্য আসবাবে তাঁর অল্পে তুষ্টির নমুনা তুলনাহীন। পৃথিবীর আর কারো ক্ষেত্রে এ রকম দেখা যায় না। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি খেজুরপাতার মাদুরে শুয়েছিলেন। তাঁর দেহের চামড়ায় (মাদুরের) দাগ বসে গেল। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা-বাবা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক। আপনি আমাদের অনুমতি দিলে আমরা আপনার জন্য মাদুরের ওপর কিছু (তোশক) বিছিয়ে দিতাম। তাহলে তা আপনাকে দাগ লাগা থেকে বাঁচিয়ে রাখত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? আমি দুনিয়ায় এমন এক মুসাফির ছাড়া তো কিছু নই, যে একটি গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিল। অতঃপর তা ত্যাগ করে গন্তব্যের দিকে চলে গেল। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৩৭)</p> <p style="text-align:justify">আয়েশা (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিছানা ছিল চামড়ার তৈরি এবং তার ভেতরে ছিল খেজুরপাতার আঁশ। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪৫৬)</p> <p style="text-align:justify">অন্য বর্ণনায় এসেছে, তাঁর ব্যবহৃত বালিশ ছিল চামড়ার তৈরি, যার ভেতরে ছিল খেজুরগাছের ছাল। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪১৪৬)</p> <p style="text-align:justify">ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘরের আসবাবের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি চাটাইয়ের ওপর শুয়ে ছিলেন। চাটাইয়ের ওপর কিছুই ছিল না। তাঁর মাথার নিচে ছিল খেজুরের ছালভর্তি চামড়ার বালিশ। আমি তাঁর শরীরে চাটাইয়ের দাগ দেখে কেঁদে ফেললাম। তিনি বলেন, কাঁদছ কেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কায়সার ও কিসরা ভোগ-বিলাসে মত্ত, অথচ আপনি আল্লাহর রাসুল! তিনি বলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে তাদের জন্য পার্থিব জীবন ও আমাদের জন্য পরকাল। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৯১৩)</p> <p style="text-align:justify"><strong>একজন মুমিনের নমুনা যেমন হবে</strong></p> <p style="text-align:justify">একজন মুমিনের জীবনের বাস্তব নমুনা হবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং তাঁর সাহাবিরা। রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হয়েও কখনো বিলাসিতার ধারে-কাছেও যাননি। খেজুর পাতার বিছানায় ঘুমাতেন। যার ফলে পিঠে দাগ পড়ে যেত। আরো কত কত কষ্ট করেছেন তিনি। অথচ আমরা আজ কোথায়? একবারও ‍কি কল্পনা করেছি নিজেকে নিয়ে? নিজেকে একটু মিলিয়ে দেখেছি? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা কি শুনতে পাওনা! তোমরা কি শুনতে পাওনা যে সাদাসিধা জীবন যাপন করাই হলো ঈমানের অংশ, সাদাসিধা জীবন যাপন করা হলো ঈমানের অংশ। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪১৬১) </p> <p style="text-align:justify">এই ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনাড়ম্বর জীবন যাপনের দৃশ্য। তাঁর জীবনাদর্শে আছে আমাদের ইহকাল ও পরকালের সফলতা।</p>