<p style="text-align: justify;">ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ফারুক (সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের রূপরেখা দান করেছেন; তা বাস্তবায়নে তিনি অনন্যসাধারণ অবদান রাখেন। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বহু আইন, বিধান ও প্রতিষ্ঠান তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>জন্ম ও পরিচয় : </strong>তাঁর পুরো নাম আবু হাফস ওমর ইবনুল খাত্তাব বিন নুফাইল বিন আবদুল উজ্জা। মা-বাবা উভয়ের বিবেচনায় তিনি কুরাইশ ছিলেন। ওমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর ১৩ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। পবিত্র কাবাঘরের সন্নিকটে অবস্থিত জাবালে ওমরে ছিল তাঁর বাড়ি। শৈশবে তিনি উটের রাখাল হিসেবে কাজ করতেন এবং যৌবনে পদার্পণের পর তিনি ব্যবসায় মনোযোগী হন। ব্যবসা করে তিনি বিপুল সম্পত্তির মালিক হন। ইসলাম গ্রহণের আগেও ওমর (রা.)-কে মক্কার অন্যতম অভিজাত ব্যক্তি মনে করা হতো এবং তিনি বিভিন্ন সময় কুরাইশের প্রতিনিধিত্ব করেন।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>দৈহিক বৈশিষ্ট্য : </strong>ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। তাঁর দৈহিক গঠনই তাঁর শক্তিমত্তা, শারীরিক সামর্থ্য ও প্রখর ব্যক্তিত্বের সাক্ষ্য দিত। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে, তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী ও শক্তিমান পুরুষ। মানুষের ভিড়ে দাঁড়ালে তাঁকে সহজেই চিহ্নিত করা যেত। তাঁর সিনা বা বুক ছিল প্রশস্ত এবং দাড়ি ছিল অত্যন্ত ঘন। তিনি দুই হাতে কাজ করতে পারতেন। তিনি দ্রুত পথ চলতেন এবং ভরাট কণ্ঠে কথা বলতেন।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>আল্লাহভীতি : </strong>ওমর (রা.) ছিলেন অত্যন্ত সুচরিত্রের অধিকারী। আল্লাহভীতি, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি বলতেন, ‘তোমরা হিসাব গ্রহণের আগে নিজেদের হিসাব গ্রহণ কোরো এবং তোমাদের আমল পরিমাপ করার আগে নিজেরা পরিমাপ করে দেখো এবং নিজেকে মহাবিচারের জন্য প্রস্তুত কোরো।’ যদি কোনো কারণে কারো প্রতি তিনি অন্যায় করেছেন, তবে তিনি নিঃসংকোচে তাঁর কাছে অনুতাপ প্রকাশ করতেন।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>সাহসিকতা : </strong>ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও বীর। তিনি সত্য প্রকাশে কখনো ভয় পাননি। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) তাঁর সম্পর্কে বলেন, আমার জানা মতে, ওমর ইবনুল খাত্তাব ছাড়া সবাই গোপনে হিজরত তথা মক্কা ত্যাগ করেছে। তিনি যখন হিজরতের ইচ্ছা করেন, তখন তরবারি ও তীর-ধনুক হাতে নেন এবং কাবাঘরে যান। তিনি তাওয়াফ করেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়েন। অতঃপর কুরাইশ নেতাদের কাছে গিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি তাঁর মাকে কাঁদাতে চায়, সন্তানকে এতিম ও স্ত্রীকে বিধবা করতে চায় সে যেন আমার সঙ্গে এই উপত্যকার পেছনে সাক্ষাৎ করে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>জ্ঞান ও প্রজ্ঞা : </strong>মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্যের বরকতে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী হন। যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীরা তাঁর জ্ঞানের সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন মুজাহিদ (রহ.) বলেন, কোনো বিষয়ে মানুষের ভেতর মতবিরোধ হলে তারা ওমর (রা.) কি করে সে দিকে লক্ষ রাখত এবং তারা সে অনুযায়ী আমল করত। আল্লামা শালবি (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি বিচারের ক্ষেত্রে সুদৃঢ় মতামত গ্রহণ করে খুশি হতে চায়, সে যেন ওমর (রা.)-এর কথা গ্রহণ করে। আর আল্লামা ইবনুল মুসাইয়িব (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কেই সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী মনে করি।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>দানশীলতা : </strong>মহান এই সাহাবি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল এবং দুনিয়াবিমুখ। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধের জন্য নিজের সমুদয় সম্পদের অর্ধেক দান করে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর বদান্যতার প্রশংসা করেন। খাইবারের যুদ্ধের পর গনিমতের সম্পদ লাভ করলে তা অসহায়, দুস্থ ও  নিকটাত্মীয়দের জন্য ওয়াফক করে দেন। তিনি জায়তুনের তেল ও রুটি খেতেন এবং পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>আদর্শ শাসক : </strong>মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও ন্যায়পরায়ণ। নেতৃত্বের গুণাবলির জন্যই আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁকে নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করেন এবং জনসাধারণও তাঁকে হৃদ্যতার সঙ্গে গ্রহণ করে নেয়। তিনি সমকালীন বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সমকালীন বিশ্বের প্রতি লক্ষ রাখতেন। যেমন তিনি রোমান সম্রাটের তুলনায় কম কর নির্ধারণ করেন এবং অক্ষমদের ক্ষমা করার নীতি গ্রহণ করেন। সামরিক জ্ঞানেও ওমর (রা.) ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সামরিক প্রজ্ঞার কারণে স্বল্প সময়ে ইসলামী খিলাফতের সীমানা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর শাসনামলে সমগ্র শাম, মিসর ও পারস্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইসলামী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ওমর (রা.)-এর প্রবর্তিত কয়েকটি ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান হলো—</p> <p style="text-align: justify;"><strong>১. প্রশাসনিক বিন্যাস :</strong> নতুন নতুন অধিদপ্তর ও বিভাগ খোলার মাধ্যমে তিনি প্রশাসনিক কার্যক্রমগুলোকে বিন্যস্ত করেন। যেমন শিক্ষা বিভাগ, অর্থ বিভাগ, পুলিশ ও নিরাপত্তা বিভাগ, বাজার পরিদর্শক বিভাগ ইত্যাদি।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>২. রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রতিষ্ঠা :</strong> ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ‘বায়তুল মাল’ বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রতিষ্ঠা করেন। যেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ সংরক্ষণ করে তা বহুমুখী কল্যাণকর খাতে ব্যবহার করা যায়।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>৩. বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা : </strong>ওমর (রা.)-এর আগে সাধারণত খলিফা ও তাঁর নিযুক্ত ওয়ালি বা গভর্নর বিচার কার্য সম্পাদন করতেন। কিন্তু তিনি বিচার বিভাগকে পৃথক করেন এবং নির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগের বিধান করেন।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>৪. কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন : </strong>ওমর (রা.) কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন এবং ইসলামে খিলাফতের বিভিন্ন স্থানে একাধিক খাল ও নালা খনন করেন।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>৫. হিজরি সন প্রবর্তন : </strong>তিনি পৃথক ইসলামী বর্ষ হিসেবে হিজরি সন প্রবর্তন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের বছরকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করায় এর নাম হিজরি সন রাখা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">২৬ জিলহজ ২৩ হিজরি তিনি মদিনায় একজন আততায়ীর হাতে শহীদ হন। আল্লাহ ইসলামের এই মহান খলিফার কবরকে প্রশান্ত করুন। আমিন।</p> <p style="text-align: justify;"><em>তথ্যঋণ : আল ফারুক, সিফাতু ওমর ফারুক ও মাউদু ডটকম</em><br />  </p>