<p>জীবন মানেই পরীক্ষা। জীবনের পরতে পরতে মানুষকে দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়। মহান আল্লাহ আমাদের কখনো সুখ-শান্তি দিয়ে পরীক্ষা করেন। আবার কখনো রোগব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৩৫)</p> <p>মুমিন রোগীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হলো রোগের ব্যাপারে সঠিক আকিদা পোষণ করা। রোগের ব্যাপারে কাউকে দোষারোপ না করা। নিজ মনে সর্বদা এই বিশ্বাস রাখা যে রোগ দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং সুস্থতা দানের মালিকও মহান আল্লাহ। আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোনো ওষুধ ও ডাক্তার রোগীকে সুস্থ করে তোলার ক্ষমতা রাখেন না। কোনো ব্যক্তি বা বস্তু কাউকে রোগাক্রান্ত করতে পারে না, সুস্থও করতে পারে না।</p> <p><strong>রোগকে তাকদিরের অংশ মনে করা</strong></p> <p>ঈমানের দাবি হলো রোগব্যাধি, বিপদাপদ ও বালা-মুসিবত সব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তাকদিরের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করা। তদ্রূপ আমাদের রোগ-শোকও তাকদিরের লিখন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বলো, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তা ছাড়া কিছুই আমাদের কাছে পৌঁছবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক। আর আল্লাহর ওপর মুমিনদের ভরসা করা উচিত।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৫১)</p> <p>অন্যত্র তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে বা তোমাদের জীবনে এমন কোনো বিপদ আসে না, যা সৃষ্টির আগে আমি কিতাবে লিপিবদ্ধ করিনি। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর জন্য সহজ। যাতে তোমরা যা হারাও তাতে হতাশাগ্রস্ত না হও এবং যা তিনি তোমাদের দেন, তাতে আনন্দে আত্মহারা না হও। বস্তুত, আল্লাহ কোনো ঔদ্ধত্য ও অহংকারীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ২২-২৩)</p> <p>অন্যদিকে শয়তান সর্বদা ‘যদি’ শব্দের মাধ্যমে মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয় এবং প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। যেমন—কোনো রোগী বলতে পারে, ‘আমি যদি এটা না করতাম, তাহলে আমার এই রোগটা হতো না কিংবা আমি যদি সেটা করতাম, তাহলে আমি সুস্থ থাকতে পারতাম।’</p> <p>শয়তানের শেখানো এই কথাগুলোতে তাকদিরের প্রতি অবিশ্বাসের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায়। তাই এই মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে যে জীবনের যাবতীয় রোগ-শোক সব কিছু আমাদের তাকদিরের লিখন। তাকদিরের প্রতি এই অবিচল বিশ্বাস রোগীর হৃদয়ে স্বস্তি ও সান্ত্বনার মৃদুমন্দ সমীরণ প্রবাহিত করে।</p> <p><strong>রোগের কষ্টে ধৈর্যধারণ করা</strong></p> <p>রোগীর অন্যতম করণীয় হলো রোগের কষ্টে ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহর কাছে নেকির প্রত্যাশা করা। আল্লাহর সত্যনিষ্ঠ ও পরহেজগার বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রোগে-শোকে, বিপদাপদে সর্বাবস্থায় ধৈর্যধারণ করা। তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন, ‘এবং অভাবে, রোগ-পীড়ায় ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যের সঙ্গে দৃঢ় থাকে। তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই হলো প্রকৃত আল্লাহভীরু।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৭৭)</p> <p>অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে ধৈর্যশীলরা তাদের পুরস্কার পাবে অপরিমিতভাবে।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ১০)</p> <p>তাবেঈ আতা ইবনু আবি রাবাহ (রহ.) বলেন, একদা আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) আমাকে বললেন, আমি কি তোমাকে একজন জান্নাতি নারী দেখাব না? আমি বললাম, অবশ্যই। তখন তিনি বলেন, এই কালো বর্ণের নারী। সে একবার নবী করিম (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আমি মৃগী রোগে আক্রান্ত হই এবং আমার লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হয়ে যায়। সুতরাং আপনি আমার (সুস্থতার) জন্য দোয়া করুন। তখন রাসুল (সা.) বলেন, তুমি চাইলে ধৈর্যধারণ করতে পারো, তাহলে তোমার জন্য আছে জান্নাত। আর যদি চাও, তাহলে আমি তোমার জন্য দোয়া করব, যাতে আল্লাহ তোমাকে সুস্থতা দান করবেন। তখন ওই নারী বলল, আমি ধৈর্যধারণ করব। সে বলল, কিন্তু ওই অবস্থায় আমার লজ্জাস্থান খুলে যায়, কাজেই আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যেন আমার লজ্জাস্থান খুলে না যায়। তখন রাসুল (সা.) তার জন্য দোয়া করলেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৬৫২)</p> <p><strong>রোগকে গালি না দেওয়া</strong></p> <p>রোগকে অশুভ মনে করা এবং রোগকে গালি দেওয়া প্রকৃত মুমিনের পরিচয় নয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) রোগব্যাধিকে গালি দিতে নিষেধ করেছেন। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মুস সায়িব বা উম্মুল মুসাইয়িব (রা.)-কে দেখতে গিয়ে বলেন, হে উম্মুস সায়িব বা উম্মুল মুসাইয়িব! তোমার কি হয়েছে, থরথর করে কাঁপছ কেন? সে বলল, জ্বর হয়েছে, আল্লাহ যেন তাতে বরকত না দেন। এ কথা শুনে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, জ্বরকে গালি দিয়ো না। কেননা জ্বর আদম সন্তানের পাপরাশি এমনভাবে মোচন করে দেয়, হাঁপর যেমন লোহার মরিচা দূরীভূত করে দেয়। (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৫১৬; মুসলিম, হাদিস : ৬৪৬৪)</p> <p>সুতরাং মুমিনের কর্তব্য হলো রোগকে গালমন্দ না করে, তা আল্লাহর কাছে সোপর্দ করা। যেমন নবী ইয়াকুব (আ.) বলেছিলেন, ‘আমি আমার দুঃখ-বেদনা আল্লাহর কাছেই নিবেদন করছি।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৮৬)</p> <p>রোগ-শোকে নিপতিত হওয়া নবী আইয়ুব (আ.)-এর কাতর কণ্ঠের দোয়া আল্লাহ পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন—‘আর (স্মরণ করো) আইয়ুবের কথা। যখন সে তার পালনকর্তাকে আহ্বান করে বলেছিল, আমি কষ্টে পড়েছি। আর তুমি দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তখন আমরা তার ডাকে সাড়া দিলাম। অতঃপর তার কষ্ট দূর করে দিলাম। আর তার পরিবার-পরিজনকে তার কাছে ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সঙ্গে তাদের সমপরিমাণ আরো দিলাম আমাদের পক্ষ থেকে দয়াপরবশে। আর এটা হলো ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮৩-৮৪)</p> <p>এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় রোগ থেকে মুক্তির প্রার্থনা করা ধৈর্যের পরিপন্থী নয়। কিন্তু রোগব্যাধিতে ক্ষোভ, হতাশা ও অনুযোগ পেশ করা ধৈর্যের পরিপন্থী। মহান আল্লাহ আমাদের সুস্থতার সঙ্গে নেক হায়াত দান করুন।</p>