<p>শরিয়ত স্বামীর ওপর স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণ আবশ্যক করেছে। পুরুষের সামর্থ্য ও স্ত্রী-সন্তানের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রেখে তা নির্ধারণ করা হবে। ইসলাম পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে মধ্যপন্থী একটি মানদণ্ড নির্ধারণের পরামর্শ দেয়।</p> <p><strong>ভরণ-পোষণ দেওয়া ফরজ</strong></p> <p>ইসলামী আইনবিদ আলেমরা এ বিষয়ে একমত যে পুরুষের জন্য স্ত্রী ও নাবালেগ সন্তানের ভরণ-পোষণ দেওয়া ফরজ। কেননা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘জনকের দায়িত্ব যথাবিধি তাদের ভরণ-পোষণ করা। কাউকে তার সাধ্যাতীত কার্যভার দেওয়া হয় না।’ সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৩)</p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা তাদেরকে তোমরা আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বিধান মোতাবেক তোমরা তাদের লজ্জাস্থানকে নিজেদের জন্য হালাল করেছ। ...তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্বও তোমাদের ওপর। তোমরা তা স্বাভাবিকভাবে আদায় করবে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৯০৫)</p> <p><strong>অর্থব্যয়ের মানদণ্ড</strong></p> <p>স্বামী স্ত্রীকে কেমন ভরণ-পোষণ দেবে তার মানদণ্ড হিসেবে ফকিহ আলেমরা নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয় দ্বারা দলিল পেশ করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেমন ঘরে বাস করো, তাদেরকেও তেমন ঘরে বাস করতে দেবে। ...বিত্তবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন তার চেয়ে গুরুতর বোঝা তিনি তার ওপর চাপান না।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৬-৭)</p> <p>আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যায় ফকিহরা বলেন, সামর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রী ও ছোট সন্তানের ভরণ-পোষণ দেওয়া স্বামীর জন্য আবশ্যক। স্বামী যদি ধনী হয় তাহলে বিত্তবানদের মতোই স্ত্রী-সন্তানের জন্য ব্যয় করবে, আর দরিদ্র হলে নিজ শ্রেণির মানুষদের অনুসরণ করবে। যে বোঝা আল্লাহ স্বামীর ওপর চাপাননি, স্বামী তা নিজের ওপর চাপাবে না। (তাফসিরে মুনির : ১৪/৬৭৭)</p> <p><strong>ভরণ-পোষণের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো</strong></p> <p>আল্লাহ তাআলা স্ত্রী ও সন্তানের ভরণ-পোষণের যে নির্দেশ দিয়েছেন নিম্নোক্ত বিষয়গুলো তার অন্তর্ভুক্ত হবে—</p> <p><strong>১. বাসস্থান : </strong>স্বামী স্ত্রী-সন্তানদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেমন ঘরে বাস করো, তাদেরকেও তেমন ঘরে বাস করতে দেবে।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৬)</p> <p><strong>২. খাদ্য-পানীয় : </strong>যথোপযুক্ত খাদ্য ও পানীয় প্রদান করা স্বামীর দায়িত্ব। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘জনকের দায়িত্ব যথাবিধি তাদের ভরণ-পোষণ করা। কাউকে তার সাধ্যাতীত কার্যভার দেওয়া হয় না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৩)</p> <p><strong>৩. পোশাক :</strong> স্ত্রীকে প্রয়োজনীয় পোশাক দেওয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে আবশ্যকীয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তারা তোমাদের কাছে উপযুক্ত জীবিকা ও পোশাকের অধিকার রাখে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৯০৫)</p> <p><strong>স্ত্রী আরো যা পেতে পারে</strong></p> <p>সর্বসম্মতিক্রমে স্বামীর ওপর স্ত্রীর বাসস্থান, খাদ্য ও পোশাক দেওয়া আবশ্যকীয়। তবে এর বাইরেও স্ত্রী আরো কিছু বিষয় পেতে পারে; যেমন—</p> <p><strong>৪. চিকিৎসা :</strong> চার মাজহাবের ইমামরা এ বিষয়ে একমত যে স্বামীর ওপর স্ত্রীর ওষুধ ও চিকিৎসকের পারিশ্রমিক দেওয়া ওয়াজিব নয়। তবে আধুনিক যুগের আলেমরা বলেন, ‘ইহসানের’ অংশ হিসেবে স্বামী স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয়ভারও বহন করবে। সামর্থ্যবান স্বামীর জন্য বিষয়টি অস্বীকার করা অনুচিত। কেননা পবিত্র কোরআনের নির্দেশ হলো, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)</p> <p><strong>৫. সাজসজ্জা : </strong>সাধারণভাবে স্বামীর ওপর স্ত্রীর সাজসজ্জার খরচ দেওয়া আবশ্যকীয় নয়। তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে কোনো সাজ বা প্রসাধনী গ্রহণের নির্দেশ দেয়, তার ব্যয় সে-ই বহন করবে। ইমাম মাওয়ার্দি (রহ.) বলেন, মাথার ও শরীরের তেল (বা আধুনিক প্রসাধনী) যা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের জন্য অপরিহার্য তা দেওয়া স্বামীর দায়িত্ব। আর তা সামাজিক রীতি অনুসারেই পাবে। (আল হাভি : ১১/৪২৮)</p> <p><strong>৬. গয়না : </strong>স্বামী স্ত্রীকে গয়না প্রদানের অঙ্গীকার না করলে স্বামীর জন্য তা প্রদান করা আবশ্যক নয়। কিন্তু অঙ্গীকার করলে তা দেওয়া আবশ্যকীয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করবে।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১)</p> <p><strong>৭. ভ্রমণের খরচ : </strong>স্ত্রীর সফর বা ভ্রমণের খরচ তার পরিবার বহন করবে। তবে নিজ এলাকায় স্বামীর ইচ্ছা ও অনুমতিতে কোথাও গেলে তার ব্যয় স্বামীই বহন করবে। (কাশশাফুল কিনা : ২/৩৯৫)</p> <p><strong>৮. হাতখরচ :</strong> ইবনুল কাইয়িম জাওজি (রহ.) বলেন, ‘নগদ অর্থ প্রদান করার বিষয়টি কোরআন ও সুন্নাহয় পাওয়া যায় না; সাহাবি, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ, চার মাজহাবের ইমাম বা ইসলামের কোনো বিশিষ্ট আলেম থেকেও বিষয়টি প্রমাণিত নয়।’ (জাদুল মাআদ : ৫/৪৫৫)</p> <p>তবে স্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্য স্বামী তাকে কিছু নগদ অর্থ দিলে ইসলাম তা নিষেধ করে না।</p> <p><strong>স্বামী ভরণ-পোষণ না দিলে</strong></p> <p>স্বামী স্ত্রীকে উপযুক্ত ভরণ-পোষণ না দিলে কৌশলে স্বামীর সম্পদ থেকে তা গ্রহণ করার অবকাশ আছে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে বিচারকের দ্বারস্থ হবে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, হিন্দা বিনতে উতবা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আবু সুফিয়ান কৃপণ লোক। আমাদের এত পরিমাণ খরচ দেন না, যা আমার ও আমার সন্তানদের জন্য যথেষ্ট হতে পারে যতক্ষণ না আমি তার অজান্তে মাল থেকে কিছু নিই। তখন তিনি বললেন, তোমার ও তোমার সন্তানের জন্য ন্যায়সংগতভাবে যা যথেষ্ট হয় তা তুমি নিতে পারো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৬৪)</p> <p><strong>পরিবারের ব্যাপারে উদারতাই কাম্য</strong></p> <p>ইসলাম পরিবারের ভরণ-পোষণকে পুরুষের ওপর আবশ্যকীয় করেছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে এ শিক্ষাও দিয়েছে যে ইসলাম পরিবারের ব্যাপারে উদারতা পছন্দ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মানুষ স্বীয় পরিবার-পরিজনের জন্য পুণ্যের আশায় যখন ব্যয় করে তখন সেটা তার জন্য সদাকাহ হয়ে যায়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৫)<br /> আল্লাহ সবাইকে পরিবারের হক আদায়ের তাওফিক দিন। আমিন।</p> <p><em>লেখক : গবেষক</em></p>